সবুজ পাহাড়ে রঙ্গীন ঈদ : অতিথি বরণে প্রস্তুত পর্যটক শহর খাড়াছড়িতে
মাটিরাঙ্গা (খাগড়াছড়ি) থেকে মুজিবুর রহমান ভুইয়া : বাংলাদেশের এক-দশমাংশ রূপময় ভূখ- পার্বত্য চট্টগ্রাম। মহান সৃষ্টিকর্তা আপনমনে অপরূপ সাজে সাজানো পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ঢেউ খেলানো সৌন্দর্য, পাহাড়ি ঝর্ণারাজি দেশ-বিদেশের অনেক আকর্ষণীয় স্থানকেও হার মানাতে পারে। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির চারদিক ঢেউতোলা সবুজের উঁচু পাহাড়ের দেয়াল। মাঝে মাঝে ব্যস্ত ছোট ছোট শহর ও শহরের প্রবেশ পথের দু’পাশে সবুজের বাঁকে-বাঁকে উঁচু-নিচু সর্পিল রাস্তা। অনেক পর্যটকই খাগড়াছড়ি শহরকে ছবিতে দেখা নেপালের কাটমুন্ডু শহরের সাথে তুলনা করে থাকেন।
পাহাড়ের প্রকৃতি প্রতি ঋতুতেই রং বদলায়। বর্ষাকালে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতে বসে নানান রঙের মেলা। পাহাড় ঘেরা চাঁদনী রাতে এখানকার দৃশ্যপটে ভিন্নমাত্রা এনে দেয়। এই পাহাড়ের চূঁড়ায় বসে দূর পাহাড়ের বুক চিরে সকালের সূর্যোদয় আর সন্ধ্যায় সব আলোকে ম্লান করে সূর্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই অপরূপ। নীল আকাশের সাদা মেঘ, সবুজ পাহাড়ের বাঁকে-বাঁকে মেঘের ভেলা, চেঙ্গী নদীর লাল মাটির ঘোলা পানির টানে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে কোন দ্বিধা থাকে না।
আবহমান বাংলার সবুজ প্রকৃতির অপরূপ বৈচিত্র্যের নৈসর্গিক লীলাভূমি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বকোণে এর অবস্থান। বাংলার সুন্দরীকন্যা খ্যাত এই খাগড়াছড়ির উঁচু-নিচু অসংখ্য পাহাড় আর পাহাড়ের বুকে নাম না জানা হাজারো গাছের সবুজ পাতায় সজ্জিত পাহাড়কে মনে হয় যেন সবুজের অভয়ারণ্য। উঁচু-নিচু ঢেউ তোলা সবুজ পাহাড়ের বুকচিরে কালো পিচের সর্পিল রাস্তা আর পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য যে কোন পর্যটকের মন কাড়বে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। মাঝখানে সমতল ভূমি আর চারদিকে ঢেউ তোলা সুউচ্চ পাহাড়, দিগন্ত ছোঁয়া সবুজের সমারোহ, শীতে ফোটা চেঙ্গী নদী তীরের কাঁশফুল ও চন্দ্র সূর্যের রুপালী স্পর্শ, নদী, হ্রদ পাহাড়ি ঝর্ণা সবাইকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আর এখানে এলে যা যা দেখবেন।
সৌন্দর্যের অহংকার খাগড়াছড়ি শহরের প্রবেশ পথ আলুটিলা। জেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এই আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্র। প্রায় হাজার ফুট উঁচু এ ভূ-নন্দন বিন্দুটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম ব্যতিক্রমধর্মী পর্যটন স্পট। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নবোর্ড‘র উদ্যোগে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে দর্শনার্থীদের বসার জন্য পাকা বেঞ্চ, বিশ্রােেমর জন্য পাকা ছাউনি, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ইত্যাদি করা হয়েছে। এ টিলার মাথায় দাঁড়ালে শহরের ছোটখাট ভবন, চেঙ্গী নদীর প্রবাহ ও আকাশের আল্পনা মনকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে তোলে। চোখে পড়ে ঢেউ তোলা সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে সর্পিল রাস্তা। পাহাড়ি জুমিয়াদের ছোটছোট মাচাং ঘর, আর সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি চমৎকার ডাক বাংলোও রয়েছে এখানে। প্রাকৃতিক নৈস্বর্গের এ স্থানটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে এখানে ইকোপার্ক স্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। আলুটিলা থেকে খাগড়াছড়ি শহরকে দেখলে মনে হবে এ যেন কল্পনার দার্জিলিং।
