প্রবাসে ঈদ

East London Mosqueমোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম : বাঙালী ঘর ছেড়ে বাইরে, বিশেষ করে ইউরোপে যেতে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। যুদ্ধের ধকলে ইউরোপ তখন পুরোপরি বিধ্বস্ত, পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে ইউরোপের অনেক দেশ। তখন খালাসীরা জাহাজের চাকুরী নিয়ে বিলেতে পাড়ি জমাত আর জাহাজ থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিত ভিনদেশে। আশ্রয় জুটতে বেগ পেতে হত না কেননা,  সেসব দেশে লোকের প্রয়োজন ছিল প্রচুর। আজকের ইংল্যান্ডে যে সিলেটি লোকদের দেখা যায় তাদের পূর্বপুরুষেরা মূলতঃ জাহাজের খালাসী ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার এক দশক পরে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারগুলো উন্মুক্ত হলে প্রচুর বাংলাদেশী সেসব দেশে শ্রমিক হয়ে চলে যায়। এরা অবশ্য খন্ডকালীন অভিবাসী, কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তারা স্বদেশেই ফিরে আসবে। তেলের খনিগুলো আবিস্কৃত হবার পরে একসময়কার মরুভূমির দরিদ্র দেশগুলো পেট্রোডলারে চকচক করে ওঠে। সেখানে মেধার কাজগুলো পায় সাদারা আর কায়িক পরিশ্রমের কাজগুলো দেয়া হতো কালোদের।
বাঙ্গালীরা প্রথম বিলেতের মাটিতে ঠিক কবে পা রেখেছিলেন-এর সঠিক তথ্য আজো জানা যায়নি। অনেকের মতে, সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য ইতিহাসের আলোকজ্জল স্থান লাভকারী রাজা রামমোহন রায় বিলেতের মাটিতে পা রেখেছিলেন ১৮৩০ সালে। তবে, এরও প্রায় ২১ বছর আগে ১৮০৯ সালে পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে সৈদ আলী নামের একজন সিলেটী যুবক বৃটেনে গিয়েছিলেন বলে রবার্ট লিন্ডসের লেখায় পাওয়া যায়। লিন্ডসে ছিলেন সিলেটে বৃটিশ কালেক্টর। জাহাজের চাকুরী নিয়ে বিলেত গেলেও পরবর্তীতে দীর্ঘদিন স্কট ল্যান্ডের বলক্যারেসে রবার্ট লিন্ডসের বাড়ীতে পাচক(কুক) হিসেবে অবস্থান করেন সৈদ আলী।
প্রবাসীর কথা গ্রন্থে, লেখক নূরুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন,  দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) পর বিলেতে বহিরাগমন শুরু হয়। তবে, ভারত উপমহাদেশ থেকে বিদেশ যাত্রা শুরু হয় শতাধিক বছর পূর্বে। তখন, প্রধানত,সিলেট, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষীরা কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে জাহাজে চাকুরি নিয়ে বিদেশে যেত। জাহাজ ছেড়ে তাদের অনেকেই উঠে পড়েন রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, নিউইয়র্ক প্রভৃতি বড় বড় বন্দরে। তবে, বড় আকারের বিদেশ যাত্রা শুরু হয় শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। তখন, গন্তব্যস্থল ছিল বিলাত। সে সময় মহাযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত বৃটিশ কলকারখানার পুন:নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ছিল হাজার হাজার শ্রমিকের। তাই, বিলেত অবস্থানরত সিলেটী জাহাজীদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের আতœীয়-স্বজন দলে দলে ছুটে যান লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেষ্টার, ব্রাডফোর্ড ইত্যাদি শিল্প নগরীতে। ফলে বিলেতে আজ প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আর এদের শতকরা ৯৫ জন হচ্ছেন সিলেটী।
গ্রন্থটিতে লেখক রোমান স¤্রাট জুলিয়াস সিজারের ডায়েরীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘দেশটি পাহাড়ী ও বনে জঙ্গলে ভরা। তরিতরকারী ও কিছু গম উৎপাদন ছাড়া এদের তেমন কোন ফসল নেই।’ তবে, বর্তমানে বৃটেনের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বন জঙ্গলের পরিবর্তে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন অনেক শহর। সেখানে এখন দেখা মেলে, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠের। সিলেটের মতো বিলেতের সোয়ানসি, স্কটল্যান্ডসহ অনেক এলাকায় পাহাড়-টিলা এমনকি বিস্তৃত বনাঞ্চলও দেখা যায়। এসব এলাকার প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম। তাই তো বৃটিশরা এখন গর্ব ভরে বলেন, মহারানীর সবুজ ও মনোরম ইংল্যান্ড।
কালক্রমে বিলেতে এখন সিলেটী  প্রবাসী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বসবাস। বিলেতের বিভিন্ন শহরে সিলেটীদের রয়েছে-আলাদা পরিচিতি। পূর্ব লন্ডন, বার্মিংহাম, অক্সফোর্ড, ব্রাডফোর্ড, কার্ডিফ, ম্যানচেষ্টার, সোয়ানসি, ব্রিস্টল, স্কটল্যান্ডের এডিনবরা, ইনভারনেস, নাইরন, আবাডিন- তো মাতিয়ে রেখেছেন সিলেটীরাই। পূর্ব লন্ডনের ‘বাংলা টাউন’, হোয়াইট চ্যাপেল হলো সিলেটীদের মিলনস্থল। এসব স্থানে গেলে ‘খাঁটি’ সিলেটী ভাষায় কথোপকথনের সে আস্বাদ পাওয়া যায়, তা সিলেটেও সচরাচর চোখে পড়ে না। যে সব সিলেটী প্রবাসী পূর্ব লন্ডন ও এর আশ-পাশের এলাকায় বসবাস করেন-তারা কাজের ফাঁকে কিংবা ছুটির দিনে একবার বাংলা টাউন কিংবা হোয়াইট চ্যাপেলে না এলে যেন তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়।
বলতে গেলে, বিলেতে সিলেটী প্রবাসীরা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। সিলেটের বিশ্বনাথের অধিবাসী রোশনারা আলী বর্তমানে বৃটিশ হাউজ অব কমন্সের সদস্য। টাওয়ার ট্যামলেটস কাউন্সিলের দুই দুই বারের নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান বালাগঞ্জের অধিবাসী। জগন্নাথপুরের আনোয়ার চৌধুরী বর্তমানে পেরুর বৃটিশ রাষ্ট্রদূত। এর আগে তিনি বাংলাদেশে বৃটিশ রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সিলেটের এ রকম আরো অনেকে যুক্তরাজ্যের মেইনস্ট্রীম রাজনীতি, চাকুরী এমনকি ব্যবসার সাথে জড়িত। তাদের সক্রিয় কার্যক্রমে বিলেতে উজ্জ্বল হচ্ছে আমাদের মুখ।
আর সেখানকার রেস্টুরেন্ট ব্যবসা তো সিলেট প্রবাসীদের হাতের মুঠোয়। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে সবমিলিয়ে গড়ে উঠেছে প্রায় ১৬ হাজার রেস্টুরেন্ট। এসব রেস্টুরেন্ট যদিও ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট হিসাবে পরিচিত পেয়েছে। কিন্তু, এসব রেস্টুরেন্ট পরিচালনার মূল দায়িত্বে রয়েছেন সিলেটী প্রবাসীরা।
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই সিলেট প্রবাসীরা। পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় অবস্থিত ইস্ট লন্ডন মসজিদ বর্তমানে ইউরোপের একটি বৃহৎ মসজিদ। এ মসজিদে সপ্তাহে প্রায় ৩৫ হাজার মুসল্লী নামাজ আদায় করেন। ইস্ট লন্ডন মসজিদের আরো দুটি প্রকল্প হচ্ছে লন্ডন মুসলিম সেন্টার(এলএমসি) ও মরিয়ম সেন্টার। ইস্ট মসজিদের লাগোয়াই এ দুটি প্রকল্পের অবস্থান। এলএমসিতে রয়েছে-মাল্টিপারপাস হল, সেমিনার স্যুট, একটি নার্সারী, ক্লাস রুম, ফিটনেস সেন্টার, ছোট একটি ইসলামিক লাইব্রেরী, রেডিও স্টেশন,রিটেইল ইউনিট এবং অফিস স্পেস। পাশাপাশি মরিয়ম সেন্টারে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা রয়েছে। ইস্ট লন্ডন মসজিদের পাশাপাশি ব্রিকলেনসহ বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন শহরেও রয়েছে আরো প্রায় শতাধিক মসজিদ। এসব মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পাশাপাশি শিশুদের মক্তব শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
২০১১ সালে এবং ২০১৩ সালে আমার যুক্তরাজ্য ভ্রমনের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে দুটি ঈদ করারও সৌভাগ্য হয় আমার। প্রবাসীদের দেশের প্রতি যে কি রকম টান-তা ঈদ এলে বোঝা যায়। ঈদ এলে তাদের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মতো ব্যস্ততা বেড়ে যায়। যদিও বাংলাদেশের মানুষের মতো প্রবাসীদের এতো সাচ্ছ্যন্দে ঈদ উদযাপনের সুযোগ নেই; কেননা, তাদের জন্য ‘ছুটি’ একটি বড় বাধা। এমনিতেই, দেশে অবস্থানরত স্বজনদের কাছে তারা হরহামেশা প্রেরণ করেন রেমিট্যান্স। তবে, ঈদ মওসুমে রেমিট্যান্স প্রেরণের পরিমাণ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আয়-রোজগার করে হোক কিংবা ধার কর্জ করে হোক-ঈদে স্বজনদের কাছে টাকা পাঠানো  চাই-ই চাই। এজন্য মানি এক্সচেঞ্জসমূহে প্রবাসীদের দীর্ঘ লাইন পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ দেশে অবস্থানরত স্বজনদের সাথে তারা ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি চান না। অনেকে আবার প্রাণের টানে উড়াল দেন দেশের মাটিতে। ঈদ উদযাপন করেন প্রিয়জনের সাথে।
যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় জামাত হয় পূর্ব লন্ডন মসজিদে। সেখানে পর পর ৬টি জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সোয়া ৭টা থেকে জামায়াত শুরু হয়। মাঝখানে বিরতি দিয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জামাত। জামাতে মসজিদের প্রতিটি ফ্লোর থাকে লোকে লোকারণ্য। এদিন ঈদের জামায়াতের জন্য গাড়ি পার্র্কিংয়ের জন্য কিছুটা শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। যুক্তরাজ্যে ঈদে সরকারি ছুটি না থাকায় জামায়াত আদায়ের  পর অনেকেই চলে যান কর্মস্থলে। আবার যাদের সাপ্তাহিক অফ(বন্ধ) থাকে তারা ঈদ উদযাপন করেন প্রিয়জনের সাথে।
মসজিদের পাশাপাশি আবহাওয়া অনুকুল হলে বিভিন্ন পার্কে আয়োজন করা হয় ঈদ জামাতের। ঈদের জামাত শেষে কোলাকুলি একটি চিরচেনা দৃশ্য। ঈদ উপলক্ষে বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাসমূহে সৃষ্টি হয় বিশেষ আমেজের। বিভিন্ন বয়েসী মানুষ নতুন জামা-কাপড় পরে শরীক হন ঈদ জামাতে। নতুন জামা পড়ে ছোট্ট শিশুদের জটলা সকলকে আকৃষ্ট করে। চ্যানেল এস, বাংলা টিভিসহ বাংলা চ্যানেলগুলো ঈদ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে।
বাংলাদেশের মতো সেখানেও ঈদ উপলক্ষে পিঠা-পুলির আয়োজন করা হয়। এখানকার মতো পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা স্বজনদের বাসায় বেড়ানোর রেওয়াজ রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে বাঙালি মার্কেটগুলোতেও কাপড়-কেনাকাটার দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ঈদের জামায়াত আদায়ের পর অনেকেই দেশে অবস্থানরত স্বজনদের সাথে টেলিফোনে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
বৃটেনের বাণিজ্যিক শহর (দ্বিতীয় শহর) খ্যাত বার্মিংহামেও সিলেট প্রবাসীদের আধিক্য রয়েছে। শহরটি পূর্ব লন্ডনের মতো ‘ঘিঞ্জি’ না হওয়ায় অনেকেই সেখানে বসবাস করতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। সেখানেও বিশালকারের বেশ কয়েকটি মসজিদ রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের এমনও এলাকা আছে, যেখানে প্রবাসীরা মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে জুমার নামাজ কিংবা ঈদের জামাত আদায় করেন। স্কটল্যান্ডের নাইরন এলাকায় বসবাসরত মুসলমানদের মসজিদের সুব্যবস্থা না থাকায় অনেকে ১৬ মাইল দূরে ইনভারনেস মসজিদে জুমা এবং ঈদের জামাত আদায় করেন। ওই এলাকার বাসিন্দারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং জুমার নামাজ আদায়ের জন্য একটি হল ভাড়া করেছিলেন। বর্তমানে তারা অর্থ সংগ্রহ করে নিজেরাই একটি মসজিদ গড়ে তুলেছেন।
ঈদ উপলক্ষে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসলিম সম্প্রদায়কে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
ঈদ উপলক্ষে প্রতি বছর অনেক প্রবাসী দেশে ছুটে আসেন। তারা দেশে প্রিয়জনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন। আর যারা দেশে আসতে পারেন না, তাদের দেশে না আসার বেদনা সব সময় তাড়িত করে।
সবমিলিয়ে, আনন্দ-বেদনার মিশেলে প্রবাসীরা উদযাপন করেন পবিত্র উৎসব ঈদ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button