‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’ শামীম ওসমান ও আওয়ামীলীগ
এনাম চৌধুরী
দেশের মানুষ দেখছে, প্রবাসের মানুষ দেখছে, সব কিছুই এখন বলতে গেলে ক্যামেরার সামনেই ঘটছে। প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি বিনা উস্কানীতে গুলি করে পশুর মত মানুষ মারছে ! হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে সাদা পোষাকের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং পরে সেটা অস্বীকার করছে। কখনো তাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে, আবার কখনো তারা গুম হয়ে যাচ্ছেন। সহজ কথায় বাংলাদেশে এখন আইনের শাসন বলতে কিছুই নেই।
বিরোধী দল আন্দোলন দূরে থাক, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনটুকু করার সুযোগ পাচ্ছে না। সব কিছুতেই আওয়ামীলীগ নিয়ন্ত্রিত পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে গ্রেফতার নির্যাতন, গুলি করা, পঙ্গু করে দেয়া এখন তুচ্চ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সারা দুনিয়া জানে, ঝালকাটিতে ‘লিমন’ নামের এক নিরীহ ছাত্রকে র্যাব প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে। লিমন এখন পঙ্গু। একটি পা তার চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। লিমনের কোন অপরাধ ছিলো না, অথচ গুলি কারী র্যাব এর পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিভৃত গ্রামের একজন লিমনকেই সন্ত্রাসী বানাতে যত অপকৌশল ছিলো সবই করেছে। ভাগ্যাহত লিমন পঙ্গু হলেও তার কোন বিচার হয়নি। সরকার র্যাব নামক গোন্ডা ‘রক্ষী বাহিনী’র পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের সুশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকেই ধ্বংসের অপ্রয়াস চালায়নি, বাংলাদেশে যে কোন ধরণের আইনের শাসন রয়েছে সেটাকে মূলত বুড়ো আঙ্গুল দেখালো।
ঝালকাটির লিমনকে নিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। এখন গোটা বাংলাদেশই মূলত একটি রক্তাক্ত উপত্যকা। জলজ্যন্ত মানুষকে পুলিশ মারছে, মারছে সরকারের পেটোয়া বিশেষ বাহিনী। মানবতা বলতে যে কিছু অবশিষ্ট আছে সেটা আর এখন বলা যায় না।
উদ্বেগের সাথে দেখা যাচ্ছে গত জানুয়ারীর কথিত নির্বাচনের পর আওয়ামীলীগ বেপরোয়া পশুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র ক্যাম্পাসে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য পুলিশ-র্যাব এর উপস্থিতিতে কমান্ডো স্টাইলে গুলি করে, কেউ তাদের বাঁধা প্রদান করে না। কিন্তু শত শত মেধাবী ছাত্রদেরকে সরকার বিরোধী আখ্যা দিয়ে নির্যাতন চালিয়ে তাদের মেধাবী ছাত্রজীবনকেই শুধু ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে না, হাজার হাজার স্বপ্নকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। রাজপথে হাতে হাতকড়া পড়িয়ে কমান্ডো স্টাইলে নিরীহ পথচারী যুবকের উপর একসাথে দশ পনেরজন পুলিশ র্যাব আঘাত করতে দেখা গেছে। এক সময় নিস্তেজ যাওয়া সেউ যুবকটাকে পুলিশ শরীরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পৃথিবীর বিচার ব্যবস্থা, আইনের শাসন, গণতন্ত্রের ইতিহাসে এমন বর্বরতার নজীর আছে বলে জানা নেই !
