গাজার শেফা হাসপাতালের চিকিৎসকের মর্মস্পর্শী চিঠি

Gaza Doctorইসরাইলের পাশবিক হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না ফিলিস্তিনের হাসপাতালগুলো। গতকাল দেইর আল-বালাহ শহরের আল-আকসা হাসপাতালে ইসরাইলি হামলায় চিকিৎসক, নার্স ও রোগীসহ অন্তত ৬০ জন নিহত হয়েছে। একই হাসপাতালে কয়েকদিন আগে কামানের গোলায় অন্তত ৪ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৫০ জন আহত হয়েছে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মুখপাত্র আশরাফ আল কুদরা বলেছেন, দেইর আল বালাহর আল আকসা মর্টিয়ারস হাসপাতালের তৃতীয় তলা লক্ষ্য করে ইসরাইলের ট্যাঙ্ক থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হয়। হাত-পা, বুকে-পিঠে ইসরাইলি হামলার ক্ষত নিয়ে তিন বছর বয়সী ফিলিস্তিনি শিশু হাসপাতালের ডাক্তারের শার্ট আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে বলছিল, ‘আমি বাবাকে চাই। আমার বাবাকে এনে দাও।’ কিন্তু অসহায় এ শিশুটি জানে না, তার প্রিয় বাবা বেঁচে আছেন নাকি তাকে সে চিরদিনের জন্য হারিয়েছে।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার চিকিৎসা ব্যবস্থা যেকোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে বলে এর আগে সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু।  সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজা উপত্যকায় চিকিৎসা সামগ্রীর মারাত্মক অভাবের পাশাপাশি হাসপাতালগুলো চালানোর কাজে ব্যবহৃত জেনারেটরগুলোর প্রয়োজনীয় জ্বালানি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি পাশবিক হামলা বেড়ে যাওয়ার কারণে হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের ভিড় প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। কিন্তু এত রোগীর চাপ সহ্য করার ক্ষমতা অধিকৃত ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। হাসপাতালগুলোতে যে সীমিত পর্যায়ের চিকিৎসা সামগ্রী ছিল তা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং অবরোধ থাকার কারণে এ ধরনের সামগ্রীর সরবরাহও বন্ধ রয়েছে। ফলে যেকোনো সময় গাজার চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
গাজার হাসপাতালগুলোর ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন সেখানকার আল-শেফা হাসপাতালে কর্মরত নরওয়ের চিকিৎসক ড. ফ্রেডারিক গিলবার্ড। তিনি তার চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে এক রাতের জন্য আল-শেফা হাসপাতালে কাটানোর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চিঠিটির অনুবাদ নিচে দেয়া হলো:
প্রিয় বন্ধুরা,
গতকালের রাতটা ছিল অনেক দুর্বিষহ এবং দুর্যোগের রাত। গাজায় স্থল হামলার ফলে একের পর এক গাড়িভর্তি রোগী আসতে শুরু করল যাদের কারো হাত নেই, পা নেই, কবজি উড়ে গেছে, কারো মাথার খুলি বেরিয়ে পড়েছে, কারো চোখ নেই, কারো আবার শরীরের একপার্শ্ব একদম থেতলে গেছে, কারো মারাত্মক রক্তপাত হচ্ছে, কারো শরীর থেকে মাংস খসে পড়ছে, কেউবা দাপাদাপি করছে মরণ যন্ত্রণায়। আমি আশ্চর্য হয়েছি এবং কষ্ট অনুভব করেছি কারণ যারা এ হাসপাতালে এসেছে তাদের মধ্যে সব ধরনের আহত হওয়া রোগী ছিল, সব বয়সেরই ছিল, তারা সবাই ছিল বেসামরিক এবং নীরিহ। গাজার সব হাসপাতালের যতগুলো অ্যাম্বুলেন্স আছে সেগুলোর চালকেরা, যত ডাক্তার এবং সংশ্লিষ্ট সবাই শিফট আকারে ২৪ ঘণ্টাই কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়াই অমানবিক পরিশ্রম করছে। অমানবিক পরিশ্রম আর নিঃশেষ হয়ে আসা মানসিক শক্তির দরুণ তারা বিবর্ণ হয়ে উঠছে। তারা প্রত্যেকে গত চার মাস ধরে বিনা পারিশ্রমিকে সেবা দিয়ে আসছে শেফা হাসপাতালে। তারা যত্ন নিচ্ছে, তটস্থ থাকছে এই ভেবে কার আগে কাকে চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন। তারা বিশৃঙ্খলভাবে পড়ে থাকা দেহের, আঁকারের, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বোধাতীত বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে নিস্তেজ, অক্ষম, রক্তাক্ত অথবা অসাড় মানুষগুলোকে জানতে। মানুষগুলোকে!
এ মুহূর্তে, আরো একবার “বিশ্বের সবচেয়ে নীতিবান সৈন্যবাহিনী” দ্বারা পশুর মত মেরে ফেলা হচ্ছে মানুষগুলোকে ( এটাই হচ্ছে!)
আহতদের প্রতি আমার অপার সম্মান। কষ্ট, অভিঘাত আর যন্ত্রণার মাঝেও তাদের এই অসাধারণ দৃঢ়চিত্তের প্রতি আমার সম্মান। কর্মচারী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। ফিলিস্তিনি “সুমুদের” (ধৈর্য্য) প্রতি আমার ঘনিষ্ঠতা আমাকে শক্তি যোগায় যদিও মাঝে মাঝে এর এক একটি ঝলকে আমার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে। কাউকে শক্ত করে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করে। রক্তে জড়ানো ওই উষ্ণ কোমল শিশুর ত্বক ও চুলের গন্ধ নিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে, অনন্তকালের জন্য শক্ত আলিঙ্গনের মাধ্যমে নিজেদের রক্ষা করতে কিন্তু আমাদের যেমন সে সামর্থ্য নেই, তাদেরও নেই।
ধূসর-বিবর্ণ চেহারাগুলো। আহ, আর না। আর দেখতে চাই না শত রক্তাক্ত- বিকলাঙ্গ শরীরের বোঝা। আমাদের ‘ই আর’- এর ফ্লোর অনেক আগে থেকেই রক্তে ভেসে যাচ্ছে। গাদা গাদা ভেজা গলা ব্যান্ডেজ এখনো পরিষ্কার করা বাকি। ওহ! চারিদিকে শুধু ক্লিনাররা রক্ত সেচছে, ব্যবহৃত টিস্যু, চুল, ক্যানুলা আর মৃতদেহের উচ্ছিষ্ট সরিয়ে নিচ্ছে। সব সরিয়ে নেয়া হচ্ছে নতুন করে শুরু করার জন্য। গত চব্বিশ ঘণ্টায় একশোরও বেশি কেস এসেছে শেফাতে। একটা বড় ভালভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাসপাতালের জন্য যা যথেষ্ট হিমশিম খাওয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু এখানে তো কিছুই নেই। ইলেক্ট্রিসিটি নেই, পানি নেই, ডিস্পোসেবোলস, ড্রাগ, ও আর টেবিল, যন্ত্রপাতি, মনিটর সব পুরনো মরিচা ধরা- যেন অতীতের কোনো হাসপাতালের জাদুঘর থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। অথচ তারা কেউ অভিযোগ করছে না। তারা সাহসী যোদ্ধার মতো এগুলো দিয়েই চালিয়ে নিচ্ছে মাথা উঁচু করে অতিশয় অটল চিত্তে।
আর আমি যখন তোমাদের কাছে এই কথাগুলো লিখছি, একা শূন্য বিছানায়, আমার চোখ বাঁধ মানছে না। কিছু না করতে পারার যন্ত্রণা আর ক্ষোভ, রাগ আর ভয় উষ্ণ পানি হয়ে ঝরে পড়ছে। এটা হতে পারে না।
এবং এখন, এইমাত্র, ইসরাইলি যুদ্ধযন্ত্রের বাদকদল আবার তাদের ভয়াবহ ঐকতান শুরু করে দিয়েছে। ঠিক কিছুক্ষণ আগে নৌবাহিনীর কামানের গোলা তীরে আঁছড়ে পড়েছে। এফ১৬ এর গর্জন, ড্রোন (‘Zennanis’) আর বিশৃঙ্খল Apaches। যার বেশিরভাগই ইউ এস এ তৈরি এবং তাদেরই দেয়া।
মিস্টার ওবামা- আপনার হৃদয় বলে কি কিছু আছে? আমি আপনাকে এক রাতের জন্য নিমন্ত্রণ করছি, শুধু একটি রাত, আমাদের সঙ্গে শেফায় কাটিয়ে দেখুন। একজন পরিছন্ন কর্মীর ছদ্মবেশেই না হয়? আমার শতভাগ বিশ্বাস এর মাধ্যমে ইতিহাস বদলে যাবে। কোনো  হৃদয়বান এবং ক্ষমতাধর মানুষের পক্ষেই রাতের  শেফা ছেড়ে আসা সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ করছে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্মম বর্বরতার ইতি টানতে।
কিন্তু এই নির্দয় আর নিষ্ঠুর ক্ষমতাধরেরা তাদের হিসাবনিকাশ চুকিয়ে ফেলেছে। তারা গাজায় আরেকটি “দাহিয়া” আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে।
আগামী রাতগুলোতে রক্তের নদী বহমান থেকে যাবে। আমি শুনতে পাচ্ছি, তারা তাদের অস্ত্রে শাণ দিচ্ছে। দয়া করে যা পার কর। এটা, এই হত্যাযজ্ঞ, কিছুতেই চলতে পারে না।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button