আলুটিলার রহস্যময় গুহা : গা ছমছম করা অনভূতি নিয়ে পাহাড়ি সুরঙ্গ পথ বেঁয়ে পাতালে নামা কল্পনার হলেও আলুটিলার সুরঙ্গ কল্পনা নয় বরং বাস্তব। পাহাড়ের পিচ্ছিল পথ বেঁয়ে গুহার মুখ পর্যন্ত যেতে দর্শনার্থীদের এক সময় খুব কষ্ট হলেও এখন জেলা পরিষদের অর্থায়নে সেখানে পাকা সিঁড়ি করে দেয়া হয়েছে। পাহাড়ের চূঁড়া থেকে ২৬৬টি সিঁড়ি বেঁয়ে নীচে নামলেই সেই স্বপ্নীল গুহামুখ। আলুটিলা সুরঙ্গের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮২ ফুট। ভুতুরে অন্ধকার এ গুহায় আগুনের মশাল নিয়ে ঢুকতে হয় কিছুটা সাহসের সাথেই। গুহার ভেতরে প্রবেশ করলে ভেঁসে উঠে এক অপরূপ প্রতিচ্ছবি। ভেতরে হাজার হজার বাঁদুর ঝুলে থাকার দৃশ্যও চোখে পড়ার মতো।
আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র ও রহস্যময় গুহা থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে রিছাং নামক পাহাড়ি ঝর্ণা। শিরশির ছন্দে হিম শীতল ঝরণার বহমান স্বচ্ছ পানি যে কাউকেই কাছে টানবে খুব সহজেই। মূল সড়ক থেকে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে স্বপ্নের রিছাং ঝর্ণায়। এখানে আগত পর্যটকদের সুবিধার্থে মাটিরাঙ্গা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রবেশ মুখে একটি গেইট নির্মাণ সহ পর্যটকদের জন্য সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কটি গোল ঘর।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়কের কোল ঘেঁষে মাইসছড়ি এলাকার নুনছড়ি মৌজার আলুটিলা পর্বতশ্রেণী হতে সৃষ্ট ছোট্ট নদী নুনছড়ি। নুনছড়ির সমতল ভূমি হতে প্রায় সাতশ’ ফুট উপরে পাহাড়ের চূড়ায় দেবতা পুকুর রূপকথার দেবতার আর্শিবাদের মতোই সলিল বারির স্রোতহীন সঞ্চার। পাঁচ একর আয়তনের এ পুকুরটির স্বচ্ছ জলরাশির মনভোলা প্রশান্তি মুহূর্তের মধ্যে পর্যটকদের উদাসীন করে তুলতে পারে।
হেরিটেজ পার্ক :
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সর্পিল প্রবাহ নিয়ে বয়ে যাওয়া চেঙ্গী নদীর কোলে জেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত হেরিটেজ পার্ক ইতিমধ্যে পর্যটন কেন্দ্রের তালিকায় নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। পর্যটন পিপাসুদের কাছে হেরিটেজ পার্ক হয়ে উঠেছে নতুন ঠিকানা। পর্যটন মোটেলের বিপরীতে সৌন্দর্যম-িত ও নান্দনিক হেরিটেজ পার্কটির অবস্থান। এখানকার প্রকৃতি যেন ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। নানা বয়সী মানুষের ভিড়ে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যায় এখানে বসে রঙের মেলা।
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা থেকে সোজা উত্তরে ভারতের সীমান্তবর্তী ভগবান টিলা। জেলা সদর থেকে উত্তর পশ্চিমে এর কৌণিক দূরত্ব আনুমানিক ৮৫ কিলোমিটার। সবুজের বুকচিরে ভিতর আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এগোলে পাহাড়ের অপরূপ নৈস্বর্গের অপলক নেত্র ততই বিস্ময় বিহবল হবেই। এ টিলা যেন বিধাতার নিজ হাতে গড়া পর্বত রূপসী। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক হাজার ছয়শ’ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এ টিলা সম্পর্কে স্থানীয়দের ধারণা, এ টিলার উপরে দাঁড়িয়ে ডাক দিলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও ঐ ডাক শুনতে পান। আর এ কারণেই প্রাচীন লোকজন এ টিলার নামকরণ করেছিলেন ভগবান টিলা। সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি’র একটি আউট পোস্টও রয়েছে এখানে। বিজিবি‘র সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে দাঁড়ালে মনে হয় আপন অস্তিত্ব শূন্যে হারিয়ে গেছে। সবুজে ঘেরা বাঁশের ঝোঁপ, নাম না জানা নানান ধরনের পার্থিব ডাক আর পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার কলকল জীবন্ত শব্দ সবকিছু মিলিয়ে হারিয়ে যাওয়ার এক অনন্য স্বপ্নপূরী ‘ভগবান টিলা’।
