মহেশখালী হতে যাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক শহর
শামসুল হক শারেক, মহেশখালী থেকে ফিরে: মাতারবাড়ি-ধলঘাট, হোয়ানক ও কালারমারছড়া মিলে কক্সবাজারের মহেশখালী হতে যাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও আধুনিক একটি শহর। এখানে হবে সাগরের ভাঙনরোধে টেকসই বেড়িবাঁধ, পরিকল্পিত হাউজিং, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট।
এ সবই হচ্ছে একটি কারণে আর তা হলো এখানে হচ্ছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও পিডিবির তত্ত্বাবধানে হোয়ানক-কালামারছরায় প্রায় ২ (দুই) হাজার কোটা টাকা ব্যয়ে আরো ৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ সুবাদে কক্সবাজার, চকরিয়া, কুতুবদিয়াসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠবে ভারী ও মাঝারি ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে পর্যটনে পাশপাশি এই প্রকল্পের সুবাদে বদলে যাবে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব এই অঞ্চলের শিক্ষা-চিকিৎসা ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অর্থনীতির অবস্থা। ইতোমধ্যেই ওই এলাকার মানুষের অবস্থান পরিবর্তনের কথা জানা গেছে। মাতারবাড়ি-ধলঘাট এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে জানা গেছে এই অবস্থা। সরকার মহেশখালীর ওই এলাকায় এত বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করায় এলাকার মানুষ বেজায় খুশী। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে এ জন্য ধন্যবাদ জানান। ওই এলাকায় এত বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে জেনে এলাকার মানুষ নড়েচড়ে বসেছে। এলাকার অধিবাসী অনেকেই জানান, এই সুবাদে এখানে হবে টেকসই বেড়িবাঁধ। টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় ’৯১ সাল ছাড়াও বারবার জলোচ্ছ্বাসে এলাকার যা ক্ষতি হয়েছে তা থেকে তারা রক্ষা পাবে। সাগরের সাথে আর যুদ্ধ করে বাঁচতে হবে না তাদের। অনেকে বলেন, এখানে অনেক শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। এতে কর্মসংস্থান হবে হাজার হাজার মানুষের। অনেকে বলেন, মাতারবাড়ি থেকে একজন রোগী চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার-চট্টগ্রাম নিতে যা কষ্ট আর সময় লাগে তা আর থাকবে না। গত ১২ আগস্ট’ ১৪ ইং জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এই প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে ১২শ’ মেগাওয়াট দক্ষতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ সরকার এ বছরই শুরু করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এর সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দরও নির্মিত হবে এবং মাতারবাড়ি দ্বীপে একটি ভারী শিল্প এলাকা গড়ে তোলা হবে বলে জানা গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অত্যাধিক জ্বালানি-সাশ্রয়ী (আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল) প্রযুক্তিতে নির্মিত হবে। এটি উৎপাদনে গেলে দেশের প্রায় ১১ শতাংশ জনগোষ্ঠী নতুন করে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ ছাড়াও পিডিবির তথ্যাবধানে মহেশখালীর হোয়ানক-কালারমারছরা ইউনিয়নে আরো ৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। সূত্রমতে এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের জন্য মহেশখালী মাতারবাড়ি-ধলঘাট ও হোয়ানক-কালারমারছরা ইউনিয়ন এলাকার সাড়ে ছয় হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ কাজ প্রায় ইতোমধ্যেই সমাপ্ত হয়েছে। গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় মহেশখালী মাতারবাড়িসহ গোটা উপকূলীয় এলাকায় জমি ক্রয় করতে এই দুর্দিনেও দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। গোটা উপকূলীয় এলাকায় এখন জমির মূল্য বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।
জানা গেছে, আজ ২১ আগস্ট পিডিবির প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে মহেশখালী আসছেন একটি চীনা বিশেষজ্ঞ দল। আর ২৩ আগস্ট মাতারবাড়ির প্রকল্প পরিদর্শনে আসছেন জাইকা’র প্রতিনিধি দল। এছাড়া কোরিয়ান একটি প্রতিনিধি দলও খুব শিগগিরই ওই এলাকা পরির্দশনে আসবেন বলে জানা গেছে।
