ব্রিটেনের কুইন অ্যাওয়ার্ড পেলেন মামুন চৌধুরী
আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য: দ্বিতীয় বাংলাদেশি ব্যবসায়ী হিসেবে ব্রিটেনের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক কুইন অ্যাওয়ার্ড পেলেন মামুন চৌধুরী। ১৪ জুলাই বাকিংহ্যাম প্যালেসে রানী তার হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন। এসময় রানী জানতে চান ব্যবসার নানা দিক। সাড়ে চার মিনিটের আলাপচারিতায় তার ব্যবসার ৯০ শতাংশই বিদেশে রপ্তানি হয় জেনে খুব খুশি হন রানী।
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের ময়নাবাদ গ্রামের মামুন চৌধুরীর এই অর্জনের পেছনে রয়েছে কঠোর পরিশ্রমের দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৮৫ সালে মামুন চৌধুরী ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদিতে পাড়ি জমান। কঠোর পরিশ্রম, দিনের পর দিন মুখ বুজে শুধু কাজ আর কাজ করতে থাকেন। ১৯৮৭ সালে ফুড অ্যান্ড কমোডিটির ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবসা শুরু করেন। বিশ্বাস ও সততা ছিল তার মূলধন। কিছুদিনের মধ্যেই তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি তিনি মক্কা আল মুকাররমা হতে প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট বিজনেস শুরু করেন। সে সময়ে তিনি বহু মানুষকে সৌদি আরবে চাকরির ব্যবস্থাও করে দেন। ইরাক যুদ্ধের আগ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সব স্থবির হয়ে পড়ল। এমন দুর্দিনেও হাল ছাড়েননি মামুন চৌধুরী। কয়েক মাস অপেক্ষা করে কোনোভাবে তিনি জেদ্দায় চলে যান এবং লগ্নিকৃত অর্থের আংশিক উদ্ধার করতে সমর্থ হন। কিন্তু কোথাও কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন না কিছুতেই।
১৯৯১ সালে মামুন চৌধুরী পা রাখেন ইংল্যান্ডে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সাফল্য এসে ধরা দেয়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক লন্ডনে সরবরাহ শুরু করেন। প্রথম দিকে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। হাই স্ট্রিট ও মার্কেটে গিয়ে কাপড় দিয়ে আসতেন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের খুব একটা আগ্রহ ছিল না।
তিনি বলেন, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারেও আমি বাণিজ্য করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার শার্টগুলো ঠিকঠাকমতো উপস্থাপন করা হয়নি। যাই হোক, বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর একজন আমার হাতে ‘মাইকেল মার্কস’ নামের এক রিফিউজির জীবনকাহিনী তুলে দেন। সেই কাহিনী আমার বাকি জীবনে চলার পথে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে ও দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
১৯৯২ সালে মামুন চৌধুরী ‘লন্ডন ক্লথিং লিমিটেড’ চালু করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে গার্মেন্ট পণ্য এনে ইংল্যান্ড ও ইউরোপে সরবরাহ করতে থাকেন। পাশাপাশি তিনি নিজস্ব একটি কারখানা স্থাপন করেন যেখানে জ্যাকেট কিংবা কোটের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পোশাক তৈরি হতো। সেই সময়ে প্রতিযোগিতা ছিল খুব বেশি। ইস্ট-এন্ডে ছিল হাজারো কারখানা। একে অন্যকে মেরে কেটে যে যেভাবে পারছিল টিকে থাকতে চেষ্টা করতে থাকেন। সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যতিক্রমী কিছু করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ১৯৯৬ সালে মামুন চৌধুরী স্বল্প মূল্যের বদলে শুরু করেন হাই কোয়ালিটি ব্রিটিশ পোশাক তৈরি। এসময় বিভিন্ন দেশের পোশাক ডিজাইনারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়। মাত্র দুই বছর পরেই তিনি তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। তার মূল কর্মক্ষেত্র উন্মুক্ত করেন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির শিক্ষানবিশ ও শিক্ষার্থীদের জন্য। এই সিদ্ধান্তটি তার ব্যবসার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কারণ এরই মাধ্যমে তিনি ফ্যাশন দুনিয়ার নিত্যনতুন ডিজাইন স্কিল ও ডেভেলপমেন্ট খুব কাছ থেকে অবলোকন করেন। তিনি তার এই বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজস্ব প্রোডাক্টকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করেন। তবে সেই পথ ও ছিল বন্ধুর! মামুন চৌধুরীর ভাষায়, ‘আমি যতবার চেষ্টা করেছি, তার চেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছি, তাই সাফল্যও পেয়েছেন তার চেয়ে শতগুণ বেশি। কারণ ব্যর্থতা থেকে হতাশ হয়ে পড়েননি, বরং নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছেন। ব্যর্থতা থেকেই শিক্ষাগ্রহণ করেছেন।
২০০২ সালে শুরু করেন লন্ডন ট্র্যাডিশান। ‘লন্ডন ট্রাডিশান’ হাতেগোনা কয়েকটি প্রোডাক্ট নিয়ে মার্কেটে আসে। ইউকের পাশাপাশি ফ্রান্সের বাজারেও পণ্য পাঠায় নতুন এই প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৪ সালের দিকে মামুন চৌধুরী ওভার সাইজ ড্যাফল কোটের রিডিজাইনের কথা ভাবেন। তিনি বেশ কয়েকটি ডিজাইন করে জাপানে পাঠান। বলাই বাহুল্য আশাব্যঞ্জক সাড়া পান।
মামুন চৌধুরী বলেন, ‘আমার বিশ্বাস ছিল, লাক্সারি আউটার ওয়্যার দুনিয়ার লন্ডন ট্র্যাডিশান একদিন গ্লোবাল ব্র্যান্ড হবে। হয়েছেও তাই। আজ আমরা আনলাইনড ট্র্যাডিশনাল আউটারওয়্যারের পাশাপাশি ওভারকোট, পি কোট, রেইনকোটসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গার্মেন্ট সামগ্রী স্পেশিয়ালিস্ট। আমাদের মতো স্পেশাল গার্মেন্ট সামগ্রী তৈরি করে থাকে, এমন প্রতিষ্ঠান এ দেশে খুব কমই আছে। কারণ চলমান যান্ত্রিকযুগে এখনও কাটিং-ফিনিশিং সব হাতে হাতে করেন বলে জানান তিনি।
মামুন চৌধুরীর এই অর্জনে আলোকিত হয়েছে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের মুখ, অনেককেই নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। মামুন চৌধুরী সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন এখন এলাকার গরিব অসহায়দের জন্য কিছু করার। সততা পরিশ্রম আর অধ্যবসায় দিয়ে অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সম্মাননা।