গ্রিসে বেকার হয়ে পড়েছেন ৪০ হাজার বাংলাদেশী

Greceআতাউর রহমান মিলন: গ্রিসে অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয়েছেন প্রায় ৪০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী। বিভিন্নভাবে ও নানা পথে ইউরোপের অনেক দেশে অবৈধভাবে প্রবেশকারী বাংলাদেশীরা এখন কর্মহীন। তবে গ্রিসে কর্মহীনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ঠিক কতজন বাংলাদেশী গ্রিসে কর্মহীন ও কপর্দকশূন্য তার সঠিক হিসাব বাংলাদেশ মিশনে নেই। অবৈধ পথে গিয়ে নানা কৌশলে তারা ওয়ার্ক পারমিট সংগ্রহ করেন। তার পর চেষ্টা করেন অভিবাসী হওয়ার। গ্রিস অভিবাসী বাংলাদেশী আবদুল কাদের, আজিজ উদ্দীন, রহমত, শাহাদত দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশীদের করুণ অবস্থা জানিয়েছেন।
গ্রিসের এথেন্স নগরীর ব্যবসায়ী বাংলাদেশী অভিবাসী এন আই খান ও চৌধুরী মহব্বত জান টেলিফোনে জানান, গ্রিস ও ইতালিতে অবৈধ বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এর মধ্যে অবৈধ ৪০ হাজারের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তাদের পাসপোর্ট পর্যন্ত নেই। কাজ নেই। আয়-ইনকাম নেই। অনেকে ঠিকমতো খেতেও পান না, রাস্তায় ঘুমান। গ্রিসের অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশীরা ফ্রান্স ও জার্মানি যাওয়ার চেষ্টা করছেন হরহামেশা। কিন্তু বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ফ্রান্স ও জার্মানির আইন কঠিন হওয়ায় চেষ্টা করলেই ধরা পড়ছেন। জেলে যাচ্ছেন বাংলাদেশীরা। এত দুর্দশার পরও দালালদের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশীদের লাখ লাখ টাকা খরচ করে ইউরোপ আসা বন্ধ হয়নি।
গ্রিস অভিবাসী হাসান আলী জানান, মন্দার কারণে গ্রিসেরই ৪০ শতাংশ মানুষের চাকরি নেই। তারা খরচ কমিয়ে দিয়েছেন। গ্রীষ্মকালজুড়ে যেসব ‘কার্নিভাল’ (মেলা) হয়, সেখানে বাঙালিরা খেলনা, ছাতা, পপকর্ন, আইসক্রিম ও ফুল বিক্রি করতেন। এখন এসব কেনাকাটা কমেছে। এ ছাড়া পুলিশি তাড়াও আছে। কৃষিখামার, কসাইখানা ও শূকরের খামারেও চাকরি মিলছে না। বৈধ অভিবাসীর কাগজপত্র ছাড়া কোনো কাজ মিলছে না বাংলাদেশীদের।
প্রবাসী বাংলাদেশীরা গ্রিসে এমনই সঙ্কটে পড়েছেন যে তারা পাসপোর্ট নবায়ন করার মতো অর্থও পাচ্ছেন না। হাতে লেখা পাসপোর্ট নবায়ন করে মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) জন্য ফি ছিল ৮৫ ইউরো। গ্রিসের বাংলাদেশ দূতাবাস এই ফি কমিয়ে ৫৫ ইউরো করেছে। এথেন্সের ব্যবসায়ী এন আই খান আরো বলেছেন, গ্রিস ও ইতালিতে প্রায় ৫০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশী আছেন। এসব দেশের নতুন ইমিগ্রেশন আইনে তারা সহজে বৈধ হতে পারবেন না। বৈধ হতে পারলে ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি যেতে পারবেন। এসব দেশে বাংলাদেশীদের কাজের অভাব নেই।
অভিবাসী ফজল হোসেন, সাত্তার, মানিক, মোহন লাল ও বাদশা বলেছেন, আর্থিক মন্দার কারণে গ্রিসের নাগরিকেরা বাধ্য হয়ে তারা ‘অড জব’ করছেন। আগে বাঙালি, ভারতীয় ও আফ্রিকানরা এসব ‘অড জব’ করতেন। ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি বিভিন্ন দেশে মওসুমি কাজ করতে যাওয়ার সুযোগ ভারতীয় ও আফ্রিকানদের থাকলেও বাংলাদেশীদের কাগজপত্র না থাকায় ওই সব দেশে যেতে পারছেন না। কাজেই হাজার হাজার বাংলাদেশী গ্রিসে মহাসঙ্কটে পড়েছেন।
গ্রিসে অবৈধ বাংলাদেশী আবু বক্কর, হোসেন আলী ও নবিরুল জানান, তারা জীবনবাজি রেখে সাগর পাহাড় পাড়ি দিয়ে গ্রিস এসেছেন। তারা এভাবে আসতে পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের পাসপোর্ট করে দিতে পারছে না। তবে কিছু হৃদয়বান বাংলাদেশী তাদের আর্থিক ও আইনগত সহযোগিতা করছেন। বাংলাদেশীদের দালালদের খপ্পরে পড়ে টুরিস্ট ভিসা ও বিভিন্ন পন্থায় ইউরোপের দেশে না আসার অনুরোধ জানান তিনি। দালালেরা এখনো টোপ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে বাঙালি যুবকদের বিপদে ফেলছে। চোরাই পথে ইউরোপ আসতে অনেকে জীবন দিয়েছেন। ইউরোপের গ্রিস, ইতালি অন্যান্য দেশে বাংলাদেশীদের কাজের সুযোগ সুবিধা কমছে।
