বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেল ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রসঙ্গ

Indian TV channelমেহেদী হাসান পলাশ :
পাখি নিয়ে তোলপাড় বাংলাদেশ। এ পাখি বাংলাদেশের পাখি নামের কোনো নারী নয় বা আকাশে ওড়া কোনো পাখিও নয়। এ পাখি ভারতীয় বাংলা চ্যানেল স্টার জলসার ‘বোঝে না সে বোঝে না’ সিরিয়ালের নায়িকা চরিত্র পাখি। এটি মূলত একটি হিন্দি সিরিয়াল। মূল সিরিয়ালিটি স্টার প্লাস চ্যানেলে দেখানো হয়। স্টার প্লাসে এই চ্যানেলের নাম ‘ইস পেয়ার কো কিয়া নাম দো’। সিরিয়ালটি বাংলাদেশে এতই জনপ্রিয় হয়েছে যে, সিরিয়ালে পাখির পরিধেয় পোশাক, অলঙ্কার বাংলাদেশের তরুণী-কিশোরী সকলের কাছে হট কেকের মতো হয়েছে। বিগত ঈদে বাংলাদেশের বাজার ছেয়ে গেছে পাখি ড্রেসে। অবশ্য প্রত্যেক ঈদেই বাংলাদেশের বাজার ভারতীয় পোশাকে সয়লাব হয়ে যায়। এর মধ্যে বলিউডি নায়িকা কিম্বা ভারতীয় চ্যানেলের জনপ্রিয় সিরিয়ালের নায়িকাদের নামের পোশাকগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করে। এর মধ্যে গত বছর ভারতীয় বংশোভূত কানাডিয়ান পর্নো ছবির নায়িকা ও অধুনা বলিউডের নায়িকা সানি লিওনের ড্রেস বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়েছিল। তার মতো এক পর্নো নায়িকা বাংলাদেশের তরুণী-কিশোরীদের আইডল হওয়ায় অভিভাবকদের মধ্যে শঙ্কা ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। নৈতিক বিচারে সানি লিওনকে সরিয়ে পাখির আগমন সে উদ্বেগ কিছুটা হলেও প্রশমিত করেছে।
বিগত ঈদুল ফিতরে পাখি ড্রেস না কিনে দেয়ায় অভিমানে আত্মহত্যা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাকের মতো ঘটনা ঘটেছে। উল্লিখিত ঘটনাগুলোকে ডকুমেন্ট হিসেবে উপস্থাপন করে বাংলাদেশে কয়েকটি ভারতীয় চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করতে আদালতের নির্দেশ চেয়ে রিট দায়ের করেছিলেন এক আইনজীবী। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে ভারতীয় তিন টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে দায়ের করা রিটটি খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। গত মঙ্গলবার আদালত এ আবেদনটি নট প্লেসড আদেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ আদালত বলেছেন, আবেদনটি ফাইল করা হয়নি এ মর্মে খারিজ করে দেয়া হলো। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে গত ৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ ভারতীয় তিন টিভি চ্যানেল বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে একটি রিট দায়ের করেন আইনজীবী শাহীন আরা লাইলী। তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট এখলাস উদ্দিন ভূঁইয়া। রিটের বিষয় এখলাস উদ্দিন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসায় প্রচারিত ধারাবাহিক ‘বোঝে না সে বোঝে না’ দেখে পাখি নামের বিশেষ একটি পোশাকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এ দেশের কিশোরীরা। ওই পোশাক কিনতে না পেরে বাংলাদেশে একাধিক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। এ কারণে বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে তিনি একটি রিট দায়ের করেছিলেন। তবে এখলাস উদ্দীন ভূঁইয়ার এই যুক্তি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তিনি যা বলেছেন, তা যদি সত্যিকারভাবে বিশ্বাস করতেন তবে ভারতীয় বাংলা চ্যানেলের সাথে হিন্দি চ্যানেলগুলোকেও যুক্ত করতেন। কেননা তার এই রিটে যদি রায় তার পক্ষে আসতো তাহলে ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার এ দেশে বন্ধ হয়ে যেত, কিন্তু হিন্দি চ্যানেলগুলোর প্রচার অব্যাহত থাকতো। ফলে দর্শকরা ভারতীয় বাংলার পরিবর্তে ভারতীয় হিন্দি চ্যানেল দেখতে শুরু করতো। তাতে পাখি ড্রেসের পরিবর্তে আসতো খুশী ড্রেস, উসশী, কনকের শাড়ির পরিবর্তে সানধিয়া, গোপী শাড়ি। ফলাফল একই থাকতো।
বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের দাবি নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনতা, সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এ দাবি করে আসছেন। তাদের দাবি এসকল চ্যানেলে এমন সব অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে যা বাংলাদেশের সংস্কৃতি-কৃষ্টি, মূল্যবোধ প্রভৃতি ধ্বংস করে দিচ্ছে। কিন্তু তাতে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হয়নি। বরং প্রবল বিরোধিতার মুখেও ভারতীয় চ্যানেলগুলোর জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে। ইদানীং আরেকটি নতুন শ্রেণীর জন্ম হয়েছে। এ শ্রেণী বাংলাদেশের বেসকারি টিভি চ্যানেল মালিক সম্প্রদায়। তাদের অবশ্য সংস্কৃতি-কৃষ্টি, মূল্যবোধ রক্ষার বালাই নেই। স্রেফ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই তারা বিরোধিতা করছেন- এটা বুঝতে কারো কষ্ট হয় না। কারণ দর্শকরা ভারতীয় চ্যানেল দেখায় তারা কাক্সিক্ষতহারে বিজ্ঞাপন পাচ্ছেন না। আবার অনেক কোস্পানি এখন সরাসরি ভারতীয় চ্যানেলে সরাসরি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। ভারতীয় চ্যানেল মালিকরাও বাংলাদেশী বিজ্ঞাপনী মাকের্ট ধরার জন্য এদেশে এজেন্ট নিয়োগ করেছে। নিয়োগকৃত এজেন্টরা বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোর কাছে দর্শক জরিপ উপস্থাপন করে বলছে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলের চেয়ে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের দর্শক এদেশে বেশি, কাজেই ভারতীয় টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেয়া তাদের পণ্যের পসারের জন্য অধিক লাভজনক। এতে কাজও হয়েছে। কোনো কোনো বাংলাদেশী কোম্পানি আবার ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের সরাসরি টাইটেল স্পন্সর হয়ে অনুষ্ঠান নির্মাণ করছে। আবার যেসকল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পণ্য বাজারজাত করে তাদের বড় অংশও বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন না দিয়ে ভারতীয় চ্যনেলে বিজ্ঞাপন দিয়েই বাংলাদেশের মার্কেটে তাদের প্রচার কাজ সম্পন্ন করে। তারা ভালো করেই জানে বাংলাদেশের দর্শকদের মাঝে ভারতীয় টিভির জনপ্রিয়তার কথা। এতে করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
এদিকে বাংলাদেশী দর্শকদের কথা মাথায় রেখে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোও তাদের লাইভ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশী দর্শকদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। সিরিয়ালগুলোতে বাংলাদেশী বাংলা ভাষা ব্যবহার করছে। এসকল কিছুই বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলের জনপ্রিয়তা দিনদিন বৃদ্ধি করে চলেছে। বিশেষ করে ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোর। একসময় বাংলাদেশের স্যাটেলাইট দর্শক ভারতীয় হিন্দি চ্যানেল জিটিভি, স্টার প্লাস, সনি টিভি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন সে অবস্থা পাল্টেছে। ভারতীয় হিন্দি চ্যানেলের জায়গা ক্রমশঃ দখল করে নিচ্ছে কোলকাতার বাংলা চ্যানেল স্টার জলসা, জি বাংলা, ইটিভি বাংলা, তারা টিভি, আকাশ বাংলা প্রভৃতি। এ চ্যানেলগুলো তাদের মূল হিন্দি চ্যানেলের সিরিয়াল বাংলায় পুনঃনিমার্ণ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। যেমন স্টার জলসাতে হিন্দি স্টার প্লাসের বেশ কিছু সিরিয়াল বাংলায় পুনঃনিমার্ণ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর মধ্যে, বোঝে না সে বোঝে না (ইস পেয়ার কো কিয়া নাম দো), বধুবরণ (সাথ নিভানা সাথিয়া), তুমি আসবে বলে (মহব্বতিন), তোমায় আমায় মিলে (দিয়া অর বাতি হাম)। এ সিরিয়ালগুলো বাংলায় ডাবিং না করে কোলকাতার চ্যানেলগুলো বাঙালি সংস্কৃতির আদলে পুনঃনির্মাণ করায় তা বাঙালি দর্শকদের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। হিন্দি সিরিয়ালের বাংলা পুনঃনিমার্ণের পাশাপাশি এ চ্যানেলগুলোর নিজস্ব সিরিয়ালগুলোও বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মা, কেয়া পাতার নৌকা, সোনার হরিণ, আস্থা সিরিয়াল ছাড়াও বেহুলা, দুর্গেশনন্দনী, কিরণমালার মতো ঐতিহাসিক কিম্বা রূপকথার সিরিয়ালগুলো তারা যে বিশাল ক্যানভাসে নির্মাণ করেছে তা হিন্দি চ্যানেলগুলোকে হার মানায়। আর এভাবেই অনুষ্ঠানের মান ও জনপ্রিয়তা দিয়ে ভারতীয় হিন্দি চ্যানেলের দাপট কমিয়ে বাংলাদেশের দর্শকদের মাঝে স্থান করে নিচ্ছে ভারতীয় বাংলা চ্যানেল।