ওই এলাকা পরির্দশনকালে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার এমপি আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মহেশখালীর রাস্তা-ঘাট, বেড়িবাঁধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সাবিক উন্নয়নের পাশপাশি মহেশখালী একটি মেগা সিটিতে পরিণত হবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ২৪২ কোটি টাকা ইতোমধ্যে জমা হয়েছে। তবে ভূমি মালিকরা তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা যথাযথভাবে পাবে কি না এ নিয়ে অনেকে শঙ্কিত। জেলাপ্রশাসক রুহুল আমিন এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রকৃত ভূমি মালিকদের শঙ্কিত হওয়ার কোন কারণে নেই। কাগজপত্র দেখে যথাযথভাবে টাকা দেয়া হচ্ছে।
মহেশখালীর ইউএনও আনোয়ার নাসের এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকার প্রাথমিকভাবে মাতারবাড়ি-ধলঘাট ইউনিয়ন থেকে দেড় হাজার একর এবং হোয়ানক-কালারমারছরা ইউনিয়ন থেকে ৫১০০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। এতে সরকারি জমির চেয়ে বেসরকারি (ব্যক্তি মালিকানার) জমির পরিমাণ বেশি। জেলা প্রশাসক নিজেই অধিগ্রহণ করা জমির বিষয়টি দেখাশুনা করছেন।
কুতুবদিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল বশর চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গোটা দেশের মানুষ উপকৃত হবে। সরকার ইতোমধ্যে কুতুবদিয়ার মানুষের বিদ্যুৎসংস্থানের জন্য ৩ মেগাওয়াটের আলাদা একটি জেনারেটর স্থাপন করতে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
মহেশখালীর অধিবাসী কক্সবাজার ইসলামিয়া মহিলা কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা জাফর উল্লাহ নূরী এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা মহেশখালীসহ গোটা কক্সাজারবাসীর জন্য খুশীর খবর। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তিনি। তবে এজন্য পরিবেশ রক্ষা ও অধিবাসীদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে নজর রাখারও দাবি জানান তিনি।
কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে মহেশখালীর মাতাবাড়ি-ধলঘাট, হোয়ানক ও কালারমারছরা হবে বিশ্বের অন্যতম উন্নত একটি শহর।
মাতারবাড়ির চেয়ারম্যান এনামুল হক রুহুল বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাই পারবেন এই এলাকায় এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে ধন্যবাদ জানান।
মহেশখালীর সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাতারবাড়ির অধাবাসি অ্যাড. মোস্তাক আহমদ বলেন, দীর্ঘদিনের অবহেলিত মহেশখালীর এই এলাকা এখন আলোকিত হবে। এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হবে।
আব্দুল্লাহ নামের একজন দীন মুজুর বলেন, কাজ বাড়লে আমরা খুশী। কবির নামের একজন জেলে জানান, সারা জীবন সাগরে মাছ ধরে সময় কাটিয়েছেন। জীবন মানের উন্নয়ন হয়নি। এই সুবাদে সরকার এলাকার মানুষের জন্য ঘর বাড়ি করে দেবে বলে শুনে তারা আনন্দিত।
মাতার বাড়ি এলাকার কিছু মানুষের মাঝে বিরূপ ভাব দেখা গেছে এই বলে যে, তাদেরকে জায়গাজমি ছাড়তে হচ্ছে। হয়ত একদিন এলাকাও ছাড়তে হবে। তবে সরকার এখানে পরিকল্পিত হাউজিং করে ২০/৩০ তালা বিল্ডিং করে প্রতিটি বিল্ডিং এ ২/৩ শত পরিবার থাকার ব্যবস্থা করা হবে জেনে তাদের সেই ভিতি কেটে যাচ্ছে।
এই প্রকল্প প্রসঙ্গে একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘অর্থমূল্যের দিক থেকে দেশে এটাই সর্ববৃহৎ প্রকল্প যা আমরা অনুমোদন দিতে পেরেছি। এই প্রকল্প আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এর ফলে প্রকল্পে ব্যবহৃত কয়লা ও ধোঁয়া দেখা যাবে না। তাই পরিবেশের ওপর কোন বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নাই’।
প্রকল্পটি সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে এখানে আরও দুটি পাওয়ার প্ল্যান্ট করা হবে। এলএনজি টার্মিনাল হবে। মহেশখালীকে একটি পূর্ণাঙ্গ টাউনশিপ করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, এনভায়রনমেন্টাল ইমপেক্ট অ্যাসেসমেন্ট সার্টিফিকেট দেয়ায় এর পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্ভাবনা নেই।
তাই এই প্রকল্পকে ঘিরে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা অবান্তর। এই প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে আগে নানা ধরনের আশঙ্কা থাকলেও এখন তা কেটে যাচ্ছে।