মুমিনের দিলের দরজায় কড়া নাড়ছে হজ
মুফতি হুমায়ুন আইয়ুব
সিয়াম শেষের প্রাপ্তি আনন্দে মুমিনের দিল ব্যাকুল হয় মাবুদের সান্নিধ্য পেতে। দিলের দরজায় কে যেন কড়া নেড়ে যায়। আয়রে প্রেমিক আয়, আমার ঘরে আয়। শুরু হয়ে যায় দুনিয়াজুড়ে মুসলমানের হজব্রতের প্রস্তুতি। শাওয়ালের চাঁদ ডুবে জিলকদের চাঁদে প্রেম-পেরেশানি বাড়ে মুমিনের দিলে। জিলহজ মাসে কালো গিলাফের ছায়ায় আপন মনে সাত চক্কর খেয়ে তবেই শান্ত হয় দিল।
২৭ আগস্ট থেকে এ মৌসুমের হজ ফ্লাইট শুরু হবে। চাঁদ দেখার ভিত্তিতে এবারের হজব্রত উদযাপিত হতে পারে ৪ অক্টোবর।
দুনিয়াজুড়ে লাব্বাইকার ধ্বনি বাজছে। কালো ঘরের প্রেমিকেরা সাদা পোশাকে এগিয়ে যাবে। এগিয়ে যাবে কাবার দিকে। পেয়ারা নবীর রওজার দিকে। সবুজ গম্বুজের ছায়া, কালো পাথরের চুমু আর কাবার গিলাফ জড়িয়ে প্রভুর প্রেমে ডুবে থাকার সৌভাগ্য সবার কপালে জোটে না। আরবের মাঠ-ঘাটে ঘুর এলেই হজ হয় না। হজের আছে নিজস্ব নীতিমালা। কাবার মেহমানদের জন্য জানাচ্ছি হজ প্রস্তুতির আদ্যোপান্ত-
চাই খাঁটি নিয়ত
হজে যাওয়ার সময় নিয়ত নিখুত করুন। সবার আগে প্রয়োজন নিয়ত খাঁটি করা। হজরত রাসূল (সা.) বলেন, নিশ্চয় নিয়তের ওপর আমল নির্ভরশীল।
এবার তওবা করে নিন
খাঁটি নিয়ত হওয়ার সঙ্গে প্রয়োজন খাঁটি তওবা। জীবনের সব ভুল-ভ্রান্তির জন্য আল্লাহর কাছে খাঁটি মনে তওবা করুন। সেই সঙ্গে আগামী জীবন হজময় করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করুন।
নিজেকে তৈরি করুন
এবার মানসিক প্রস্তুতি নিন। নিজেকে তৈরি করুন। শরীর তো বটেই মনকেও বলুন- লাব্বাইকার বাগানে হাজির হচ্ছি, আল্লাহতায়ালার সামনে হাজির হচ্ছি। মনের পবিত্রতার প্রয়োজন এ সময় সবচেয়ে বেশি। প্রয়োজন শারীরিক ও মানসিক শুদ্ধতার।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
প্রস্তুতি পর্বের গুরুত্বপূর্ণ কাজ পাসপোর্ট, বিমানের টিকিট সংগ্রহ ও তারিখ নির্ধারণ করা। সঙ্গে রাখুন প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা। হজের নিয়ম জানার জন্য একাধিক বই পড়তে পারেন। তবে বই-ই একমাত্র সমাধান নয়, প্রয়োজনীয় বিষয়ে হজ বিশেষজ্ঞ আলেম মুফতি এবং হজ ক্যাম্পের পরামর্শ নিন।
মেডিকেল সার্টিফিকেট
মকবুল হজের পূর্বশর্ত সুস্থ দেহ, সুন্দর মনের। বৈরী আবহাওয়ায়ও হাজীদের সুস্থ রাখতে প্রয়োজন স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও মেনিনজাইটিস-ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধক টিকা। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকার পর মেডিকেল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে ভুলবেন না। জেলা শহরেও স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকা গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। মেডিকেল সার্টিফিকেট ছাড়া কেউ হজে যেতে পারবেন না।
