মাদরাসা শিক্ষার্থীরা এবারো ঢাবিতে বৈষম্যের শিকার

এম তৌহিদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে ধারাবাহিকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। দেশের শীর্ষস্থানীয় এ বিদ্যাপীঠের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের প্রথমবর্ষ (স্নাতক) সম্মান শ্রেণীতে ভর্তির ক্ষেত্রে ১৪ বিষয়ে বাধায় পড়বেন তারা। বিভাগগুলোর অতিরিক্ত শর্তারোপে আটকা পড়বেন মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষেও ১২টি বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত শর্তে ভর্তি হতে পারেননি। কয়েক বছর ধরেই এ নিয়ে আইন-আদালত আন্দোলন সবই হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত একচুলও নড়েনি বরং বছর বছর অতিরিক্ত শর্তারোপ করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবরই ‘খোঁড়া অজুহাতে’ বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। অথচ প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়েই মেধা তালিকায় স্থান করে নিচ্ছেন মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে দেশের প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষার্থীরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারের ভর্তিপরীার নির্দেশিকা অনুযায়ী, খ-ইউনিটের অধীনে ২০১৪-১৫ শিাবর্ষের প্রথমবর্ষ স্নাতক শ্রেণীতে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য ১৩টি বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে ২০০ নম্বরের শর্তারোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি বিষয়ে ইসলামি অর্থনীতি অর্থনীতির বিকল্প নয় বলে উল্লেখ আছে। এ বিষয়গুলোর মধ্যে ছয়টি বিষয়ে পুরোপুরি এবং বাকি বিষয়গুলোতে আংশিক শর্তের কারণে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারবেন না।
এর আগে ১৯৯৭ সালে দুইটি, ২০০৪ সালে দুইটি, ২০০৮ সালে তিনটি, ২০১১ সালে দুইটি এবং সর্বশেষ ২০১২ সালে আরো চারটি বিভাগে অতিরিক্ত শর্তারোপ করা হয়। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে আইনে ভর্তির ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ওপর শর্তারোপ করা হলেও প্রয়োজনীয় আসন পূরণ না হওয়ায় বিগত শিক্ষাবর্ষে সে শর্ত তুলে নেয়া হয়। ফলে মাদরাসা ছাত্ররা এ বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলোর মধ্যে ভর্তির ক্ষেত্রে ১৪টি বিভাগে অতিরিক্ত শর্তারোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে যেসব বিভাগের জন্য মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় বাংলা এবং ইংরেজিতে ২০০ নম্বরের শর্তারোপ করা হয়েছে সেগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, ভাষাবিজ্ঞান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারাবিলিটি স্টাডিজ এবং ক্রিমিনোলজি। এ ছয়টি বিভাগে কোনো মাদরাসা ছাত্রই ভর্তি হতে পারবেন না। শুধু উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের শর্তারোপ করা হয়েছে যে বিভাগগুলোতে সেগুলো হলো অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, পপুলেশন সায়েন্সেস, স্বাস্থ্য অর্থনীতি এবং টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন। এ সাতটি বিভাগে যেসব শিক্ষার্থী দাখিল পড়লেও উচ্চমাধ্যমিকপর্যায়ে কলেজে পড়াশোনা করেছেন তারা ভর্তি হতে পারবেন। এর বাইরে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে ভর্তির শর্তে ইসলামি অর্থনীতি, বাণিজ্যিক অর্থনীতি এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি অর্থনীতির বিকল্প নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ইসলামি অর্থনীতি পড়া মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তির পথ রুদ্ধ হবে।
এসব বিষয়ে অতিরিক্ত শর্তারোপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তি ঠেকানোর চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করছেন অনেকে। তারা বলছেন, বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী মাদরাসা শিার্থীরা বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরীা দিয়ে থাকে। এরপরও এ শর্তের কারণে মাদরাসা শিার্থীরা অধিকাংশ ভালো বিষয়ে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের মতো দেশে মৌলিক অধিকার কতটুকু রক্ষা হচ্ছে তা প্রশ্নবিদ্ধ।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ বলেন, এটা মাদরাসা ছাত্রদের সাথে অবশ্যই বৈষম্য। কারণ তারা কী পড়ছে সেটা তাদের ঠিক করা বিষয় নয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সরকারের। এ জন্য মাদরাসা ছাত্ররা কেন বৈষম্যের শিকার হবে? এর মাধ্যমে দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন।
জানা যায়, বহু দিন ধরে এ দেশের শিাব্যবস্থা দুটি ধারায় চলছে। তা হলো মাদরাসা শিা আর সাধারণ শিা। মাদরাসা শিার্থীরা সাধারণ শিার পাশাপাশি অতিরিক্ত কুরআন, হাদিস, আরবি, ফিকহ বিষয়গুলো পড়ে থাকেন। এ কারণে সাধারণ শিার সিলেবাসকে অক্ষুন্ন রেখেই মাদরাসা শিায় বাংলা এবং ইংরেজি বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হতো। তবে সরকার মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় দাখিল এবং আলিমপর্যায়ে বাংলা এবং ইংরেজিতে ২০০ নম্বরের পরীক্ষার বিধান করেছে। সে অনুযায়ী দাখিল এবং আলিমের প্রথম ব্যাচ আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা দেবেন বলে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মাদরাসা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ কে এম ছাইফুল্লাহ বলেন, সরকার মাদরাসা ছাত্রদের সমতার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আশা করি ২০১৫ সালের পর এ বৈষম্য আর থাকবে না। তবে এখনকার বিষয় নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত বছরগুলোতে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা ভর্তিপরীায় মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়া শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়েই মেধা তালিকায় প্রথম দিকে স্থান করে নিয়েছেন। তারপরও শর্ত দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি বিভাগে ভর্তি হতে দেয়া হচ্ছে না কেন সে প্রশ্ন মাদরাসা শিক্ষার্থীদের।
ঢাবিতে ভর্তীচ্ছু মাদরাসা ছাত্র শাহ পরান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়াটা আমাদের অধিকার। এ বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সহিদ আকতার হুসাইন বলেন, এ বিষয়টি আসলে প্রতিটি বিভাগের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তারা যে শর্তগুলো ঠিক করে দেন সেগুলোই পরে ভর্তি কমিটির সভায় পাস করা হয়। এভাবে কত দিন চলবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা একার পক্ষে বলা কঠিন। কারণ সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই এগুলো ঠিক করা হয়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button