প্রতিটি দিনই সংবাদ পত্রের পাতায় শিরোনাম হচ্ছে, গুম, লাশ সম্পর্কিত সংবাদ। রাষ্ট্রীয় বাহিনী সরকারে দলের গডফাদারদের হুকুমে মানুষ খুন করে যেখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছে, কিন্তু সরকার এসব খুন-গুমের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, উল্টো তামাশা করতেও দ্বিধা করেনি। যেখানে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান যে কোন সরকারের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব, সেখানে সরকার অসহায়ের পক্ষে না দাঁড়িয়ে খুনীদের পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছে।
দেশের সাধারণ জনগণ, বিদেশী পর্যবেক্ষকেরা তাদের চোখের সামনে দেখছেন কি হচ্ছে বাংলাদেশে ? অপরাধীরা কিভাবে সরকারের সেল্টার পাচ্ছে সেটা কল্পনার বাইরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা একের পর হত্যা সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রলীগের দানবীয় তান্ডব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, গোটা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে রক্ত ঝরছে। গুলি করে পা কেটে নিয়ে পুলিশের সামনে উল্লাস করার ঘটনায় বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিলো স্বাভাবিক। তারা ছাত্রলীগের প্রশবৃত্তির উল্লাসকে সমর্থনই শুধু নিচ্ছে না, প্রতিপক্ষর উপর আক্রমণের সময় র্যাব-পুলিশ যৌথ ভাবে ছাত্রলীগকে সহযোগিতা করতে দেখা যাচ্ছে। বিশ্বজিৎ নামের নিরীহ দর্জি দোকানের কর্মচারী হিন্দু ছেলেটিকে যখন ‘ছাত্র শিবির’ কর্মী ভেবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নিমর্মভাবে কোপাচ্ছিল আর আঘাতে আঘাতে জর্জরিত রক্তাক্ত ছেলেটি যখন চিৎকার করে বলছিলো আমি ‘হিন্দু’ আমাকে মেরো না, তোমাদের আল্লাহর কসম আমাকে মেরে না। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে লোমহর্ষক সেই হত্যাকান্ডটি ঘটার সময় পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। একটা ফাঁকা গুলি ছুড়েও খুনীদের থামানো দূরে থাক, নূন্যতম চেষ্ঠা পর্যন্ত করেনি !!
ইতিহাসের করুণ ঐ বর্বরতার পরও সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, ছাত্রলীগের ভেতর নাকি ছাত্র-শিবির ঢুকে খুন খারাবী করে ছাত্রলীগের ইমেজ সংকট তৈরী করছে !
অথচ ছাত্রলীগের ঐ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, ধর্ষনের ঘটনা যেন ডালভাতের মতই হয়ে গেছে। তাদের যা ইচ্ছে করে যাচ্ছে, কিন্তু সরকার বানর খেলার মতই তামাশা করে যাচ্ছে। আর এমন অবস্থা শেখ হাসিনার শোসনের শিকার বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ। একদিকে সরকারী বাহিনী, অপরদিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ সহ সরকার সমর্থকদের উম্মত্ত সন্ত্রাস অপর দিকে এসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ে সরকারের নূন্যতম মাথাব্যথা দূরে থাক, বরং জঘন্য কায়দায় এসব খুন খারাবী নিয়ে রসিকতা করতে দেখা গেছে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে এসব খুন, গুম নিয়ে নানা ধরণের চটুল বক্তব্য দিয়ে যেন দারুণ তৃপ্তি পান। দেশের যাবতীয় অপরাধ, খুন, গুম, অন্যায়-অবিচার, ব্যর্থতা, খুন, গুমের জন্য বিএনপি-জামায়াতের উপর দোষ চাপান। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। নীতিগতভাবে সকল অবস্থাতেই এসবের দায়িত্ব তার উপরই বর্তায়।
