জামায়াত নিষিদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত সংগঠনকে নিষিদ্ধ এবং ভবিষ্যত্ কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিধান রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এই সংশোধনী হলে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ওঠা সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিচারের বাধা দূর হবে বলে মনে করছেন বিচারসংশ্লিষ্টরা। সংগঠনটির বিরুদ্ধে ওই অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। তবে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে এসে থেমে আছে।
সংশোধনের খসড়া অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ওই নামে বা অন্য নামে কার্যক্রম চালাতে পারবে না। সমপ্রতি এই খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরপরই খসড়াটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে। এটি হবে এ আইনের চতুর্থ দফা সংশোধন। এই সংশোধনের কার্যকারিতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে।
এ বিষয়ে সমপ্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে অপারগতা জানান। এর কয়েক দিন আগে তিনি স্থানীয় একটি দৈনিককে বলেছিলেন, এ বিষয়ে ঈদের পর বলবেন এবং যা করা হবে, সবাইকে জানিয়েই করা হবে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, খসড়ায় বিদ্যমান আইনের ১০টি ধারায় সংশোধনের প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি ধারায় কেবল ব্যক্তি শব্দের পাশাপাশি সংগঠন শব্দটি বসেছে। খসড়ার ২০ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল দোষী সাব্যস্ত সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবেন এবং এর নিজ নামে বা অন্য কোনো নামে ভবিষ্যত্ কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। পাশাপাশি মামলার বিষয়বস্তু সাপেক্ষে সংগঠনটির সদস্যদেরও ট্রাইব্যুনাল সাজা দিতে পারবেন। বিদ্যমান আইনের ২০ ধারায় কেবল ব্যক্তির সাজার বিধান রয়েছে।
খসড়ায় ৪ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, কোনো সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটি অথবা কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক বা স্থানীয় কমিটির সদস্য যদি অপরাধ করেন, তবে ওই অপরাধের জন্য সদস্যের পাশাপাশি সংগঠনও দায়ী হবে। ১০ ধারায়ও একটি পরিবর্তন আনা হচ্ছে। খসড়া অনুসারে, সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলার বিচারের ক্ষেত্রে অন্যান্য মামলার মতোই ট্রাইব্যুনাল তার কার্যপ্রণালী বিধিমালা অনুসারে অভিযোগ গঠন, দোষী সাব্যস্তকরণ ও রায় ঘোষণা করবেন।
২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের প্রথম দফা সংশোধনীতে কয়েকটি স্থানে পরিবর্তন এনে মূলত হালনাগাদ করা হয়েছিল। ২০১২ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীতে আসামির অনুপস্থিতিতে তাকে পলাতক ঘোষণা করে বিচার এবং এক ট্রাইব্যুনাল থেকে আরেক ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তরের বিধান যুক্ত করা হয়। এরপর সংশোধনী আনা হয় ২০১৩ সালে। ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তখন তার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। ওই সময়ের আইনে দণ্ডের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ ছিল না। পরে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষেরও আপিলের সুযোগ রেখে ওই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি আইনটির তৃতীয় সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়।
ওই সংশোধনীতে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক ক্ষমতা-সংক্রান্ত আইনের ৩ ধারায় ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠন শব্দটি যুক্ত করা হয়। তবে দোষী সাব্যস্ত সংগঠনের শাস্তি, সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনার পদ্ধতি অথবা সংগঠনের সদস্যদের দায়-দায়িত্বসংক্রান্ত বিষয় সেখানে উল্লেখ ছিল না।
গত বছরের ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান) সংগঠনের বিচারের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালস আইনের দুর্বলতা নিয়ে পর্যবেক্ষণ দেন।
এতে বলা হয়, মূল আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীকে বিচারের সম্মুখীন করার বিধান করা হলেও কোনো দল মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হলে তাকে কী ধরনের দণ্ড ও সাজা প্রদান করা হবে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। আমার নিঃসংকোচ অভিমত এই যে, ওই আইনে মানবতাবিরোধী কোনো দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে, সেই দলের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দণ্ড আরোপের বা গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিধান করা প্রয়োজন। এদিকে গত বছরের আগস্ট থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। চলতি বছরের ২৫ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়। এরপর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনার প্রস্তুতি শুরু করে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে ২৯ মে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের বিদ্যমান আইনে সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিধান নেই। এরপর ওই অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে এসে থেমে যায়।
জামায়াতের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, সরকার জামায়াতের বিচার করতে চায় না বলে টালবাহানা শুরু করেছে। এরপর মন্ত্রণালয় ট্রাইব্যুনালস আইন সংশোধনের কাজ শুরু করে।