রামগড় চা বাগান:
জেলার রামগড়ে সীমান্ত ঘেঁষে খাগড়াছড়ি জেলায় প্রবশের সম্মুখভাগে খাগড়াছড়ি-ফেনী আঞ্চলিক মহাসড়কের সড়কের দু’ধারে গড়ে উঠেছে বিশাল চা বাগান। যা খাগড়াছড়ির পর্যটন শিল্পকে করেছে স্বয়ং সম্পূর্ণ। খাগড়াছড়িতে আসা ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের স্বাগত জানাতে এটি সদা প্রস্তুত। বিশাল এলাকা জুড়ে এই চা বাগানে আসলে পর্যটকরা বুঝতেই পারবে না তারা চা বাগানের ভূমি খ্যাত সিলেট আছেন না পাহাড়ী কন্যা খাগড়াছড়িতে।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর হতে ৫০ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে খাগড়াছড়ির প্রবেশদ্বার রামগড় উপজেলা। উপজেলা পরিষদের সম্মুখভাগে ইংরেজি অর ডব্লিউ-এর অনুরূপ প্রায় ২৫০ মিটার লম্বা একটি হ্রদ। এতে আনন্দ ভ্রমণের জন্য রয়েছে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি প্রমোদ তরী। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভুইয়া‘র পরিকল্পনায় গড়ে তোলা রামগড় পর্যটন লেকটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন। চারপাশ বাঁধানো লেকটি রেলিং ঘেরা এবং বাহারি সাজে সজ্জিত। লেকের উভয় পাশে যোগাযোগের জন্য মাঝখানে রয়েছে সুদৃশ্য ঝুলন্ত সেতু ।
খাগড়াছড়ি-ঢাকা সড়কের খাগড়াছড়ি জেলার প্রবেশমুখ মানিকছড়ি উপজেলা সদরে রয়েছে খাগড়াছড়ির অন্যতম দশর্নীয় স্থান মানিকছড়ি রাজবাড়ি। রাজবাড়িতে রয়েছে মংসার্কেল চীফ (মংরাজা)‘র রাজত্বকালীন স্থাপত্য। রাজার সিংহাসন, মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক স্মৃতি বিজড়িত এই রাজবাড়ী। নানাদিক থেকে দর্শনীয় হলেও মংরাজার উত্তারাধিকার সূত্র নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ ও জটিলতার কারণে রাজবাড়িটি আজ চরম অবহেলিত। আপনার ভ্রমণ পিপাসা মিটাতে পারে মানিকছড়ির রাজবাড়ি।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরের খুব কাছাকাছি আলুটিলা-বটতলী এলাকায় এ প্রাচীন শতায়ু বর্ষী বটবৃক্ষটি শুধু ইতিহাসের সাক্ষী নয় এ যেন দর্শনীয় আশ্চার্যের কোন উপাদান। পাঁচ একরের অধিক ভূমির উপরে এ গাছটি হাজারো পর্যটকের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। মূল বটগাছটি থেকে নেমে আসা প্রতিটি ঢালপালা মাটিতে মিশে কালের পরিক্রমায় এক একটি নতুন বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ঢালাপালা থেকে সৃষ্ট প্রতিটি বটগাছ তার মূলগাছের সাথে সন্তানের মতো জড়িয়ে আছে আপন মমতায়।
অপার সৌন্দর্যের আরেক নাম শিবছড়ি পাহাড়। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৬ কি.মি. দূরে দেওয়ানপাড়া এলাকায় অবস্থিত ‘শিবছড়ি পাহাড়’। পাহাড়ী ছড়া, নালা আর গভীর অরণ্য পেরিয়ে বোয়ালখালী নদীর পাশ ঘেঁষে সুউচ্চ পাহাড়ি ঝর্ণা ও সৌন্দর্যম-িত বিভিন্ন পাথরের রূপ পর্যটকদের আকৃষ্ট করবেই।
সবমিলিয়ে খাগড়াছড়ির সৌর্ন্দয আপনাকে হাত ছানি দিয়ে ঢাকছে। প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযকে কাজে লাগাতে পারলে খাগড়াছড়ি হতে পারে দেশের পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেই সাথে দেশের অর্থনৈতিক চেহারা পাল্টে যাবে। প্রয়োজন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও পাহাড়ী-বাঙ্গালী মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস।