লন্ডনে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সেমিনারে তারেক রহমান

ক্ষমতালোভী হাসিনা পিতার খুনিদের সঙ্গে রেখেছেন

Tareqশেখ হাসিনাকে ক্ষমতালোভী আখ্যা দিয়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ক্ষমতালোভী শেখ হাসিনা ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে তার পিতা হত্যাকারীদের সঙ্গে রেখেছেন। কাউকে দোষারোপ করার আগে মুজিব হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য সেই সময় ইনু বাহিনীর ভূমিকা কি ছিল সেটি তদন্ত করা প্রয়োজন।
তিনি  বলেন, যারা ১৫ই আগস্ট  শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন, মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিলেন, মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন, শেখ মুজিব ছিলেন স্বৈরাচারী, যারা মুশতাক মন্ত্রিসভার শপথে গিয়েছিলেন, শপথ পরিচালনা করেছিলেন সেসব লোকরাই এখন শেখ হাসিনার নেতা-মন্ত্রী।
রোববার সন্ধ্যায় লন্ডনের কুইনমেরী ইউনিভার্সিটির লেকচার থিয়েটারে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, যুক্তরাজ্য আয়োজিত ‘স্ট্র্যাটেজি ফর এ প্রসফারিয়াস বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক সমাবেশে বলেছেন, মুশতাক আওয়ামী লীগের কুলাঙ্গার। কিন্তু সেই সময় শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপট যারা তৈরি করেছিলেন তারাই এখন হাসিনার দলে ও অবৈধ সরকারে। তাহলে তো বলাই যায়, আওয়ামী লীগ আসলে কুলাঙ্গারদেরই দল।
তিনি বলেন, এই কুলাঙ্গাররাই এখন নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে জিয়া পরিবারকে টার্গেট করেছে। বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান এবং তার পরিবার সম্পর্কে  মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন।
তারেক রহমান বলেন, মুজিব হত্যাকান্ডের সময়কার ঘটনা দেখা এবং জানার মানুষের সংখ্যা এখনও অনেক।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে শেখ মুজিবের জ্ঞাতসারেই তিনটি ট্যাংক ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজপথে বেরিয়ে এসেছিল। ইনু বাহিনীর হাত থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতেই এইসব ট্যাংক নামাতে বাধ্য হয়েছিলেন শেখ মুজিব। কারণ ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তারেক রহমান প্রশ্ন করেন, রাজপথে ট্যাংক নামানোর মতো এই পরিস্থিতি তৈরি করলো কারা? কোন দল? কোন বাহিনী? মুজিব হত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতা মুশতাক প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ঢাকা বিশ্ব্ববিদ্যালয়ে সূর্যসেন হলের সামনে ৭ খুনের জন্য দায়ী শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায়ও শেখ কামালের নাম ইতিহাসে লেখা।
Tareqসেমিনারে তারেক রহমান বলেন, শেখ মুজিবের পরিবার খুনি পরিবার। শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলে সংসদের তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে সংসদ কক্ষে চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। স্বাধীনতার পর ৩০ হাজার মানুষকে হত্যার জন্য দায়ী শেখ মুজিব। ১৯৭৫ সালের ২রা জানুয়ারি আওয়ামী লীগই বিচারবহির্ভূত ক্রসফায়ার চালু করেছিল। ক্রসফায়ারে ভিন্ন মতাবলম্বী  সিরাজ সিকদারকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর শেখ মুজিব সংসদে দাঁড়িয়ে আইন আদালতের তোয়াক্কা না করেই বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ  সেই সিরাজ সিকদার?’