দিন-দুপুরে তার দলের সন্ত্রাসীরা থানায় আক্রমণ করছে। র্যাব-পুলিশ রক্ষীবাহিনীর মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে সরকার র্যাব, পুলিশ, বিজিবিকে ইচ্ছেমত নির্লজ্জ কায়দায় ব্যবহার করছে। সরকারের নির্লজ্জ কায়দায় র্যাব-পুলিশকে খুন, গুমে ব্যবহার করায় তাদেরও আর নৈতিক কোন মনোবল আর নেই। তারাও এখন বুঝে গেছে কর্তব্য ও আদর্শকে পায়ে দলে আখের গোছানোই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই র্যাব-পুলিশ সরকার দলের নেতা, কর্মী, গডফাদারদের নির্দেশে অর্থের বিনিময়ে খুন, গুমে অবিরত জড়িত রয়েছে। পাটি গণিতের নিছক সংখ্যার হিসেবে মানুষ গুম-খুন হয়ে গেলেও সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জীবন নিয়ে বাংলাদেশের কথিত সরকারের কোন কর্তব্যই যেন নেই।
২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, জেলা বারের সিনিয়র আইনজীবি চন্দন সরকার সহ সাতজন অপহরণ এবং পরবর্তীতে বস্তাবন্দী করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেয়ার ঘটনার পর সব কিছু পুরোপুরিই প্রকাশিত হয়। গডফাদারের নিদেশে সাতটি তাজা প্রাণকে অপহরণও খুন করে র্যাব। আর সেটা করেছে তারা মূলত ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’ হিসেবে। যেখানে খুন ও গুমের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
ক্ষমতাসীনরা কত নির্লজ্জ হলে দেশে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে সেটাই প্রমাণ করে নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহরণ ও খুন হওয়া সাতটি জীবনের কাহিনী থেকে। এই খুনীরা সাধারণ কোন খুনী নয়, এরা পেশাদার, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং বুদ্ধিমান। মরা মানুষের পেট ফুলে যায় এবং সে কারনে পানিতে ডুবন্ত থাকলে ঐ লাশ ভেসে ওঠে। সেটা এড়াতে খুনীরা সাতটি লাশের পেটই চিরে দিয়েছিলো ! এর পর থলে ভর্তি ইট বেঁধে লাশগুলো নদীতে ফেলে দেয়। তারা ভেবেছিলো লাশগুলো আর কেউ দেখতে পাবে না। ইটবাঁধা লাশ ভেসে উটবে না। নদীর তলদেশেই তাদের জীবনের সব পরিচয় মিশে যাবে। কিন্তু সেই যে, ‘ধর্মের কল বাতাসেও নড়ে’ চারদিনের মাথায় লাশ গুলো শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে উঠে।
এতো বড় ঘটনায়, এতো বড় কলঙ্কজনক কাজের কারণে সরকার কি কোন বিব্রত হয়েছিলো ? মোটেই না। মেখ হাসিনা গুপ্ত হত্যা ও চোরগোপ্তা হামলার জন্য আবারো বিরোধী জোটকে দায়ী করছেন। এসব ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করছেন। অথচ আইন শৃঙ্খলা-জানমালের নিরাপত্তা বিধান যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সে মন্ত্রালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। কিন্তু ব্যতিক্রম শেখ হাসিনা। এতো খুন, এতো গুম, এতো নিপীড়ন তার পর প্রতিটি মিটিং সমাবেশ, সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় কালে তিনি রসিকতা করে বলেন, দেশের আইন শৃঙ্খলা অত্যন্ত ভালো এবং দেশে যত খুন, গুম হচ্ছে এর জন্য বিরোধী জোট দায়ী !
সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত সন্ত্রাসী ও গডফাদারদের একজন নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেছেন, শামীম ওসমান ও তার পরিবারকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, তাই ওদের পাঁশে সরকার আওয়ামীলীগ ও তিনি নিজে সব সময় থাকবেন। শামীম ওসমানের ক্ষতি করার চেষ্ঠা করলে এর পরিণাম শুভ হবে না এমনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরোক্ষভাবে দেশবাসীকে জানান দিয়েছেন ?
শামীম ওসমান কোন ব্যক্তি সম্প্রতি তার বিভিন্ন বক্তব্য, হুমকী, ধমকী এবং অশোভন আচরণের কারণ বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে জানতে পারে তার সন্ত্রাসী আচরণ নতুন কিছু নয়। প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জকে ঐ শামীম ওসমান ও তার পরিবারের লোকজন শুধু কলঙ্কিতই করেনি, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য শামীম ওসমান এক নিকৃষ্ট ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেছেন। গডফাদার কেন্দ্রীয় রাজনীতির হোতা শামীম ওসমানের পাশে থাকার ঘোষনা প্রধানমন্ত্রী দেয় নারায়ণগঞ্জ বাসীকে নয়, গোটা বাংলাদেশের সন্ত্রাসী গডফাদারদের প্রকাশ্য শেলটার দিলেন। ইতোমধ্যে দেশবাসী দেখেছে ফেনীর গডফাদার নিজাম হাজারীকে কিভাবে তাদের নিজ দলের নির্বাচিত চেয়ারম্যান একরামুল হত্যাকান্ড থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। সহজ অর্থে বাংলাদেশে খুনের শাসন কায়েমকে কার্যকর করার বাস্তব উদাহরণ তৈরী করলেন তারা। প্রকাশ্য ঘোষনা দিয়ে রক্ষা করলেন গডফাদারদের। যারা চিহ্নিত, তাদের রাজনৈতিক জীবন কলঙ্কে ভরা। সামাজিকভাবে এরা ভয়ানক, হিংস্র প্রকৃতির মানুষ।
নারায়ণগঞ্জে সাতটি গুমের ঘটনার পর যখন গডফাদার হিসেবে শামীম ওসমানের নাম মিডিয়ার আলোচিত হতে থাকে, তখন শামীম ওসমান প্রকাশ্য মিডিয়ায় ইন্টারভিউ দিয়ে বলতে থাকেন, তিনি ঐ ঘটনার ১৫ মিনিটের মধ্যে সুপ্রীম অথোরিটি শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দিয়েছেন কারা নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের সাথে জড়িত।
জাতির জন্য বড় বিস্ময়, শামীম ওসমান স্পষ্ঠ, প্রকাশ্য বলে দিয়েছে সে শেখ হাসিনাকে ঘটনার পনের মিনিটের মধ্যে সব জানিয়েছে। কিন্তু হতভাগা জাতি দেখলো যে শামীম ওসমান সব জানে তাকে রাষ্ট্রীয় কোন সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ দূরে থাক, সন্ত্রাসীদের গডফাদার শামীম ওসমান আওয়ালীগ ও শেখ মুজিব পরিবারের সম্পদ অভিহিত করে তাকে শেখ হাসিনা সরাসরি সাহায্যের ঘোষণা দিলেন !!
এবার শামীম ওসমান সম্পর্কে পাঠককে একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির ‘কালশাপ’ খ্যাত ঐ শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জে কি বিভিষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে এবং এখনও করছে সেটা সম্পর্কে এ প্রজন্মের অনেকেই পুরোপুরি অবগত নয়। শামীম ওসমান শুধু সন্ত্রাসীদের গডফাদারই নয়। স্বাধীনতার পর থেকে নারায়ণগঞ্জে তার রাজনৈতিক জীবনে যত হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছে এর সবগুলো ঘটনা ঘটার আগেই সে জানতো।
২০০০ সালের ২৬ অক্টোবর ‘দৈনিক মানব জমিন’ পত্রিকায় শামীম ওসমানের “সুকৃতি” নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্ট ছিলোঃ “নারায়ণগঞ্জে সবকিছুর নেপথ্যে থাকেন একেএম শামীম ওসমান এমপি। প্রশাসন থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি থানা প্রশাসনেও শামীম ওসমানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত।”
“শামীম ওসমানের এই এক আধিপত্যের পেছনে রয়েছে তার সুসংগঠিত প্রাইভেট বাহিনী। ক্যাডারদের মাধ্যমে শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রতিপক্ষহীন এই ক্যাডার বাহিনী নারায়ণগঞ্জ কায়েম করেছে নীরব সন্ত্রাসের রাজত্ব।
