হামাসের পক্ষে আরব জনগন, শাসকরা বিপক্ষে
[ ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের প্রতিরোধ আন্দোলন নিয়ে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলো বেশ চাপের মুখে পড়েছে। কাতার ও তুরস্ক হামাসের পক্ষে দাড়ালেও নীরব রয়েছে সৌদি আরব, কুয়েত, আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো। বেশ কিছু গনমাধ্যমে হামাসকে নিরস্ত্র করতে ইসরাইলের সাথে মিশর ও সৌদি আরবের যোগাযোগের খবর প্রকাশ হয়ে পড়লে দেশের ভেতরে ও মুসলিম বিশ্বে বেশ নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে সৌদি আরব। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আরব শাসকদের তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি সৌদি একটি জনমত জরিপ সংস্থা রাকিন ফাউন্ডেশন গাজায় ইসরাইলি হামলার ব্যাপারে সৌদি নাগরিকদের মতামত জানার চেষ্টা করেছে। এই জরিপে সৌদি আরবের ৯৫ শতাংশ মানুষ হামাসের যুদ্ধকে সমর্থন করেছেন। ধারনা করা যায় অন্য আরব দেশগুলোর চিত্র একই রকম। আরব দেশগুলোর সাধারন মানুষের অনুভুতি আর শাসকদের ভুমিক বিশ্লেষন করেছেন আনীকাহ নাওয়ার ]
অনলাইন সংবাদ মাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের এডিটর ডেভিড হার্স্ট সম্প্রতি হাফিংটন পোস্টে অ্যাটাক অন গাজা বাই সৌদি রয়েল অ্যাপয়ন্টমেন্ট শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। হার্স্ট ইসরাইলি কর্মকর্তাদের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন গাজায় হামলার জন্য সৌদি আরবের যে সমর্থন আছে তা ওপেন সিক্রেট।
উদহারন হিসাবে তিনি চ্যানেল টেন এ সাবেক ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী শাউল মোফাজ এর বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি বলেছিলেন হামাসকে নিরস্ত্র করতে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের সুর্নিদিষ্ট ভুমিকা আছে। গাজা পুর্নগঠনে সৌদি আরব ও আমিরাত অর্থ সহায়তা দেবে তখনই যখন হামাস নিস্ক্রিয় হয়ে পড়বে। আমস গিলাদ নামে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের একজন কর্মকর্তার বক্তব্য তুলে ধরেন হার্স্ট। ইসরাইলি এই কর্মকর্তা মন্তব্য করেছিলেন মিশর ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে চমৎকার নিরাপত্তা সর্ম্পক রয়েছে। সব কিছু গোপন সমঝোতার মাধ্যমে হচ্ছে কোনো কিছু প্রকাশ্য নয়। আরব দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা সর্ম্পকের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। হার্স্ট তার প্রবন্ধে জানান ইরানকে কিভাবে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে সৌদি ্ও ইসরাইলি গোয়েন্দারা নিয়মিত বৈঠক করেন। তিনি লিখেছেন সৌদি আরবের চোখে এখন শত্রু বা প্রতিদ্বন্দী হচ্ছে ইরান, তুরস্ক, কাতার, গাজায় হামাস আর মুসলিম ব্রাদারহুড। আর দেশটির সহযোগী হচ্ছে মার্কিন ও বিট্রিশ মিলিটারি স্টাবলিশমেন্ট এবং গাজা নিয়ন্ত্রনে নেয়ার জন্য উদগ্রীব মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ফাতাহ নেতা মোহাম্মাদ দাহলান।
সৌদি বাদশাহর ভাইয়ের ছেলে প্রিন্স তুর্কী একজন ইসরাইলি গবেষকের বই প্রকাশের অনুমতি প্রদান করেছেন যার মাধ্যমে সৌদি আরবের সাথে ইসরাইলের সর্ম্পক প্রকাশ্য হয়ে উঠে। এছাড়া তিনি সাবেক ইসরাইলি গোয়েন্দা প্রধান আমুস ইয়াদলিনের সাথে ব্রাসেলসে বৈঠক করেন। এই জেনারেলের বিরুদ্ধে গাজায় সংহতি প্রকাশের জন্য মাভি মারমারা নামে তুরস্কের জাহাজে হামলার অভিযোগ আছে। প্রিন্স তুর্কী ইসরাইলি পত্রিকা হার্তেজ এ ফিলিস্তিনের সাথে ইসরাইলের শান্তিপূর্ন সহবস্থান নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
ডেভিড হার্স্টের এই প্রবন্ধের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব। লন্ডনে সৌদি রাষ্ট্রদূত প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফ দুই পৃষ্টার প্রতিবাদপত্রে বলেছেন হার্স্ট লন্ডনে বসে কল্পনাপ্রসূত এই প্রবন্ধ লিখেছেন। যার সাখে বাস্তবতার কোনো সর্ম্পক নেই। প্রতিবাদপত্রে বলা হয় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্টা ও দখলভুমি উদ্ধারের দাবি সমর্থন দিয়ে আসছে। প্রিন্স নায়েফ গাজায় ইসরাইলের বর্বর হামলাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে উল্লেখ করেন। এতে আরো বলা হয় ফিলিস্তিনিরা আমাদের ভাই ও বোন। তাদের পাশে সৌদি আরব আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