শেখ মুজিব সম্পর্কে তিনি মার্কিন মাসিক রিডার্স ডাইজেস্ট ১৯৭৫-এর মে মাসের একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, পত্রিকটি লিখেছিল, ‘শেখ মুজিব দু’টি বেসামরিক সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল। একটি হচ্ছে তার ভাগ্নে শেখ মনির এক লাখ সশস্ত্র একগুঁয়ে যুবকের সংগঠন যুবলীগ, আর একটি হলো নিষ্ঠুর রক্ষীবাহিনী।’
তারেক রহমান বলেন, যারা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তাদের জানা উচিত, মুজিব হত্যাকান্ডের সময় বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।  শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও রাজনীতিতে ছিলেন না। শেখ মুজিব হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেননি। ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ নেতা মুশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই। এরপর মুশতাকের পতন ঘটে সেটিও ছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দখলের লড়াই।
তিনি বলেন, এই অবস্থায় দেশ বাঁচাতে  ৭ই নভেম্বর সংগঠিত হয় সিপাহী জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব। ওই বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে সিপাহী জনতা সেনানিবাসে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে আনে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ, ৭৫ এর ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের সকল ক্রান্তি লগ্নে জিয়াউর রহমানই সাহসিকতার সঙ্গে দেশ ও জনগণের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সরকার মানুষ হত্যা করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, পিতার মত শেখ হাসিনাও মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছে। বিডিআর বিদ্রোহের নামে পিলখানায় সামরিক বাহিনীর ৫৭ জন মেধাবী অফিসারসহ ৫৪ জনের হত্যার পেছনে শেখ হাসিনা জড়িত। পিলখানায় হত্যাকান্ডর সময় শেখ হাসিনা হাসাহাসি করতে করতে পা বিস্কুট খাচ্ছিলেন এ কথা জানিয়েছেন ততকালীন সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার প্রিয় মঈন।
তারেক রহমান বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর শেখ হাসিনা লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে মানুষ হত্যাও হয়েছে শেখ খায়েশ পূরনের জন্য। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী এবং চেীধুরী আলমসহ বিএনপি এবং বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মীদের গুম খুন অপহরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে শেখ হাসিনার নির্দেশে হয়েছে বলেও তারেক রহমান অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, মতিঝিলে পুলিসের অনুমতি নিয়ে সমবেত হওয়া হাজার হাজার হেফাজত কর্মীদের রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে  করা হয়েছে হাসিনার নির্দেশে।
শেখ মুজিবের পরিবার একটি অভিশপ্ত পরিবার মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, শেখ মুজিবের পরিবারই শুধু খুনীই নন বাংলাদেশের জনগনের জন্য এটি একটি অভিশপ্ত পরিবার। কারণ এই পরিবারের প্রধান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে। তার আমলে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে বটমলেস বাস্কেট হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলো। তার কন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ বিশ্বে দূর্নীতিগ্রস্থ রাষ্ট্রের কলংকজনক তালিকায় প্রথম হয়েছিলো। দ্বিতীয়বার পদ্মাসেতু প্রকল্পের মাধ্যমে টাকা চুরি করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের হাতে ধরা পড়ে বাংলাদেশের ইমেজ বিশ্বে কলংকিত করেছে। আর এখন অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে এরইমধ্যে বিদেশে অবৈধভাবে টাকা পাচারকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, আওয়ামী লীগকে মুক্তাঙ্গনে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ না করে দেড় ঘণ্টার নোটিশে কি উদ্দেশ্যে দলীয় সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করেছিল? এটি প্রমাণ করে শেখ হাসিনা ওইদিনের হামলার ঘটনা সম্পর্কে জানতেন। তিনি ২১শে আগস্টের হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। শেখ হাসিনা কেন জনসভার স্থান পরিবর্তন করেছিলেন সে বিষয়টি তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এই মামলার বিচারকদের প্রতি অনুরোধ জানান তারেক রহমান।
দেশে গনতান্ত্রিক সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, আজ যখন এখানে আমরা সবাই মিলিত হয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে মত বিনিময় করছি, তখন দেশে চলছে একটি গভীর রাজনৈতিক সংকট। একটি  গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে  অগণতান্ত্রিক, অবৈধ ও অনৈতিক আওয়ামী লীগ সরকারের জনবিচ্ছিন্ন তথা আগ্রাসী দমন-নিপীড়ণে সংক্ষুব্ধ হয়ে আছে গণমানুষ।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সর্বোপরি জাতীয় স্থবিরতা থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চাকে পুনঃস্থাপন করা।