কিন্তু বাংলাদেশী চ্যানেল মালিকরা সেদিকে যেতে রাজী নন। তারা কোয়ালিটি দিয়ে নয়, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দর্শক ধরতে চাইছেন। তারা ভারতীয় চ্যানেলগুলো জনপ্রিয়তার কারণগুলো খুঁজে দেখেন না, তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হারানোর চিন্তা করেন না। সে বিচারে বলতে গেলে বলতে হয়, বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর নির্মাতা ও মালিকদের অতি মুনাফাখোরী মনোবৃত্তি, অতি বাণিজ্যিক ভাবনা ও নিম্নমানের অনুষ্ঠান প্রচারের কারণেই ভারতীয় চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের বাজারে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে। বাংলাদেশের দর্শকরা এখনো কোলকাতার বাংলা বা ভারতীয় হিন্দি অনুষ্ঠানের চেয়ে মানসম্পন্ন বাংলাদেশী অনুষ্ঠান বা সিরিয়াল পেলে তা দেখতেই বেশি পছন্দ করে। বাংলাদেশে ইত্যাদি অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা এখনো কোনো ভারতীয় অনুষ্ঠানই কমাতে পারেনি। যখন বিটিভিতে ইত্যাদি চলে তখন বাংলাদেশের দর্শকরা ভারতীয় টিভি দেখে- এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না খুব একটা। কিন্তু বাংলাদেশী দর্শকদের এই সন্তষ্টির বিষয়টি এদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল মালিকরা কোনোদিনই গুরুত্ব দেয়নি। যে টিভি চ্যানেলগেুলোতে ভোক্তা অধিকার নিয়ে এত সংবাদ প্রচার হয়, টক শো হয়, সেই টিভি চ্যানেলগুলোর নিজস্ব অনুষ্ঠানে ভোক্তা অধিকার কতটুকু মানা হয়- সে আত্মবিশ্লেষণ নেই এখানে।
বাংলাদেশী টিভি দর্শকদের অভিযোগ, অতি নিম্নমানের অনুষ্ঠানের কারণেই তারা দেশীয় চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখেন না। তাদের মতে, নির্মাতা ও টিভি চ্যানেল মালিকগণ যেকোনো প্রকারে একটি অনুষ্ঠান নিমার্ণ করে চাঙ্ক পূরণ ও সর্বাধিক আর্থিক সুবিধা নিতে সচেষ্ট থাকেন। একটি অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা, স্ক্রিপ্ট তৈরি, আকর্ষণীয় কাহিনী রচনায় তারা গুরুত্ব দেন না। বাংলাদেশী সিরিয়ালগুলো দর্শক হারানোর পেছনে প্রধান কারণ কাহিনীর দুর্বলতা, নিম্নমানের প্রডাকশন, অভিনয়ের দুর্বলতা এবং বিজ্ঞাপনের আধিক্য। বাংলাদেশী টিভি সিরিয়ালগুলো সপ্তাহে ২/৩ দিন দেখায়, সে তুলনায় ভারতীয় বাংলা সিরিয়ালগুলো সপ্তাহে ৫/৬দিন দেখায়। এতে দর্শকরা অনেক বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। কোলকাতার টিভি সিরিয়ালে সময়ের সাথে কাহিনীর সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ বিভিন্ন উৎসবের সময় ওদের কাহিনীগুলোও উৎসবনির্ভর থাকে। ফলে দর্শকদের কাছাকাছি যেতে সমর্থ হয় অনেক বেশি। আবার কোলকাতার নাটকের কাহিনীতে প্রতি পূর্বেই যে ক্লাইমেক্স, সাসপেনশন থাকে বাংলাদেশের নাটকের কাহিনীতে তা একবোরেই অনুপস্থিত। বাংলাদেশী নাটকে জনপ্রিয়তা আনতে বেশিরভাগ সময় হাস্যরসের আশ্রয় নেয়া হয়। কিন্তু হাস্যরস বা রম্য রচনার নামে বাংলাদেশী নাটকে যে জিনিস দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হয় তাকে ভাড়ামো ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। বাংলাদেশী কাহিনীকারগণ নাটকের কাহিনীতে হাস্যরস সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়ে আঞ্চলিক ভাষায় স্থিত রসের আশ্রয় নেন। বাংলাদেশী নাটকে রম্যকাহিনী মানে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক চরিত্র তৈরি করে আঞ্চলিক ভাষায় সৃষ্ট খিচুড়ি ভাষা বলা যায়। অথচ এদেশে অনেক ভালো কাহিনীকার, নির্মাতা ও অভিনেতা আছে। বাংলাদেশী তরুণ কৌতুক অভিনেতারা ভারতে গিয়ে মীরাক্কেল অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রতিযোগীদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন, রানার আপ হয় প্রত্যেকবার। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল মীরাক্কেলের কাছাকাছি মানের অনুষ্ঠান নির্মাণের কথা কল্পনাও করতে পারে না। ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নির্মাতা ও চ্যানেল মালিকদের অতি মুনাফাখোরী মনোবৃত্তির কারণে তার কোনো সুফল দর্শকরা পায় না। আবার কোনোভাবে যদি একটি নাটক জনপ্রিয় হয়, তাহলে তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে টিভি চ্যানেল মালিকরা এতো বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করে যে দর্শকরা বিরক্ত হয়ে নাটক দেখা বাদ দেয়। ঈদের টিভি নাটকগুলোতে দেখা যায়, এক ঘন্টার একটি টিভি নাটক আড়াই থেকে তিন ঘণ্টায় শেষ হয়। বিজ্ঞাপন ও খবরের বিরতি দিয়ে এই বিপুল সময় তারা নষ্ট করে। অন্যদিকে আধা ঘণ্টার সিরিয়ালে এনিমেটেড প্রারম্ভিকা ও সমাপ্তি, গত পর্বের রিক্যাপ, আগামী পর্বে যা দেখানো হবে নামে ৬/৭ মিনিট সময় নষ্ট করা হয়। ১০ মিনিট বিজ্ঞাপন ও অন্য অনুষ্ঠানের প্রমো প্রচার করে মূলত নাটক দেখানো হয় সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট। আর এভাবেই বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলো ভারতীয় টিভি চ্যানেলের কাছে মার খাচ্ছে। দর্শক হারাচ্ছে। বলিউডি মার্কেটের সাথে ঢালিউডি মার্কেটের তুলনা অবাস্তব, কথাটি সত্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী দর্শকদের সংখ্যার সাথে বাংলাদেশী বাংলাভাষী দর্শকদের সংখ্যার তুলনা কোনেভাবেই অবাস্তব নয়। সেকারণে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন আমরা ভারতীয় বাংলা টিভি চ্যানেলের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারবো না? কেন ঢালিউড টলিউডের কাছে মার খেয়ে গেল। এক দশক আগেও টলিউডি নায়িকারা বাংলাদেশে সিনেমার অফার পেলে হাতে চাঁদ পেতেন। অনেকে ঢালিউডে অভিনয় করার জন্য এখানে ঘর-সংসার পেতেছেন। আর এখন বাংলাদেশী নায়কেরা টলিউডি সিনেমায় অভিনয়ের অফার পেয়ে সংবাদ সম্মেলন করে গর্বের সাথে প্রচার করেন। বিষয়গুলো যদি বাংলাদেশের নির্মাতা ও টিভি চ্যানেল মালিকগণ বিবেচনা করে উত্তোরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাহলে বোধকরি অন্যের দিকে আঙুল তোলার প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।
এ কথা সত্য যে, ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা টিভি চ্যানেলে যেসকল অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়, তার অনেক কিছুই বাংলাদেশের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, কৃষ্টি ও ইতিহাসের সাথে সাংর্ঘষিক। সে বিচারে আমাদের অবশ্যই এসকল টিভি চ্যানেলের বাংলাদেশে সম্প্রচারের ব্যাপারে সেন্সরশীপ থাকা উচিত বলে মনে করি। এ সকল টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে সাংস্কৃতিক বশ্যতা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তার প্রতিরোধ অবশ্যই জরুরি। তাছাড়া সংস্কৃতি এখন শুধু নিছক বিনোদন বা আগ্রাসনের বিষয় নয়, সংস্কৃতি এখন পণ্যও। তাই এর বাণিজ্যিক গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সেকারণে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বাজার আমরা কোনো নির্দিষ্ট দেশের জন্য একতরফাভাবে উন্মুক্ত করে দিতে পারি না। দ্বিপাক্ষিক সমতাভিত্তিক বিনিময় হতে পারে একমাত্র সমাধান। তবে দূষিত বা ক্ষতিকর পণ্য বিনিময়, বাণিজ্য ও বাজারজাত যেমন সবদেশেই নিষিদ্ধ, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর অনুষ্ঠান বা টিভি চ্যানেলের প্রচার নিষিদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button