সৌদি আরব এসব খবরের প্রতিবাদ করলেও সাধারন মানুষের মনে সৌদি ভুমিকা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সৌদি আরবের তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে সৌদি আরব হামাসের লড়াইয়ে কোনো ধরনের সমর্থন দিচ্ছে না। বরং মিশর গাজার জন্য যে সঙ্কট তৈরি করছে তা দূর করতে কোনো উদ্যেগ নেয়নি। মিশর গাজার সাথে যোগাযোগের একমাত্র স্থলভ’খন্ড রাফা ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে। ইসরাইলের সেনাদের মতো মিশরীয় সেনাবাহিনী সীমান্তের টানেলগুলো ধ্বংসের অভিযানে নেমেছে। ফলে গাজায় মানবিক বিপর্যয় আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। ইসরাইলের সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পর মিশরের পক্ষ থেকে একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো। হামাস তা প্রত্যাখান করে। কারন হামাসের দাবি হচ্ছে গাজার ওপর থেকে ইসরাইলের অবরোধ প্রত্যাহার করা। জেনারেল সিসির প্রস্তাবে এর কোনো উল্লেখ ছিলো না। এ প্রস্তাব হামাস প্রত্যাখান করে একে ইসরাইলের কাছে আতœসমর্পনমুলক বলে উল্লেখ করে। ধারনা করা হয় সৌদি আরব ও ইসরাইলের সাথে আলোচনা মিশর এই প্রস্তাব দিয়েছিলো। অথচ এই প্রস্তাব দেয়ার আগে হামাসের কোনো আলোচনা করা হয়নি।
হামাসের ব্যাপারে সৌদি আরবের মনোভাব যে নেতিবাচক তা অস্পষ্ট কোনো বিষয় নয়। হামাসের সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ট সর্ম্পক রয়েছে। মিশরে মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই সর্ম্পক আরো ঘনিষ্ট হয়। গাজার মানুষ নতুন করে আশার আলো দেখেছিলো। ২০০৭ সাল থেকে ইসরাইলের অবরোধ আরোপের পর থেকে গাজার মানুষের জীবন যাপন যখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো সে সময় মুরসি ক্ষমতাসীন হয়ে এই দুর্ভোগ অনেকটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করেন। গাজার সাথে মিশরের যোগাযোগের পথ রাফাহ ক্রসিং অনেকটা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সৌদি সমর্থনের জেনারেল সিসি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাফাহ ক্রসিং দিয়ে যোগাযোগ ও পন্য পরিবহন সীমিত করে দেয়া হয়। গাজার সাথে সিনাইয়ের মধ্যে যোগাযোগের টানেলগুলো গুড়িয়ে দেয় মিশরের সেনাবাহিনী। প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে জেনারেল সিসিকে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলো। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তা দেয়া হযেছে মিশরকে। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতসহ উপসাগরীয় দেশগুলোতে মুসলিমব্রাদারহুড সমর্থকদের ওপর নিপীড়ন চালানো হয়। অনেককে আবার ১০ থেকে ১৫ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়।
সৌদি আরব ও মিশরের জেনারেল সিসি হামাসকে নিরস্ত্র করার ইসরাইলি প্রচেষ্টায় যোগ দিলেও সাধারন আরবরা হামাসের লড়াইকে সমর্থন করছে। সৌদি আরবে জনমত জরিপ করে এমন একটি সংস্থার জরিপে দেখা যায় দেশটির ৯৫ শতাংশ নাগরিক ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধকে সমর্থন করেন। ৩ শতাংশ মাত্র দ্বিমত পোষন করেছেন। ২০০০ সৌদি নাগরিকের মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়েছিলো। ৮২ শতাংশ মানুষ হামাসের রকেট নিক্ষেপ সমর্থন করেছেন। ১৪ শতাংশ এর বিরুদ্ধে মত দেন। দুই তৃতীয়াংশ লোক ইসরাইলের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর পক্ষে মত দেন। ৮৬ শতাংশ সৌদি নাগরিক হামাসের আন্দোলনকে সমর্থন করেন। ৪ শতাংশ লোক মনে করেন মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সর্ম্পকিত এই সংগঠনের ভিন্ন এজেন্ডা আছে। আর ১ শতাংশ মনে করেন হামাস ইসরাইলের পক্ষের একটি শক্তি। এই জরিপে এক তৃতীয়াংশ সৌদি নাগরিক ইসরাইলের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে মত দেন। এক পঞ্চমাংশ লোক কোনো মত দেননি।
এসব জনমত জরিপ থেকে স্পষ্ট যে সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর হামাস বিরোধী অবস্থানে সাধারন মানুষ সন্তুুষ্ট নয়। এসব দেশের শাসকরা শুধু বাইরে ইমেজ সঙ্কটে পড়ছে না দেশের ভেতরে এক ধরনের চাপ রয়েছে। যদিও এসব দেশে সাধারন মানুষের মতামতের তেমন কোনো মূল্য নেই। কিন্তু সাধারন মানুষের এই সমর্থন থেকে স্পষ্ট হামাস ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে বাদ দিয়ে আরব বিশ্বে কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।