গ্রিস অভিবাসীরা জানান, বাংলাদেশীরা বিভিন্ন দেশ পাড়ি দিয়ে টুরিস্ট ভিসা ও সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়ে গ্রিসে পৌঁছেছেন। লিবিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে সুমদ্র পাড়ি দিয়ে গ্রিসে এসেছেন অনেকে। নানা প্রতিকূল অবস্থা পাড়ি দিয়ে গ্রিসে পৌঁছা বাংলাদেশীদের অনেকের পাসপোর্ট পর্যন্ত হারিয়ে গেছে অথবা খোয়া গেছে। নতুন করে পাসপোর্ট করা বা নবায়ন করার টাকা পর্যন্ত নেই। ভিখারির চেয়ে খারাপ জীবনযাপন করছেন হাজার হাজার বাংলাদেশী।
অভিবাসীরা জানান, গ্রিসে ঠিক কতজন বাংলাদেশী দুর্বিষহ অবস্থায় আছেন তা বাংলাদেশ মিশন বলতে পারে না। কারণ তারা বেশির ভাগ বৈধভাবে গ্রিস আসেননি। এ জন্য মিশনে তাদের কোনো হিসাব নেই। গ্রিসের কয়েকটি বড় নগরীর কয়েকজন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী জানান, গ্রিসে অবৈধ ৩০-৪০ হাজার ও ইতালিতে ১০-১৫ হাজার অবৈধ বাংলাদেশী আছেন, যারা ভবঘুরে। কোনো কাজ নেই ঠিকমতো খাবার পান না। বাংলাদেশী অভিবাসীদের বাসায় দুই-তিন রাত করে কাটান। তাদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে দিনে একবার খেয়ে বেঁচে আছেন। দিনের বেলা অনেকে নগরীর রাস্তায় নামতে পারেন না পুলিশের ভয়ে। যাদের বাড়ি থেকে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন তারা খেতে পাচ্ছেন। অনেকে বাড়ি থেকে টাকা এনে পাসপোর্ট করে বৈধ অভিবাসী হয়ে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি যাচ্ছেন।
বিভিন্ন শহরে পার্ক মেলায় যে ফেরিওয়ালার কাজ করতেন তা প্রায় বন্ধ। পুলিশ অবৈধ বাংলাদেশীদের দেখলেই তাদের ফেরি করা সামগ্রীসহ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। জরিমানা করছে। জেলে পুরে দিচ্ছে।
অভিবাসী সুকুমার সরেন জানান, বেশির ভাগ বাংলাদেশী অনেক বেশি বেতনের আশায় ১২ থেকে ১৬ লাখ টাকা খরচ করে ‘টারজান ভিসায়’ বিভিন্নভাবে গ্রিস এসেছেন। বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে যারা ইউরোপে প্রবেশ করে তাদের টারজান ভিসায় এসেছে বলা হয়। দালালদের খপ্পরে পড়ে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে অনেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করে ভিটেমাটি বিক্রি করে উচ্চসুদে টাকা ধার করে ইউরোপে এসেছেন। আসার পর তারা অবৈধ হয়েছে। মহাসঙ্কটে পড়েছেন। কেউ কেউ দেশ থেকে টাকা এনে পেট চালাচ্ছেন।
অভিবাসী আবু বক্কর জানান, এ সঙ্কট কবে কাটবে তার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। আগে যেসব ‘অড জব’ কৃষি খামার, গরু-ভেড়া, শূকরের খামারে কাজ, কসাইখানায় কাজ, আবর্জনা পরিচ্ছন্ন কর্মীর কাজ বাংলাদেশীরা বেশি করতেন। এখন এসব কাজে ভাগ বসিয়েছেন হাজার হাজার বেকার গ্রিসবাসী ও ভারতীয়রা। বাংলাদেশীরা পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য এসব কঠিন কাজও পাচ্ছেন না।
সুকুমার সরেন আরো জানান, বাংলাদেশ দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তা বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশীদের সহযোগিতা করেন না। তাদের পাত্তাও দেন না। অপর দিকে পাকিস্তানি ও ভারতীয় দূতাবাস তাদের বিপন্ন নাগরিকদের সহযোগিতা করেন। লিবিয়া থেকে যেসব পাকিস্তানি ও ভারতীয় গ্রিসে এসেছিলেন তাদের নিজ নিজ দূতাবাস নানা কায়দায় বৈধ করেছে। বাংলাদেশী বিপন্নদের বাংলাদেশ মিশনও কিছু করতে পারছেন না। পাকিস্তান ও ভারতীয় মিশন থেকে এ রকম অভিবাসীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বৈধ হওয়ার জন্য কাগজপত্র তৈরি করে দিচ্ছে। ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের সে দেশের অভিবাসীরা চাঁদা তুলে বিপন্নদের সাহায্য করছেন। কিন্তু বাংলাদেশী বিপন্নদের দেখার ও সহযোগিতা করার কেউ নেই।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button