প্রায় দুই ঘণ্টার বক্তৃতায় তারেক রহমান বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের পূর্বাপর পরিস্থিতি এবং ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা নিয়ে কথা বলেন। এছাড়া তিনি একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ধর্ম, বিশ্বাস, মত, কিংবা আদর্শ ভিন্ন হতেই পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দেশটা আমাদের সবার।
তিনি বলেন, রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য কেবল ক্ষমতায়ন নয় বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রযাত্রা এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যার মাধ্যমে প্রতিফলন ঘটে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খা আর চাওয়া-পাওয়ার।
দেশকে রাজনৈতিক বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার আহবান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, আমাদের একদিকে যেমন দেশের গৌরবময় অতীতকে একটি নির্দিষ্ট পরিবার ও দলের রাজনৈতিক বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে, অন্যদিকে তেমন বর্তমান অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী তথাকথিত আওয়ামী লীগ সরকারের শোষণ-নির্যাতনের চিত্র সর্বত্র তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি আমাদের আলোচনা করতে হবে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে, দেশের মানুষের সামাজিক সমৃদ্ধি ও আর্থিক স্বনিভর্রতার উপযোগী নীতিমালা নিয়ে।
তারেক রহমান তার বক্তব্যে একটি উন্নয়নশীল ও উৎপাদনমুখী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রূপরেখা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সময়োপযোগী নীতিমালা বিষয়ে তার বিভিন্ন খাতওয়ারী চিন্তাভাবনাসমূহ উপস্থিত পেশাজীবীদের কাছে উপস্থাপন করেন। যে ছয়টি খাতের ওপর তিনি তার রূপরেখা প্রদান করেছেন সেগুলো হচ্ছে- শিক্ষা, শিল্পায়ন, কৃষি, অবকাঠামো, পরিবেশ এবং জ্বালানি।
শিক্ষা খাতে একটি দীর্ঘমেয়াদী ও সুপরিকল্পিত শিক্ষানীতি প্রনয়ন ও বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, মেধাবী শিক্ষার্থীদের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের সুযোগ করে দিতে বৃত্তির ব্যবস্থা করা হলে এবং সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো পুনর্বন্টনের মাধ্যমে তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করে শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
শিক্ষাখাত নিয়ে তার মূল পরিকল্পনাগুলো হচ্ছে-
শিক্ষিত জাতি তৈরির লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও বেশি যুগোপযোগী ও ব্যবহারিক করতে দীর্ঘমেয়াদি  ও সুপরিকল্পিত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা; দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিসেবে ইংরেজি শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা; বহুভাষা শিক্ষার মাধ্যমে রেমিটেন্স ২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা; বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য পাঠ্যসুচিতে খেলাধুলা, সংগীত, নৃত্য, অংকন, অভিনয়, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি চারু ও কারুকলা সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা; পাঠ্যসুচীতে ‘ব্যক্তিগত এবং পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ণ’ নামে নতুন একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কর্মজীবনে বাস্তবমুখী করা; পাঠোত্তর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শতভাগ নাম্বার লিখিত পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ না রেখে এক-তৃতীয়াংশ নম্বর এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন এবং গ্রুপ প্রজেক্টের জন্য বরাদ্দ রাখা; কর্মমূখী শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে গুরুত্ব আরোপ করা হবে এবং এই লক্ষ্যে পৃথক বিভাগ বা মন্ত্রণালয় গঠন করা; কর্মজীবী বাংলাদেশীর সংখ্যা ৫.৫ কোটি থেকে ৮ কোটিতে উন্নয়নের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করে দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের হার মোট জনসংখ্যার ৩১% থেকে ১০% এ কমিয়ে আনা; বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বানিজ্যিকীকরন রোধ করে মান সম্মত উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা; মেধাবী শিক্ষার্থীদের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের সুযোগ করে দিতে বৃত্তির ব্যবস্থা করা; সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো পুনর্বন্টনের মাধ্যমে তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করা এবং শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; এবং মেধা পাচার রোধ করতে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সকল চিকিত্‌সক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিক ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ যেন বাংলাদেশের মাটিতে তাদের পেশাগত দক্ষতা অনুযায়ী কাজের অনুকুল পরিবেশ পান, তা নিশ্চিত করা।
অর্থনীতি ও সার্বিক বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনা করে বাংলাদেশকে একটি শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা একটি সময়ের দাবী উল্লেখ করে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দেশীয় চাহিদা পরিপুরণ, বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এবং রপ্তানির ব্যাপক প্রসার এই তিন লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশের সম্ভাবনাময় ও রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে আলোকপাত করেন।
তিনি বলেন , শিল্পায়নের বহুমুখী পরিকল্পনার দরুন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার বিচারে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য একটি আকর্ষণীয় ক্ষেত্রে পরিণত হবে।
শিল্পখাতে তার রূপকল্পের প্রধান দিকগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশকে একটি শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা; প্রতিষ্ঠিত শিল্পখাতগুলোকে আরও বেশি অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান করা; ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসা সমপ্রসারণের লক্ষ্যে উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত সুবিধা সহজলভ্য করা; গার্মেন্টস শিল্পের মালিক, শ্রমিক, উপাদান সরবরাহকারী ও বিক্রয়কারী, সরকার ও বিদেশি ক্রেতা গোষ্ঠী, সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে শ্রমিকদের বেতন, নিরাপত্তা, এবং সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ এবং স্থিতিশীলতার স্থায়ী সমাধান করা; স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পপার্ক নির্মাণ করা; গার্মেন্টস শিল্প প্রসারের জন্য আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা; কৃষিকে রপ্তানিমূখী শিল্পায়নের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করা যেন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী কৃষি ও খাদ্যপন্যের প্রবেশ নিশ্চিত হয়; মেশিনারিজ শিল্প বিকাশে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা; কৃষি নিভর্র শিল্প, নির্মান কলকারখানা ও যানবাহনের যন্ত্রাংশ তৈরীর শিল্প, হালকা যানবাহন এবং জাহাজ নির্মান ও ভাঙ্গা শিল্পের মত কৌশলগত খাতগুলোকে আর্থিক, ব্যাংকিং, অবকাঠামোগত এবং প্রশিক্ষন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা; প্রযুক্তি নিভর্র ব্যবসা প্রসারে সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করা; ইন্টারনেট সেবা নিরবিচ্ছিন্ন করতে আরেকটি সাবমেরিন কেবল বসানোর ব্যবস্থা করা  এবং পর্যটন শিল্পকে ঢেলে সাজানো (কক্সবাজারে গলফ রিসোর্ট, সিলিকন বিচ, পার্বত্য এলাকায় কেবল কার নির্মাণ, সুন্দরবনে ওয়াটার বেসড সাফারি জঙ্গল, থিম পার্ক ইত্যাদি নির্মাণ)।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে দেশ এবং মানুষ বাঁচানোর পূর্বশর্ত হিসেবে কৃষির মানোন্নয়ন এবং কৃষকের জীবনোন্নয়ন উল্লেখ করে তারেক রহমান সময়ের দাবী অনুযায়ী কৃষক এবং কৃষিকে বাঁচানোর জন্য তার রূপকল্প অনুযায়ী নতুন কিছু ভাবনা ও নতুন কিছু কর্মসূচীর কথা ঘোষনা করেন।
এগুলো হচ্ছে-
কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনকে কৃষকদের কাছে সহজলভ্য করে তোলা; কৃষি ভর্তুকির সর্বোচ্চ উপযোগীতা এবং কৃষকের জন্য সেই ভর্তুকির সুবিধা পাওয়া নিশ্চিত করা; কমপক্ষে ১০-১৫% হার লাভে বিক্রির জন্য কৃষকের অনুকূলে বাজার ব্যবস্থা পুনর্গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা; দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সুষ্ঠু ও সুষম বিতরণ নিশ্চিত করা; কৃষি সংক্রান্ত সকল উপাত্ত এবং তথ্য এক সাথে পাওয়ার জন্য ‘কৃষি তথ্যভান্ডার’ গড়ে তোলা; সমতলের কৃষকদের পাশাপাশি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাহাড়ি কৃষিকে মূল কৃষি পরিকাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা; কৃষিপণ্যে ফরমালিন তথা ভেজাল নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যাবস্থা গ্রহণ করা;
