ভারতীয় টিভি আগ্রাসনে ধ্বংস হচ্ছে সমাজ ও সংস্কৃতি
মুহাম্মদ আমিনুল হক
এবারের ঈদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে ভারতীয় পাখি ড্রেস! পাখি ড্রেস না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে কয়েক কিশোরী। পাখি ড্রেস উপহার না দেয়ায় স্ত্রী স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে-এমন খবরও আমরা পেয়েছি। যে খবর আমাদের কানে পৌঁছেনি কিন্তু অনুমান করতে পারছি সেটা হচ্ছে-পাখি ড্রেস কিনতে না পারায় বহু পরিবারের ঈদ আর ঈদ থাকেনি। তাদের ঈদের আনন্দ পরিণত হয়েছে বিষাদে। বাচ্চাদের আবদার না মেটাতে পেরে বাবা কষ্ট পেয়েছেন। বান্ধবীদের মতো নিজের ড্রেসটা পাখি না হওয়াতে অনেক মেয়ে অভিমান করে ঘরে ঈদ কাটিয়েছেন আনন্দ-উচ্ছ্বাসবিহীন। ঈদের দিন সন্তানদের আনন্দে উচ্ছল চেহারা দেখতে সব মা-বাবাই চান। কিন্তু প্রিয় সন্তানের আনন্দিত চেহারার বদলে যদি অভিমানে মলিন কালো বর্ণের লাশ দেখতে হয় তখন তার কেমন লাগে!
ভারতের বিনোদনমূলক টিভি চ্যানেল স্টার জলসার জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘বোঝে না সে বোঝে না’। তারই একটি নারী চরিত্রের নাম পাখি। সিরিয়ালে চরিত্রটি যে থ্রিপিস পরেন তা-ই বাংলাদেশে পাখি ড্রেস নামে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। খবরে প্রকাশ, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় নূরজাহান খাতুন নামের ১৪ বছরের এক কিশোরী তার মা ও বোনের কাছে ঈদ উপলক্ষে পাখি ড্রেস চায়। ওই পোশাক কিনে না দেয়ায় নূরজাহানের সঙ্গে তার মা ও বোনের ঝগড়া হয়। এরপর কষ্টে-অভিমানে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে নূরজাহান। গত ৯ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ১৫ বছরের কিশোরী হালিমা পাখির ড্রেস না পেয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর আগ্রাসন ঠেকাতে সুপ্রিমকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দা শাহীন আরা লাইলী রিট আবেদনটি করেন। রিট আবেদনে ভারতীয় তিনটি চ্যানেল যথাক্রমে স্টার জলসা, স্টার পাস ও জি বাংলা চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধে সাত দিনের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ চাওয়া হয়েছে। আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী এখলাছ উদ্দিন ভূইয়া বলেন, বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল ভারতে সম্প্রচার করা হয় না। কিন্তু ভারতীয় টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে অবাধ সম্প্রচারের ফলে দেশের যুব সমাজ ধ্বংসের সম্মুখীন। তিনি বলেন, স্টার জলসায় ‘বোঝে না সে বোঝে না’ সিরিয়ালে পাখি চরিত্রে অভিনয়কারীর পোশাকে আকৃষ্ট হয়ে পাখি ড্রেস না কিনতে পেরে বাংলাদেশে একাধিক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। একাধিক সংসার ভেঙেছে।
