স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা নিয়ে প্রবাসীদের ভাবনা

Scotlandনিয়াজ হায়দার, পেশায় মেরিন ইন্জিনিয়ার। পেশার সুবাদে পৃথিবীর নানা দেশে ঘোরাঘুরি করে গত ১৫ বছর আগে গ্লাসগোতে স্থায়ী হয়েছেন প্রবাসী এই বাংলাদেশী।
গ্লাসগোর অভিজাত শহরতলী কারমানক ভিলেজের বাড়িতে থাকেন স্ত্রী মুনমুন হায়দার, পেশায় মনোবিজ্ঞানী। মেয়ে নাদিয়া হায়দার গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করছেন। বাবা এবং মেয়ে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে।
তবে মুনমুন হায়দার এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কেন জানতে চাইলে, মুনমুন হায়দার বললেন, সারা বিশ্বের ব্রিটেনের যে খ্যাতি, যে প্রভাব সেটাকে তিনি উপভোগ করেন।
তবে এখনও বিনে পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবিধা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা–এসবের জন্য মিসেস হায়দার স্কটল্যান্ড নিয়ে গর্বিত। তিনি মনে করেন, স্বাধীন হলে হয়তো এসব সুবিধা রক্ষিত হবে।
“স্বাধীন হলে হয়তো অর্থনৈতিকভাবে স্কটল্যান্ডের ভালো হবে। কিন্তু ব্রিটেন বললে সারা বিশ্বের সবাই চেনে। স্কটল্যান্ডকে কয়টা মানুষ চেনে বলুন?।”
নিয়াজ হায়দার মনেপ্রাণে চাইছেন স্কটল্যান্ডে স্বাধীন হোক। “দেখুন আমি এখন নিজেকে এদেশের মানুষ হিসাবে মনে করি। এরা স্বাধীনতা চায়, সুতরাং এদের আশা আকাঙ্ক্ষার সাথে আমি নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাই।”
তার নিজের তাতে কি লাভ হবে, সে প্রশ্নে নিয়াজ হায়দারের উত্তর ছিল, ব্রিটেনের যুদ্ধবাজ নীতি তার একবারে পছন্দ নয়। সেটা থেকে তিনি নিজেও মুক্তি চান।
নাদিয়া হায়দার গ্লাসগোতে না জন্মালেও বড় হওয়া, লেখাপড়া এই শহরে। স্কটল্যান্ডের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব স্কটিশদের হাতে থাকা উচিৎ বলে যে স্লোগান, তার সাথে তিনি একমত।
কিন্তু স্কটিশ জাতীয়তাবাদী এই আকাঙ্ক্ষার সাথে একজন প্রবাসী, অভিবাসী পরিবারের মেয়ে কিভাবে সম্পৃক্ত হতে পারে? একটু ভেবে নাদিয়া বললেন, অসুবিধা নেই।
“এটা সত্যি আমার গায়ের রং এদের মত নয়, জন্ম এখানে নয়, আমার ইংরেজির উচ্চারণও স্কটিশদের মত নয়। তারপরও কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি বলি আমি গ্লাসগোর। এটাই আমার জায়গা।”
আসলে স্কটল্যান্ডের দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর কাছে এই গণভোট বিশাল একটি সিদ্ধান্ত। তারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন ব্রিটেনে। ব্রিটেন ভেঙ্গে গেলে তাদের অন্য দেশের নাগরিক হতে হবে।
তারপরও স্কটল্যান্ডের দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ খোলাখুলি স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলছেন।
গ্লাসগোতে আওয়াজ এফএম নামে দক্ষিণ এশীয়দের একটি রেডিও স্টেশন আছে। প্রতিদিনই সেখানে স্কটল্যান্ডের গণভোট দিয়ে মানুষজন কথা বলছে। কিছুদিন পর পর তারা শ্রোতা জরিপ করছে। বিভিন্ন জরিপে স্বাধীনতার পক্ষেই বেশি শ্রোতা মতামত দিচ্ছেন।
বিশেষ করে পাকিস্তান থেকে আসা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ স্বাধীন স্কটল্যান্ডের পক্ষে। এসএনপির রাজনীতিতে হামযা ইউসুফের উত্থান, মন্ত্রী হওয়া এটিও পাকিস্তানি সম্প্রদায়ের মতামতকে প্রভাবিত করছে।
সংখ্যার দিক দিয়ে স্কটিশ পাকিস্তানিরা উল্লেখযোগ্য। এক হিসাবে, এক গ্লাসগো শহরে তাদের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের মত।
পাকিস্তানি জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ থাকেন গ্লাসগোর দক্ষিণে পোলকশিল্ড এলাকায়। সেখানকার একটি মসজিদে দুপুরের নামাজের পর কয়েকজনের সাথে কথা বলে কিছুটা আঁচ পাওয়া গেল যে অভিবাসী হিসাবে ব্রিটেনে এলেও, স্বাধীন স্কটল্যান্ডের প্রতি তাদের অনেকেরই সমর্থন রয়েছে।
মোহাম্মদ শোয়েব, পেশায় আইনজীবী, ৩০ বছর ধরে গ্লাসগোতে আছেন। স্বাধীনতার ঘোরতর সমর্থক। কেন?
