তিন লাখ বাংলাদেশীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত মালয়েশিয়ায়

Malaysiaমনির হোসেন: দালালচক্রের খপ্পরে পরে মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সিক্স-পি প্রোগ্রামের আওতায় অবৈধদের ধরতে দেশটির সরকার ব্যাপক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে সেখানে নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়া বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী এখন বনে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু সেসব জায়গায় পালিয়ে থেকেও নিস্তার নেই। এক দিকে বনে জঙ্গলে মানবেতর জীবন, মশা ও পোকা মাকড়ের কামড়, খাদ্য ও বাসস্থানের অভাব, অপর দিকে পুলিশের অভিযানে তারা দিশেহারা।
জানা গেছে, দেশীয় দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশী তরুণরা প্রতিদিনই বিভিন্ন পন্থায় মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ শিক্ষা ও ভ্রমণ ভিসায় মালয়েশিয়া গেলেও প্রতারণার কারণে সেখানে গিয়ে তারা অবৈধ হয়ে পড়ছেন। বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে গেলেও সেখানে গিয়ে তাদের কাজ, বাসস্থান বা দীর্ঘ দিন থাকার বৈধতা কিছুই দেয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া সমুদ্রপথে ট্রলারযোগেও প্রতিদিন টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, হজরত শাহজালাল ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কিছু ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রতিদিন কোনো না কোনো ফ্লাইটে স্টুডেন্ট, ট্যুরিস্ট ও ভিজিট ভিসার নামে এসব লোক দেশটিতে পাড়ি জমাচ্ছে। এদের যাওয়াটা বৈধ হলেও স্বল্প মেয়াদের ভিসা শেষে তারা অবৈধ হয়ে পড়ছে। যদিও দালালরা তাদের গ্যারান্টি দিয়ে থাকে বৈধ করে দেয়ার। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। অন্য দিকে এসব অবৈধ গমনের কারণে প্রকৃত শিক্ষার্থী ও ভ্রমণকারীরা ভিসা প্রাপ্তিতে নানা জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
এ দিকে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন ও দেশটিতে অবৈধভাবে অবস্থান করা বাংলাদেশীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, দুই দেশের ইমিগ্রেশন কন্ট্রাক্ট করে দালালচক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন শত শত লোককে ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে আকাশপথে নতুবা ট্রলারে নিয়ে আসছে। তাদের মতে, গত এক বছরের হিসাবেই কম করে হলেও প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশী দেশটিতে প্রবেশ করে এখন অবৈধভাবে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়তে থাকায় মালয়েশিয়া সরকার সম্প্রতি অবৈধ বিদেশী শ্রমিক ধরপাকড় অভিযান শুরু করে। এবার তারা অবৈধদের ধরতে বন জঙ্গলেও অভিযান চালাচ্ছে।
গতকাল শনিবার মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিলর (শ্রম) মন্টু কুমার বিশ্বাস বলেন, আসলে মালয়েশিয়ায় বৈধ শ্রমিকের সংখ্যা কত তা এই মুহূর্তে সঠিকভাবে বলতে পারছি না। তবে লিগালাইজেশনের আগ পর্যন্ত বৈধ শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখের মতো হবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, লিগালাইজেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ২০১১ সালে, যা এখনো চলমান রয়েছে। ৬পি প্রোগ্রামের সর্বশেষটি এখনও চলছে। মানে ধরপাকড় অভিযান। অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বলা সম্ভব নয়। প্রতিদিন ট্রলারে, বিমানবন্দর দিয়ে শত শত লোক এখনো মালয়েশিয়া পাড়ি জমাচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা হাইকমিশনের বিষয় নয়, বরং আমি বলব আপনারা কতজন শ্রমিক দেশ থেকে পাঠাচ্ছেন? মালয়েশিয়া থেকে অনেকে জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশটিতে প্রায় তিন লাখ অবৈধ বাংলাদেশী অবস্থান করছে। এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন এসব কথা সঠিক নয়।
গতকাল জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার একাধিক নেতার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, মালয়েশিয়ায় জি টু জি পদ্ধতি ছাড়া কোনো শ্রমিকের যাওয়ার সুযোগ নেই। যার কারণে ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সি নামধারী দালালচক্রের সদস্যরা কখনো স্টুডেন্ট, কখনো ট্যুরিস্ট ভিসার নামে একেকজনের কাছ থেকে তিন লাখ সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে মালয়েশিয়ায় পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে বিমানবন্দর দিয়ে প্লেনে তুলতে দালালদের খরচ হচ্ছে ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। তারা বলেন, দালালদের সিন্ডিকেট ইমিগ্রেশনের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ম্যানেজ করে এভাবে দীর্ঘদিন ধরে লোক পাঠাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। যার কারণে মালয়েশিয়ায় অবৈধ বাংলাদেশীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তারা বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গঠিত টাস্কফোর্স এসব চক্রের বিরুদ্ধে এখনি কঠোর অবস্থান না নিলে পরিস্থিতি সামনে আরো ভয়াবহ হতে পারে।
গতকাল মালয়েশিয়ার জহুরবারু থেকে মেহেদী হাসান বলেন, মালয়েশিয়ায় আবার পুলিশি অভিযান শুরু হয়েছে। এবার মালয়েশিয়ার পুলিশবাহিনী বিভিন্ন এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান চালানোর পাশাপাশি বনে জঙ্গলেও অভিযান চালাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিদিন শাহজালাল ও শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে লোক আসছে। তার পরিচিত এক লোক গত চার মাস আগে ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সি থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় আসেন। দালালরা তাকে মালয়েশিয়ায় এনে ছেড়ে দিয়েছে। এখন শরীফ নামের ওই যুবক কাজ না পেয়ে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। একই সাথে ধরপাকড় শুরু হওয়ায় তিনি এখন বনের মধ্যে অবস্থান নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। কারাগারে এই মুহূর্তে হাজার হাজার বাংলাদেশী পুলিশের হাতে ধরা পড়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। তারা কিভাবে দেশে ফিরবে সে ব্যাপারে হাইকমিশনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিলর মন্টু কুমার বিশ্বাস বলেন, তার জানা মতে বর্তমানে মালয়েশিয়ার কারাগারে ৮০০ বাংলাদেশী আটক রয়েছে। প্রফেশনাল ভিসার নামে বাংলাদেশ থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র ছাড়াই প্রতিনিয়ত লোক যাচ্ছে। এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মূলত প্রফেশনাল ভিসা হচ্ছে নিয়োগকর্তার চাহিদা মোতাবেক। তবে এটি হাইকমিশনের বিষয় নয়। সবশেষ তিনি জানালেন সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এই সপ্তাহে মালয়েশিয়ার হিউম্যান রিসোর্স মিনিস্টারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button