অবকাঠামো খাতে রূপকল্প উপস্থাপন করতে গিয়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বাংলাদেশের অপরিকল্পিত নগরায়নকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ বিষয়ে তার সুপরিকল্পিত পদক্ষেপসমূহ হচ্ছে- দেশের প্রধান ২ টি শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়কের্র আদলে মেট্রোপলিটান এরিয়া গড়ে তোলা; ঢাকা-নারায়নগঞ্জ-গাজীপুর এই তিনটি জেলা নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটান এরিয়া গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে; রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় সকল কল-কারখানা, রাসায়নিক পদাথের্র গুদামসহ পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর সকল স্থাপনা সরিয়ে অন্যত্র স্থানান্তর করা যেখানে সেইসকল কলকারখানার বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা থাকবে; ঢাকার চারপাশ ঘিরে ওভারগ্রাউন্ড রেল চালু করা; নতুন-নতুন রাস্তা গঠনের সাথে-সাথে ঢাকায় প্রবেশ ও নির্গমনের জন্য আরো কয়েকটি পথ নির্মান করা; দেশ জুড়ে নতুন শিল্পাঞ্চল তৈরী করে ঢাকায় অবস্থিত কল-কারখানাগুলোকে সেখানে স্থানান্তরে করা; সরকারী অফিস-আদালতকে কার্যকরভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা; ঢাকার নিকটবর্তী জেলাগুলোয় কয়েকটি আধুনিক স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা; দেশব্যাপী যাত্রীদের চাহিদা মেটাতে সম্পূর্ণ নতুন রেল লাইন স্থাপন, রেলপথে দ্রুতগতির রেলগাড়ী সংযোজন করা; বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের সাথে একই বৈশিষ্ট্যের আন্তর্জাতিক শহরগুলোর মধ্যে পার্টনার সিটি সম্পর্ক গড়ে তোলা; যেমন ঢাকার সাথে লন্ডন, নিউইয়র্ক ও প্যারিস; সমুদ্র বন্দর ও বানিজ্যিক ঐতিহ্যের কারণে চট্রগ্রামের সাথে লস-এঞ্জেলস, মুম্বাই ও সাংহাই ইত্যাদি এবং কৃষিজমি হ্রাস রোধ করতে গ্রামবাসীর জন্য স্বল্প জমিতে বহুতল আবাসন নির্মাণ করা।
আগামী প্রজন্মের স্বার্থে পরিবেশকে দূষনমুক্ত করার বিষয়ে তারেক রহমান গুরুত্ব আরোপ করেন।
পরিবেশ সংক্রান্ত রূপকল্পে তার কার্যতালিকায় প্রধান বিষয়গুলো হচ্ছে-
আগামি প্রজন্মের স্বার্থে পরিবেশ দূষণ রোধে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন কে ৫০ হাজার কিলোটনের নিচে নামিয়ে আনা; কার্বন-ডাই-অঙাইড হ্রাসে পুরাতন বেসরকারী যানবাহনগুলোকে প্রতিস্থাপন করে হাইব্রিড যানবাহনের প্রচলন করা; দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনায়নের লক্ষ্যে সুদুরপ্রসারি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা; শহীদ জিয়ার খাল খনন কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠস্থ জলাধার তৈরী ও সরবরাহের মাধ্যমে পানি সংকট মোকাবেলা করা; ঢাকাসহ সকল বড় শহরে সিঙ্গাপুরের ন্যায় সুপেয় পানি ধরে রাখতে জলাধার তৈরি করে সারাবছর বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা।
পরিবেশবান্ধব গ্রীন এনাজির্র ওপর প্রাধান্য দিয়ে তারেক রহমান তার জ্বালানী বিষয়ক রূপকল্প উপস্থাপন করেন। তিনি সুন্দরবন ধ্বংশ করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের তীব্র সমালোচনা করেন এবং এভাবে পরিবেশকে শেষ করে দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চিন্তা পরিহার করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
জ্বালানী খাতে তার উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনাগুলো হচ্ছে-
বিদ্যুতের দীর্ঘমেয়াদী ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিত করতে মোট উৎপাদনের কমপক্ষে ২৫% নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক জ্বালানী ব্যবহারের প্রকল্প গ্রহন করে ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ২৫,০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করার ব্যবস্থা করা; সৌরশক্তি, বায়ুপ্রবাহ, সমূদ্র স্রোত, বর্জ্য এবং জৈববর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দেওয়া; প্রত্যেকটি বিভাগে সোলার পার্ক স্থাপন করার ব্যবস্থা করা; সুন্দরবনের রামপালে পরিবেশ বিধ্বংসী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চিন্তা পরিহার করা; গ্রীন প্যানেল গঠনের মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব জ্বালানী ব্যবহার নিশ্চিত করা;
তারেক রহমান সবাই মিলে দেশকে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির দিকে এবং জনকল্যানমূলক ও ভবিষ্যৎমুখী সরকারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহবান জানান।
কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ডক্টর এম এ মালিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় আরো বক্তব্য রাখেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান সিরাজুর রহমান, জনাব নসরুল্লাহ খান জুনায়েদ, ব্যারিষ্টার তারিক বিন আজিজ এবং ব্যারিষ্টার নাসির উদ্দিন অসীম প্রমূখ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button