“কারণ জাতীয়তাবাদী দল এখানে দুই হাজার সাত সাল থেকে ক্ষমতায়। এই কয় বছরে আমরা দেখেছি, স্কটল্যান্ডের ভালো হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বিনে খরচায় পড়াশোনা করা যাচ্ছে, যেখানে ইংল্যান্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে নয় হাজার পাউন্ড টিউশন ফি দিতে হচ্ছে।”
স্বাধীনতার এই দাবির ভিত্তি স্কটিশ জাতীয়তাবাদ। কিন্তু তিনি এসেছেন পাকিস্তান থেকে, একইসাথে মুসলিম। এখানে তার জায়গা ঠিক কোথায়?
উত্তরে মি শোয়েব বললেন, ইউরোপের অন্যান্য দেশের জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সাথে এসএনপি’র কোনো মিল নেই।
“সম্ভবত ইউরোপে একমাত্র এরাই ব্যতিক্রমী একটি জাতীয়তাবাদী দল। তারা অভিবাসীদের পক্ষে কথা বলে। ১৯৪৫ থেকে আমরা অভিবাসীরা লেবার পার্টিকে ভোট দিয়ে আসছি। আমাদের জন্য তেমন কিছুই করেনি তারা।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ টানলেন মোহাম্মদ শোয়েব। “১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো আমাদের বলা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সাহায্য না পেলে বাংলাদেশ টিকবে না। কিন্তু এখন দেখুন। বাংলাদেশের টাকা পাকিস্তান রুপীর চেয়ে শক্তিশালী। বাংলাদেশের জিডিপি পাকিস্তানের চেয়ে আড়াই শতাংশ পয়েন্ট বেশি। সুতরাং এই যে ভয় দেখানো হচ্ছে যে স্বাধীন হলে স্কটল্যান্ড বিপদে পড়বে, আমি বিশ্বাস করিনা।”
পোলকশিল্ডের ঐ মসজিদে নামাজ পড়তে আরো এসেছিলেন রিয়াজ মহম্মদ। গ্লাসগোতে জন্ম। ৫২ বছর ধরে এই শহরেই। গ্লাসগোর পাতাল রেলে চাকরি করেন। ব্রিটেনের সাথে থাকার পক্ষে তিনি।
“আমি বিশ্বাস করি ব্রিটেনের সাথেই স্কটল্যান্ড ভালো আছে। মন্দা থেকে উত্তরণ হচ্ছে। কেন আবার একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে যেতে হবে, আমি বুঝতে পারছি না। এখন থেকে পঞ্চাশ বছর পর স্বাধীনতা আসলে হয়তো ভালো হতে পারে, কিন্তু এখন নয়।”
যাওয়ার আগে বললেন শুধু আশঙ্কা থেকে নয়, ব্রিটেনের প্রতি অনুগত্য থেকেই তিনি ব্রিটেনের সাথে থাকার পক্ষে। “রানীর প্রতি আমার আনুগত্য রয়েছে। এবং আমি বিশ্বাস করি ব্রিটেনের সাথে থাকাটাই স্কটল্যান্ডের জন্য ভালো।”

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button