হজ প্রশিক্ষণ
হজের আমলটা তুলনামূলক কঠিন। তাই প্রস্তুতি পর্বের প্রশিক্ষণও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। সারা দেশেই সরকারি-বেসরকারিভাবে হজ প্রশিক্ষণ হয়। সুবিধামতো অংশ নেয়া জরুরি।
বিজ্ঞ আলেম অথবা মসজিদ কর্তৃপক্ষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হজযাত্রার তিন দিন আগে হজ ক্যাম্প, বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো বা ব্যক্তিগত হজেরও প্রশিক্ষণ হয়। এসব আয়োজনে মনোযোগের সঙ্গে অংশগ্রহণ করা উচিত।
হজ সফরে যা যা নেবেন
হজের সফরে ব্যক্তিগত মালামাল কি কি লাগতে পারে অভিজ্ঞজনদের কাছ থেকে জেনে নিন। মালামাল নেয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকুন। আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন- পাসপোর্ট, ভিসা, টাকা রাখার জন্য গলায় ঝোলানো ছোট ব্যাগ, বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার অথবা রিয়াল) কেনা, ইহরামের কাপড় কমপক্ষে দুই সেট (প্রতি সেটে শরীরের নিচের অংশে পরার জন্য আড়াই হাত বহরের আড়াই গজ এক টুকরা কাপড় আর গায়ের চাদরের জন্য একই বহরের তিন গজ কাপড়। ইহরামের কাপড় হবে সাদা। সুতি হলে ভালো হয়। নারীদের জন্য সেলাইযুক্ত স্বাভাবিক পোশাকই ইহরামের কাপড়), নরম ফিতাওয়ালা স্পঞ্জের স্যান্ডেল, ইহরাম পরার কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হলে কটিবন্ধনী (বেল্ট), গামছা, তোয়ালে, আপনার জন্য আরামদায়ক পোশাক লুঙ্গি, গেঞ্জি, পায়জামা, পাঞ্জাবি সঙ্গে নিতে পারেন, সাবান, টুথপেস্ট, টয়লেট পেপার, ব্রাশ, মিসওয়াক, নখ কাটার যন্ত্র, সুই-সুতা, থালা, বাটি, গ্লাস, হজের বই, কোরআন শরিফ, ধর্মীয় পুস্তক, কাগজ-কলম, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, চশমা ব্যবহার করলে অতিরিক্ত এক সেট চশমা (ভিড় বা অন্য কোনো কারণে ভেঙে গেলে ব্যবহারের জন্য), বাংলাদেশী টাকা (দেশে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার জন্য), নারীদের জন্য বোরকা, মালপত্র নেয়ার জন্য ব্যাগ অথবা স্যুটকেস (তালা-চাবিসহ), মোবাইল সেট ( সৌদি সিম কিনে ব্যবহার করতে পারবেন) বাইরে আরও কিছু প্রয়োজনীয় মনে হলে তা নিয়ম মেনে সঙ্গে নিতে হবে।
হাজী ক্যাম্পে অবস্থান
হাজী ক্যাম্প হজযাত্রার প্রথম ঠিকানা। সতর্কতার সঙ্গে জিকিরে-ফিকিরে অবস্থান করুন। আসবাবের প্রতি যতœশীল হোন। প্রয়োজনীয় কিছু বাকি থাকলে সেখানে অবস্থান করেই সম্পন্ন করে নিন।
হজ ক্যাম্পে নিষিদ্ধ বস্তু এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহের জন্য রয়েছে তিনটি ক্যান্টিন। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসার কোনো প্রয়োজন নেই।
ইহরাম