ভারতীয় টিভি আগ্রাসনে আমাদের সংস্কৃতি, সমাজ, ধর্ম ও অর্থনীতি এখন ধ্বংসের মুখোমুখি। পাখি ড্রেস না পেয়ে আত্মহত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে যা আবারো প্রমাণিত হলো। আমাদের দেশে খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং, পরকীয়া, বিবাহ বিচ্ছেদসহ সামাজিক যেসব বিশৃংখলা মহামারী আকার ধারণ করেছে তার পেছনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে ভারতীয় টিভিগুলো। ধর্মীয়, সামাজিক ও সংস্কৃতিক দিক দিয়ে আমাদের সাথে ভারতের অবস্থান একেবারে বিপরীত। আমাদের অধিকাংশ জনগণ মুসলিম আর ভারতের অধিকাংশ জনগণ হিন্দু। হিন্দু সংস্কৃতিতে যেভাবে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নাচ-গান, আমোদ-স্ফূর্তির অবকাশ আছে সেভাবে ইসলামে নেই। এ কারণে ভারতীয় সংস্কৃতি এদেশে ঢুকে পড়লে আমাদের স্বজাতীয় বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট হতে বাধ্য। সাম্রাজ্যবাদী ভারত বিভিন্ন অজুহাতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো তাদের দেশে প্রবেশে বাধা প্রদান করলেও তাদের টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের দেশে অবাধে চালাতে পারছে। এর মাধ্যমে ভারত আমাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা, সামাজিক রীতি-নীতি, ধর্ম-কর্ম, অর্থনীতি ও রাজনীতি সবকিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করছে অতি সহজেই।
বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এখন ভারতীয় সংস্কৃতির কুপ্রভাব পড়েছে। পরিবারগুলো ভেঙে পড়ছে। সমাজের সর্বস্তরে ভর করেছে নৈতিক অধঃপতন। হু হু করে হিন্দি স্টাইলে বাড়ছে সামাজিক অপরাধ। ভারতের ন্যায় এদেশেও গণধর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। যুবসমাজ আজ মাদকাসক্ত। বিকৃত যৌনাচার, পর্নোগ্রাফি এখন বেশ সস্তা। সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে পৌঁছে গেছে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা।
ভারতীয় টিভিগুলোতে প্রচারিত নাটক সিনেমার আসল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-অনৈতিকতা, অশ্লীলতা, কুটনামি, অপরাধ ইত্যাদি। প্রায়সব সিরিয়ালের মধ্যে থাকে কীভাবে পরকীয়া প্রেম করা যায় তার বাস্তব প্রশিক্ষণ। পরকীয়ার রগরগে যত কেচ্ছা সব আছে ঐসব সিরিয়ালে। কীভাবে দেবর ভাবীর সাথে, পুত্রবধূ শ্বশুরের সাথে, দুলাভাই শালিকার সাথে, গৃহকর্তা কাজের মেয়ের সাথে, গৃহকত্রী পিয়ন-ড্রাইভার-দারোয়ানের সাথে পরকীয়া প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে অবৈধ যৌনাচার করতে পারে তার কৌশল বাতলে দেয়া হয় ভারতীয় সিরিয়ালগুলোতে।
কূটকৌশল শেখাতেও বড্ড ওস্তাদ ঐসব সিরিয়ালগুলো। ভারতীয় সিরিয়ালগুলো কেউ হালকাভাবেও পর্যবেক্ষণ করলে যা দেখতে পাবেন তা হচ্ছে- মহিলাদের কুটনামি। কীভাবে বউ শাশুড়িকে পরাজিত করবে, কীভাবে ননদ, জা, দেবর, শ্বশুর, স্বামী, নিজের গর্ভজাত ছেলেমেয়ে, কাজের লোক, অফিসের সহকর্মীদের সাথে কুটনামি করতে হয় তা শেখা যাবে ভারতীয় সিরিয়াল থেকে। এইসব সিরিয়াল একবার কেউ দেখা শুরু করলে এমনভাবে আসক্ত হয়ে পড়বে যে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার ঘুম খাওয়া হারাম হয়ে যাবে।
ভারতীয় টিভি প্রোগ্রামগুলো আসক্তিভরে দেখতে দেখতে বাংলাদেশী দর্শকরা হিন্দি ভাষাকেও রপ্ত করে ফেলছে। শহুরে ছেলেমেয়েদের অনেকেই বাংলা ভাষা ভালো করে বলতে না পারলেও এরা অনর্গল হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারে। এতে আমাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে আমরা বাংলা ভাষা পেয়েছিলাম সে ভাষাকে এখনে গ্রাস করতে বসেছে পাশের দেশের হিন্দি ভাষা।