তিনি দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাচনা না করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার ক্যাডারদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামীলীগের একটি অফিপ থাকলেও কার্যত সব ধরণের কার্যক্রমই পরিচালিত হয় শহরের রাইফেলস ক্লাবকে কেন্দ্র করে। আর রাইফেলস ক্লাবটি ইতিমধ্যেই ক্যাডারদের ডে কোয়ার্টার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শামীম ওসমান এমপি সেখানে প্রতিদিনই যান এবং ক্যাডারদের দিক-নির্দেশনা দেন।
“জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি), শামীম ওসমানের কথার বাইরে যান না। ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর ও নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ওসিদের নিয়োগ-বদলীও নিয়ন্ত্রণ করেন শামীম ওসমান এমপি নিজেই।
“তোলারাম কলেজের জিএস হিসেবে পরিচিত জাকিরুল আলম হেলাল নারায়ণগঞ্জের এমপি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন গোলাম সারোয়ারের ছোট ভাই। বাদল হেলাল মিঠু সকলেই এলজিইডিসহ বিভিন্ন টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন। টেন্ডারবাজির কাজে তারা নিরীহ ছাত্রদেরও ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, এই কলেজে ছাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনা নিত্য-নৈমিত্তি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ছাত্রীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। … তোলারাম কলেজের পূর্ব পাশে লাগোয়া একটি স্থানে পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে টিনশেডের একটি ঘরে ‘৯৮ সালে বোমা বানাতে গিয়ে দুইজন ক্যাডার নিহত হয়। আহত হয় বেশ কয়েকজন। পরবর্তীতে লাশ দু’টিরও হদিস পাওয়া যায়নি।”
২৬ অক্টোবর ২০০০ এর মানবজমিনের অপর রিপোর্টটি ছিলোঃ “ক্যাডারদের দখলে নারায়ণগঞ্জ” “প্রাচ্যের ডাণ্ডি বলে খ্যাত বন্দর নগরী নারায়ণগঞ্জ এক সময় পাট শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। মার খেয়ে গেছে সে পাট শিল্প। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, পাট শিল্পের জায়গাগুলো দখল করেছে সন্ত্রাস-শিল্প। ‘সন্ত্রাসের পেছনে রয়েছে একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দলের একেএম শামীম ওসমানের আশ্রয়পুষ্ট। ফেনীর জয়নাল হাজারীর প্রাইভেট বাহিনীর ক্লাস কমিটির মতো এ বাহিনীর কোনো নাম নেই। তবে ক্লাস কমিটির চেয়ে এ বাহিনী আরো সুসংঘবন্ধ। ইদানিং আরো বেশি বেপরোয়া। ১৬টি গ্র“পে এ বাহিনীর রয়েছে সদস্য সংখ্যা আড়াইশ’। তার মধ্যে একশ’ জনের বেশি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী রয়েছে। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির জন্য এ বাহিনীর আলাদা আলাদা গ্র“প। এসব ক্যাডারদের অনেকেই এখন কোটিপতি। নারায়ণগঞ্জের বেশিভাগ প্রতিষ্ঠানেই কার্যত কোনো টেন্ডার হয় না। লোক দেখানো, নাম সর্বস্ব টেন্ডার প্রক্রিয়া চলে। তবে পেশাধার ঠিকাদার কোনো টেন্ডার পান না। টেন্ডার পায় সন্ত্রাসীরা। কোনো পেশাদার ঠিকাদার কাজ করতে চাইলে তাকেও সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে টেন্ডার কিনে নিতে হয়। কার্যত সরকারি সব সংস্থার টেন্ডারই নিয়ন্ত্রণ করে ক্যাডারদের টেন্ডার সিন্ডিকেট। অনেক সময় বড় ধরণের কাজের ক্ষেত্রে শামীম ওসমান এমপি নিজেও টেন্ডার ভাগ করে দেন।”
