স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা প্রশ্নে পক্ষ-বিপক্ষ মুখোমুখি
স্বাধীন স্কটল্যান্ড তাদের সংসদ ভেঙ্গে বৃটেনের অংশ হয়েছিলো ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে। স্কটিশ সংসদ নিজ থেকেই সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, কিন্তু বিতর্ক আছে, ইংরেজরা ভয় দেখিয়ে উৎকোচের লোভ দিয়ে সেই ট্রিটি অব ইউনিয়ন অর্থাৎ সেই ভূ-রাজনৈতিক ঐক্যের চুক্তি পাস করিয়ে নিয়েছিল।
স্কটিশদের বিশাল একটি অংশ সবসময়ই ওই ঐক্যকে দেখেছে ইংরেজদের হাতে পরাধীনতা হিসাবে এবং এই দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্নভাবে তিনশ বছরের সেই ইতিহাস বদলাতে চেয়েছে তারা।
সেই দাবির ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ তে স্বায়ত্তশাসন পায় স্কটল্যান্ড, আর তার ১৬ বছর পর ১৮ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতার প্রশ্নে হচ্ছে গণভোট।
পক্ষে-বিপক্ষে প্রচার-প্রচারণা এখন তুঙ্গে। একপক্ষ বলছে স্বাধীনতা স্কটিশদের জন্য সমৃদ্ধি, সম্মান এবং ন্যায়-ভিত্তিক সমাজ নিশ্চিত করবে। অন্যপক্ষ বলছে বৃটেনের সাথে থাকাই নিরাপদ। স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী যে দলটির দাবির মুখে বৃটিশ সরকার এই গণভোট দিতে রাজী হয়, সেই স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি বা এসএনপি এখন স্কটল্যান্ডের আঞ্চলিক সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং আঞ্চলিক সরকারের ক্ষমতায়। কেন তারা স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা চাইছেন, এতে লাভ কী হবে- বিবিসি বাংলার কাছে এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজী হন দলের কেন্দ্রীয় নেতা এবং স্কটিশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামযা ইউসুফ।
তার প্রথম যুক্তি ছিল গণতন্ত্র। “এডিনবারা চিড়িয়াখানায় যেখানে পান্ডার সংখ্যা দুটো, সেখানে স্কটিশ সংসদে মাত্র একজন টোরি এমপি। অথচ সেই কনজারভেটিভ পার্টি লন্ডনে বসে স্কটল্যান্ডের ভাগ্য নির্ধারণ করছে, আমাদের অর্থনীতির সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, আমাদের অভিবাসনের নীতি, আমাদের প্রতিরক্ষা নীতি, আমাদের বিদেশ নীতি কি হবে সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী।” দ্বিতীয় যুক্তি অর্থনৈতিক। হামযা ইউসুফের কথা ছিল বৃটিশ সংসদে বসে স্কটল্যান্ডের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় স্কটল্যান্ডের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। “একুশ শতকের স্কটল্যান্ডে গ্লাসগো শহরে হাজার হাজার মানুষ ফুড ব্যাংকে ভিড় করছে। অথচ এই স্কটল্যান্ডেরই আছে তেল সম্পদ, মৎস্য সম্পদ, আধুনিক প্রযুক্তি।”
এসএনপির নেতারা বলছেন স্কটল্যান্ডের যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তার বিকাশে স্বাধীনতা প্রয়োজন। তারা বলছেন সাগরে ২৪০০ কোটি ব্যারেল তেল মজুদ রয়েছে। রপ্তানি আয় ২৫০০ কোটি পাউন্ড। স্কটল্যান্ড স্বাধীন দেশ হলে, এসব আয় নিয়ে মাত্র ৫০ লাখ জনসংখ্যার এই দেশ বিশ্বের চতুর্দশ ধনী দেশ হবে। অথচ এসব রাজস্ব আয় সব চলে যাচ্ছে লন্ডনে। তার হিস্যা কতটা স্কটল্যান্ডে আসছে ঠিক নেই।
এসএনপি এখন স্বাধীনতার এই আকাক্সক্ষাকে জাতীয়তাবাদী চেতনা হিসাবে যত না দেখাতে চাইছে, তার চেয়ে অর্থনৈতিক যুক্তিটাকেই তুলে ধরতে চাইছে। যেমন হামযা ইউসুফ বার বার বলার চেষ্টা করছিলেন এসএনপি কোনভাবেই তথাকথিত জাতীয়তাবাদী দল নয়। নিজের উদাহরণ দিলেন তিনি।
“আমার দিকে তাকান। আমার বাবা পাকিস্তান থেকে আসা অভিবাসী। আমি এখন মন্ত্রী। আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার পেছনে কোনো সস্তা জাতীয়তাবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনা নেই। আমরা শুধু চাই, স্কটল্যান্ডের ভালোমন্দের সিদ্ধান্ত স্কটল্যান্ডের মানুষের হাতে থাকতে হবে।”
স্বাধীনতার বিপক্ষে যুক্তিতর্ক
এসএনপি ছাড়া বৃটেনের অন্যসব মূলধারার রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার বিপক্ষে প্রচারণা চালাচেছ। বেটার টুগেদার নামে এই প্রচারণার নেতৃত্ব দিচ্ছে লেবার পার্টি, যারা স্কটিশ সংসদে প্রধান বিরোধী দল। বৃটিশ সংসদের নির্বাচনে স্কটল্যান্ড থেকে এখনও সবচেয়ে বেশি আসন পায় লেবার পার্টি। কেন তারা স্বাধীনতার বিরোধী- এ প্রশ্নে স্কটিশ লেবার পার্টির সাবেক এমপি এবং বেটার টুগেদার ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র ডেভিড হুইটলান গ্লাসগোতে তাদের অফিসে বসে যুক্তি দিলেন তিনশ বছরের, তার ভাষায়, অত্যন্ত সফল এক ঐক্য ভাঙার কোনো যুক্তি নেই।
“স্কটল্যান্ড কতগুলো জাতির সমন্বয়ে তৈরি একটি পরিবারের অন্যতম সদস্য। অন্য সদস্যরা হচ্ছে ইংল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড। তিনশ বছর ধরে মিলিত এই পরিবার অত্যন্ত ভালোভাবে চলছে। কেন আপনি এই ঐক্য ভাঙবেন? বিভিন্ন দেশ যেখানে প্রভাব বাড়াতে আরো ঐক্যবদ্ধ হতে চাইছে, সেখানে বিচ্ছিন্ন হতে হবে কেন?” মি হুইটলানের প্রধান যুক্তি ছিল, বৃটেন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ, জি-সেভেন জোটের অংশ, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য। স্কটল্যান্ড আলাদা হলে কোনো প্রভাবই তাদের থাকবে না। “পঞ্চাশ লাখ লোকের আলাদা ছোট একটি দেশ হওয়ার চেয়ে ছয় কোটি সদস্যের বৃহত্তর একটি পরিবারের সদস্য হওয়া অনেক ভালো।”
‘ইয়েস’ ক্যাম্পেইনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে “নো” ক্যাম্পেইন থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষকে ভয় দেখানো হচ্ছে। যেমন স্বাধীন হলে মানুষের পেনশন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, পাউন্ড থাকবে না, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পালিয়ে যাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পাবে না স্বাধীন স্কটল্যান্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। মি হুইটলান বললেন, ইস্যু যখন স্বাধীনতা তখন কঠিন কিছু প্রশ্নের উত্তর চাওয়া তাদের দায়িত্ব।