ইহরামের কাপড়ে নিজেকে বাঁধার আগে জেনে নিন ইহরামের বিস্তারিত। মক্কার কাছে নির্দিষ্ট স্থানে বিধি মেনে হজ করার সংকল্প করাকে ইহরাম বলে। আপনার গন্তব্য ঢাকা থেকে মক্কায়, নাকি মদিনায় তা জেনে নিন। যদি মদিনায় হয়, তাহলে এখন ইহরাম বাঁধা নয়; যখন মদিনা থেকে মক্কায় যাবেন, তখন ইহরাম বাঁধতে হবে। বেশিরভাগ হজযাত্রী আগে মক্কায় যান। যদি মক্কা যেতে হয়, তাহলে ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার আগে ইহরাম বাঁধা ভালো। কারণ জেদ্দা পৌঁছানোর আগেই ‘মিকাত’ বা ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান। বিমানে যদিও ইহরাম বাঁধার কথা বলা হয়, কিন্তু ওই সময় অনেকে ঘুমিয়ে থাকেন; আর বিমানে পোশাক পরিবর্তন করাটাও দৃষ্টিকটু। বিনা ইহরামে মিকাত পার হলে এ জন্য দম বা কাফফারা দিতে হবে। তদুপরি গুনাহ হবে।
ইহরামে যা নিষেধ
ইহরাম গ্রহণের পর সাংসারিক কাজ-কর্ম নিষেধ যেমন- সহবাস করা যাবে না, পুরুষদের জন্য সেলাই করা জামা, পায়জামা ইত্যাদি বৈধ নয়, কথা ও কাজে কাউকে কষ্ট না দেয়া, নখ, চুল, দাড়ি-গোঁফ ও শরীরের একটি পশমও কাটা বা ছেঁড়া যাবে না, সুগন্ধি লাগানো যাবে না, শিকার করা যাবে না। তবে ক্ষতিকারক সব প্রাণী মারা যাবে, ক্ষতি করে না এমন কোনো প্রাণী মারা যাবে না।
মক্কায় প্রবেশের পদ্ধতি
মসজিদুল হারামে বেশ কয়েকটি প্রবেশপথ। সবক’টি দেখতে একই রকম। কিন্তু প্রতিটি প্রবেশপথে আরবি ও ইংরেজিতে ১, ২, ৩ নম্বর প্রবেশ পথের নাম আছে, যেমন ‘বাদশা আবদুল আজিজ প্রবেশপথ’। আপনি আগে থেকে ঠিক করবেন, কোনো প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকবেন বা বের হবেন। আপনার সফরসঙ্গীকেও স্থান চিনিয়ে দিন। তিনি যদি হারিয়ে যান, তাহলে নির্দিষ্ট নম্বরের গেটের সামনে থাকবেন। এতে ভেতরের ভিড়ে হারিয়ে গেলেও নির্দিষ্ট স্থানে এসে সঙ্গীকে খুঁজে পাবেন। কাবা শরিফে স্যান্ডেল-জুতা রাখার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকবেন। নির্দিষ্ট স্থানে জুতা রাখুন। অথবা ব্যাগে নিজের কাছে রাখুন। এখানে-সেখানে জুতা রাখলে পরে আর খুঁজে পাবেন না।
মসজিদের ভেতরে-বাইরে জমজমের পানি (স্বাভাবিক ও ঠাণ্ডা) রাখা আছে। প্রাণ ভরে পানি পান করতে পারেন। কাবা ঘরের চারটি কোণের আলাদা নাম আছে। যেমন- হাজরে আসওয়াদ, রকনে ইরাকি, রকনে শামি ও রকনে ইয়ামেনি। হাজরে আসওয়াদ বরাবর কোণ থেকে শুরু হয়ে কাবাঘরের পরবর্তী কোণ রকনে ইরাকি, (দুই কোণের মাঝামাঝি স্থান মিজাবে রহমত ও হাতিম)। তারপর যথাক্রমে রকনে শামি ও রকনে ইয়ামেনি। এটা ঘুরে আবার হাজরে আসওয়াদ বরাবর এলে তাওয়াফের এক চক্কর পূর্ণ হয়। এভাবে একে একে সাত চক্কর দিতে হয়।
ওমরাহ
ওমরাহর নিয়ম-কানুন আগে জেনে নেবেন, যেমন- সাতবার তাওয়াফ করা, জমজমের পানি পান করা, নামাজ আদায় করা, সাঈ করা (সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়ানো), মাথা মুণ্ডানো অথবা চুল ছোট করা এসব কাজ ধারাবাহিকভাবে করা। ওয়াক্তীয় নামাজের সময় হলে যতটুকু হয়েছে ওই সময় নামাজ পড়ে আবার বাকিটুকু শেষ করা।
ওমরার সংজ্ঞা
হিল (কাবা শরিফের সীমানার বাইরে মিকাতের ভেতরের স্থান) থেকে অথবা মিকাত থেকে ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা, সাফা-মারওয়া সাঈ করা এবং মাথার চুল ফেলে দেয়া বা ছোট করাকে ওমরাহ বলে।
যেসব স্থানে দোয়া কবুল হয়
মাতাফ (তাওয়াফ করার স্থান), মুলতাযাম (হাজরে আসওয়াদ থেকে বায়তুল্লাহর দরজা পর্যন্ত), হাতিমের মধ্যে, মিযাবে রহমতের মধ্যে, কাবাঘরের ভেতরে, জমজম কূপের কাছে (যদিও কূপ এখন বেজমেন্টের নিচে, চাইলেও এখন দেখা যায় না), মাকামে ইবরাহিমের কাছে, সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের ওপর, সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে, বায়তুল্লাহর দিকে যখন নজর পড়ে, রুকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মাঝখানে, আরাফাতের ময়দানে, মুজদালিফার ময়দানে, মিনার ময়দানে এবং মিনার মসজিদে খায়েফে, কংকর মারার স্থানে।
হজের ধারাবাহিকতা
ইহরাম বাঁধা, ৭-৮ জিলহজ মিনায় অবস্থান, ৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পরে মিনা থেকে আরাফাতে অবস্থান, সূর্যাস্তের পরে মুজদালিফায় যাওয়া, ৯ জিলহজ মুজদালিফায় রাত যাপন, ১০ জিলহজ মিনায় বড় জামারাকে (শয়তান) কংকর মারা, কোরবানি করা, মাথার চুল ফেলে দেয়া, ১২ জিলহজের মধ্যে তাওয়াফ জিয়ারত, সাঈ করা, ১১, ১২ জিলহজ মিনায় জামারাকে (শয়তান) কংকর মারা, বিদায়ী তাওয়াফ।
হজের ফরজ
ইহরাম বাঁধা, আরাফায় অবস্থান করা, তাওয়াফ করা ।
হজের ওয়াজিব
সাঈ, মাথা মুণ্ডন করা বা চুল খাটো করা, মুজদালিফায় অবস্থান, কংকর মারা, বিদায়ী তাওয়াফ, কোরবানি করা।
হজের সুন্নত
তাওয়াফে কুদুম, রমল করা, মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ও সেখানে রাত যাপন, ৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর আরাফার দিকে রওয়ানা করা, আরাফায় অবস্থান করে সূর্যাস্তের পর মুজদালিফার দিকে রওয়ানা করা, আরাফার ময়দানে জোহরের অগে গোসল করা, ১০, ১১, ১২ জিলহজ দিবাগত রাতে মিনা বাজারে থাকা।
হজের দোয়া
হজের প্রত্যেকটি বিধান পালনের সময় গুরুত্বপূর্ণ দোয়া রয়েছে। যেমন- ইহরাম বাঁধার দোয়া, জেদ্দা শহর দেখে দোয়া, হেরেমে প্রবেশের সময় দোয়া, মক্কা শরিফে প্রবেশের সময় দোয়া, বাইতুল্লাহ শরিফ দর্শনের দোয়া, তাওয়াফ করার সময় দোয়া, প্রত্যেকটি চক্করের সময় দোয়া, জমজমের পানি পানের সময় দোয়া, সাফা মারওয়ায় সায়ির সময় দোয়া করা।
হজের তালবিয়া
‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক,
লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক,
ইন্নাল হাম্দা, ওয়ান্নি’মাতা
লাকা ওয়ালমুল্ক, লা শারিকা লাকা।’
লেখক : প্রিন্সিপাল, জামিয়াতুস সালাম মদিনাবাগ মাদ্রাসা, ঢাকা