‘দৈনিক দিনকালে’ প্রকাশিত সংবাদ শিরোনাম ছিলোঃ “সন্ত্রাসের জনপদ নারায়ণগঞ্জ সিরিয়াল”- “গডফাদার শামীম ওসমান সংখ্যালঘুদের জমি দখল করে পারিবারিক গোরস্তান করেছে। গডফাদার পরিবারের আশির্বাদপুষ্ট এক ব্যক্তি উপমহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান লাঙ্গলবন্দরে বহু জমি দখল করে রেখেছে। লাঙ্গলবন্দে আসা সন্ত্রাসীদের কাছ থেকেও জোর করে চাঁদা আদায় করা হয়।
“ধর্মীয় উৎসব নারায়ণগঞ্জের গডফাদার ও তার সন্ত্রাসীদের জন্য আশির্বাদ হয়ে আসে। ঈদ, পূজা প্রভৃতিতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে। ঈদুল আজহার সময় গরুর হাট বসায় যত্রতত্র। প্রশাসনের অনুমতি বা টেন্ডার ছাড়াও হাট বসায়। জোর করে গরু তোলে।
“গডফাদাারের অন্যতম শিষ্য সেলিম ছিল টোকাই। সে এখন কোটিপতি। বিদ্যুৎ টাওয়ারের চারাশের মাটি কেটে টাওয়ার ধ্বংসের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হলেও গডফাদারের ইশরায় তাকে খালাস দেয়া হয়। সে পরে জোর করে দখল করে বিআর প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ। ইন্ডাস্ট্রির প্রকৃত মালিকদের তারা এলাকা ছাড়া করেছে। সন্ত্রাস ও চোরাই তেলের ব্যবসার প্রতিবাদ করায় গডফাদারের সন্ত্রাসীরা সেলিমের দু’হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে খেলনা পিস্তল ধরিয়ে দিয়ে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আরেক প্রতিপদী যুবক পিন্টুকেই টোকাই সেলিম পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।”
২০০১ সালের ১২ মার্চ ‘দৈনিক মানবজমিন’-এ প্রকাশিত সংবাদটি ছিলোঃ- “সন্ত্রাসীরা নারায়ণগঞ্জে প্রকাশ্যে কুপিয়ে কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অলিখিত কার্ফ্যু জারি করে। একের পর এক সকল দোকানপাট, যানবাহন ও বিভিন্ন আলো নিভিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়। ফলে বিশাল এলাকা হয়ে পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত ১২ পর্যন্ত বৃহত্তর মাসদাইর এলাকা থেকে যুবলীগ সন্ত্রাসীদের দখলে। এ অবস্থায় প্রতিপক্ষের উপর্যুপরি অস্ত্রের কোপে ক্ষত-বিক্ষত রাসেলের নিথর দেহ পড়ে থাকে দীর্ঘক্ষন রাস্তার উপরে। রামদায়ের আঘাত নিয়ে শুক্কর নামের (২০) অপর এক যুবক পুকুরে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে যায়। ফতুল্লাহ লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে যায়। ফতুল্লাহ থানা পুলিশ পুরো ঘটনাটি জেনেও রহস্যজনক কারণে শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছুই জানে না বলে জানায় শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মাসদাই এলাকায় যুবলীগ সন্ত্রাসীরা এ নির্মম হত্যাকান্ড ঘটায়।”
একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে চাকুরী করতেন শামীম ওসমানের বাবা। আর্থিক সংকটের কারনে ১৯৮৩ সালে তাদের নারায়ণগঞ্জের বাড়ী “হীরামহল নীলামে উঠে যায়। এখন ঐ শামীম ওসমান শত শত কোটি টাকার মালিক। চাষাড়া ঈদগাঁ মাঠের পূর্ব পাশে প্রায় তিনকোটি টাকা ব্যয়ে শামীম ওসমান বাড়ী থেকে করে সেখানে বসবাস করছেন। ১৯৭৯ সালে সরকারী তোলারাম কলেজের ছাত্রনেতা থাকাকালীন সময়ে শামীম ওসমান প্রকাশ্য অস্ত্রবাজি শুরু করে। এর আগে স্বাধীনতার পর থেকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকলেও সেগুলো দৃশ্যপটে আসেনি। প্রথম অবস্থায় তার ‘রাজনৈতিক গুরু’ ছিলেন ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ আসন থেকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী গিয়াস চেয়ারম্যান। রাজনীতির ময়দানে ‘গুরুমারা শিষ্য’ শামীম ওসমান এ সময় গুরু গিয়াস চেয়ারম্যানকেও রক্ত চক্ষু দেখাতে দ্বিধা করেনি। সেই থেকে রাষ্ট্রীয় মদদে একজন সন্ত্রাসী শামীম ওসমান এখন খুদ প্রধানমন্ত্রী (?) শেখ হাসিনার আস্থাভাজন একজন। যার পাশে তিনি থাকবেন এবং সে যাই করুকনা কেন সবই মিথ্যা প্রপাগান্ডা ষড়যন্ত্র !!
২০০১-এ ‘সাপ্তাহিক বিক্রম’ ২০-২৬ মার্চ সংখ্যার একটি প্রতিবেদন ছিলোঃ- “ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে নির্বাচনে আওয়ামী এমপি শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জে হত্যা, সন্ত্রাস, খুন, চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। শামীম ওসমানের বাহিনীর হাতে খুন হয়েছে ১২জন বিএনপি কর্মী। নারায়ণগঞ্জে বিএনপি অফিসে কমপেক্ষ ৮ বার আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিরোধী দলের পার্বত্য চট্টগ্রাম লং মার্চে বাধা প্রদান করে তিনি আওয়ামীলীগে আরো জনপ্রিয়তা (!) অর্জন করেছেন। টানবাজার পতিতালয় উচ্ছেদ করে জমি দখল করেছেন। সর্বশেষ বিরোধী দলের সচিবালয় অবস্থান কর্মসূচিতেও আসার পথে রাস্তায় ট্রাক ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। তার সন্ত্রাসের কারনে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা নারায়ণগঞ্জে তাদের কর্মকাণ্ড এক রকম বন্ধ করে দিয়েছে।
“শুধু বিরোধী দল নয় শামীম ওসমানের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও নারায়ণগঞ্জে টিকে পারছেন না। সামান্যতম বিরোধিতা তিনি সহ্য করেন না। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামীলীগ সভাপতি নাজমা রহমান নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় চলে এসেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস চৌধুরীর হাত ধরে শামীম ওসমান রাজনীতিতে আসলেও তার বাহিনীর কাছে গিয়াস চৌধুরীরা হারিয়ে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের শিমরাইল মোড় হচ্ছে শামীম ওসমান বাহিনীর চাঁদাবাজির মূল আস্তানা। এখানে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডারা শামীম ওসমানের নির্দেশে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। শোনা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এমপিদের মধ্যে শামীম ওসমান একজন। বিরোধী দল নিষিদ্ধ করার অভিযানে তিনি একজন সফল ব্যাক্তি। এ কারণে সরকারও তার উপর খুশি। ফলে শামীম ওসমানের দাপট দিন দিন বেড়েই চলেছে।”
এতো কিছুর পরও সন্ত্রাসী শামীম ওসমান শেখ হাসিনার আশ্রয় পুষ্ঠ ভালো মানুষ। মানবতার বিরুদ্ধে এমন ঘৃণ্য সন্ত্রাসীদের মদদ দেয় ওরা কি মানুষ ?