ভারতীয় প্রোগ্রামগুলোতে কিশোর-কিশোরীদের অত্যন্ত নষ্টামি কায়দায় উপস্থাপন করা হয়। ১৩-১৪ বছরের কিশোর-কিশোরীরা এমনভাবে পোশাক পরে যাতে তাদের শরীরের গোপন অঙ্গগুলোর ভাঁজ ও অবস্থান খুব সহজে দর্শকদের মাতাল করে ফেলে। তারা এমনভাবে নিতম্ব দুলিয়ে, দু পা ফাঁক করে অশ্লীল ভঙ্গিমায় নাচ-গান করতে থাকে যা দেখলে যে কোনো পবিত্র মনেও নষ্টামি ভর করতে পারে। ভারতীয় কিশোর-কিশোরীদের জোড়ায় জোড়ায় ড্যান্স, একে অপরের আলিঙ্গনের দৃশ্য দেখে বৃদ্ধদের মনেও যৌন সুড়সুড়ি জেগে উঠতে পারে।
ভারতীয় টিভি প্রোগ্রামগুলোর কুফল ভারতের মতো বাংলাদেশও হারে হারে টের পাওয়া শুরু করেছে। ভারতের মতো এখানেও গণধর্ষণ শুরু হয়েছে। ১৪-১৫ বছর পেরোনের আগেই কিশোর-কিশোরীরা অবৈধ যৌন মিলনে লিপ্ত হচ্ছে। পরিমল জয়ধর, মানিকরা ধর্ষণের সেঞ্চুরী করছে, ঐশীর মতো মেয়েরা মা-বাবাকে হত্যা করছে। যুবক-যুবতীরা হারিয়ে যাচ্ছে অনৈতিক সম্পর্কের অতল গহ্বরে। মা-খালার মতো বয়সী মহিলারা যুবক ছেলেদের নিয়ে গোপন অভিসারে মেতে উঠছে। বাপ-চাচাদের বয়সী পুরুষেরা হারিয়ে যাচ্ছে যাকে তাকে নিয়ে। ধর্ম-কর্ম, সমাজ-সংস্কৃতি সব এখন হারিয়ে গেছে। সম্মান, শ্রদ্ধা ভালোবাসা উঠে গেছে। সবাই ছুটছে ভোগবাদের পেছনে।
অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এই ঈদে পাখি ড্রেস সর্বনিম্নে বিক্রি হয়েছে তিন হাজার টাকায় আর সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছে এক লাখ টাকায়। টিভি সিরিয়ালের মাধ্যমে পাখি ড্রেসের নাম বাংলাদেশী দর্শকদের মনে গভীরভাবে বসিয়ে দেয়া হলো। এরপর শুরু হলো পাখি ড্রেসের বাজারজাত। হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলো ইন্ডিয়ান ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে বাংলাদেশী হরেক পদের পোশাক আশানুরূপ বিক্রি না করতে পেরে ব্যবসায়ীদের কপালে হাত উঠেছে। এভাবেই ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ ও অর্থনীতিকে দিন দিন ধ্বংস করে ফেলছে।
ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর এই আগ্রাসন এখনই বন্ধ করতে হবে। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে আমাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভারত যদি চক্ষু লজ্জা ফেলে আমাদের টিভিগুলোর প্রচার সেদেশে বন্ধ রাখতে পারে আমরা কেন তাদের খারাপ চ্যানেলগুলোর প্রচার এদেশে রুদ্ধ করতে পারব না? সিঙ্গাপুর, জাপান, চীন আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত রাষ্ট্র কিন্তু তারপরও তারা তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতির কথা ভেবে অন্যদেশের টিভি চ্যানেল অহরহ প্রচারের পথ বন্ধ করে রেখেছে। লাক্স সাবানের ক্রেতা আমাদের চেয়ে সৌদিতে কম নেই। কিন্তু সেখানে লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপন সৌদি আরবের নীতিমালা মেনে হিজাবওয়ালা নারী দিয়েই করতে হয়। কিন্তু একই লাক্সের বিজ্ঞাপন ভারত ও বাংলাদেশে উপস্থাপন করা হয় অত্যন্ত অশ্লীলভাবে। সরকারের সদিচ্ছাই পারে অশ্লীলতা মুক্ত দেশ গড়তে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এখনই কোনো পদক্ষেপ না গ্রহণ করে তাহলে এদেশেও ভারতের মতো অপরাধের মাত্রা হু হু করে বেড়ে যাবে।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব