ঈদ : কৈশোর স্মৃতি
আবদুল হামিদ মানিক
সংসারের ভার যত বাড়ে শৈশব-কৈশোরের ভারমুক্ত দিনগুলোর সুখ-স্মৃতি ততই বুঝি জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনে হচ্ছে, এই তো সেদিন ফেলে এসেছি বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো বাঁধনহারা আনন্দের শৈশব-কৈশোর। ঈদ এলে অনেকের মতো আমিও তাই আনন্দঘন স্মৃতির মুরববা খেয়ে তৃপ্তি পাই। গ্রামের ছোট বড় অনেকের প্রাণবন্ত মুখ স্মৃতির আয়নায় দেখে বিমল আনন্দ উপভোগ করি। মনে আছে, রোজার প্রথম দিক থেকেই দিন গুনতে শুরু করতাম। শুধু ঘরে ভাইবোনদের মধ্যে নয়, বাড়ির এমনকি পাড়ার সমবয়েসীদের মধ্যে ঈদ নিয়ে কথাবার্তা শুনতাম। কী উত্তেজনা শিশু-কিশোরদের ভুবনে। ঈদের জন্য কী দারুণ অপেক্ষা। দেখতে দেখতে এক সময় সত্যই ঘনিয়ে আসতো কাঙ্ক্ষিত সেই অবকাশ। বড়দের মধ্যেও শুরু হতো তোড়জোড়। আমাদের কৈশোরে ঈদে নতুন জামা-কাপড় ছিল প্রধান আকর্ষণ। রেডিমেড গার্মেন্টসের প্রচলন প্রায় ছিল না। বাজার থেকে কাপড় কেনা হতো। বাড়িতে আসতেন দরজি ফিতা নিয়ে। মাপজোঁক নিয়ে যেতেন। শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে নিজেই দাদার সঙ্গে বাজারে গিয়ে দিয়ে আসতাম মাপ। শুরু হতো মনে মনে প্রার্থনা, আমার সার্টটা যেন সব চাইতে বেশি সুন্দর হয়। এ প্রার্থনাই শেষ নয়। দরজির ঘর থেকে কাপড় না আসা পর্যন্ত শঙ্কা ও ভয়। দরজি যদি যথাসময়ে না দেয়। এমনি উদ্বেগ ও আনন্দে চলতো প্রস্ত্ততি। নতুন জামা যারা পাচ্ছেনা তাদের চলতো কাপড় ধোয়ার ধুম। ইস্ত্রির ব্যবস্থা সুলভ ছিলনা। কাপড় ধুয়ে ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে ইস্ত্রির কাজ সারা হতো। ঈদের সময় বাড়ি আসতেন দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা পরিবারের সদস্যরা। নিয়ে আসতেন জুতা, গেঞ্জি এবং টুকটাক উপহার। ঈদের আগে রোজা ঊনত্রিশ না ত্রিশ হবে-এ প্রশ্নে বড়রা মাতামাতি করতেন। চাঁদ দেখার জন্য আমরা অধীর অপেক্ষায় থাকতাম। আমাদের বাড়ির মসজিদ ও বাঁধানো পুকুর ঘাটে প্রতিদিন পাড়ার অনেকে জড়ো হতেন। ইফতার দেয়া হতো পালাক্রমে। ঈদের চাঁদ দেখার এই জটলা থেকে হঠাৎ কেউ বলে উঠতেন, ঐ ঐ চাঁদ! চাঁদ দেখেই আমরা কাঁসার ঘন্টাতে জোরে ঢংঢং শব্দ তুলতাম। চাঁদ না দেখলে বিমর্ষ চিত্তে বড়দের সিদ্ধান্তের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। ঈদের আগের রাতেও উত্তেজনায় ঘুম হতো না। খুব ভোরে গোসল করতে হবে। কে কার আগে পুকুরে যাবে। আমাদের ধারণা ছিল, ঈদের দিন পুকুরের পানি জমজমের পানি হয়ে যায়। দেরি হলে তা আর জমজমের থাকেনা। ভোরে উঠেই হৈ হুল্লোড়। পুকুরে সাঁতার কাটার ধুম। গোসল সেরে সাজবার পালা। চোখে সুরমা, পরনে নতুন জামা, পাজামা, প্যান্ট অথবা লুঙ্গি, মাথায় টুপি, গায়ে সুগন্ধি আতর। সামান্য মিষ্টি জাতীয় কিছু খেয়ে দল বেঁধে ঈদগার দিকে যাত্রা। সবাই যেন খুশিতে বিভোর। ঈদগাহ থেকে ফিরে দল বেঁধে ঘরে ঘরে গিয়ে চাচা, চাচী, দাদী, ফুফু, ভাবীদের পায়ে ধরে সালাম করতাম। বিনিময়ে পেতাম রকমারি খাবার, আদর ও দু-চার আনা বখশিস। প্রত্যেক ঘরেই পিঠা, ফিরনি, সেমাই খেতে হতো। সরব হয়ে উঠতো সারা গ্রাম। বড়দেরও আনাগোনা চলতো সারাদিন। টঙ্গিঘরে অথবা পুবের ঘরে বসতো বড়দের আড্ডা। যোগান দেয়া হতো চা-নাস্তা, পান-তামুক। একদিনেই ঈদের খুশি শেষ নয়। খেলাধুলা, কবর জিয়ারত, দাওয়াত, জিয়াফত এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে সবাই উপভোগ করতেন ঈদ। সেই কৈশোরে-ষাটের দশকে বিনোদন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নির্ভর ছিলনা। টিভি-ভিসিআর নেই। সামনা সামনি বসে গালগল্প, দিনভর আড্ডা, কিশোরদের ছুটাছুটি ও খেলা ছিল আনন্দের অনুষঙ্গ। ঈদে মেয়েদেরও আনন্দের কমতি ছিল না। মা, বোন, দাদী, চাচী সবাই নতুন শাড়ি চুড়ি পেয়েছেন। নিজেরা মার্কেটে যাননি; কিন্তু কারো চাহিদা অপূর্ণ থাকেনি। ঈদ এভাবে আনন্দের ঢেউ তুলতো। তবে অন্দরের আনন্দ ছিল মূলত খাবার দাবার তৈরির। ঈদের আগেই চারদিক থেকে ভেসে আসতো চালের গুঁড়ি কুটার গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। রাইসমিল তখনো সুলভ নয়। ঘাইল-ছিয়া অথবা ঢেঁকিতে গুঁড়ি হতো। রকমারি পিঠা বানাতেন মহিলারা। নকশী করা বিচিত্র ডিজাইনের। তবে ডুবো তেলে গুঁড়ির গুড় দিয়ে তৈরি সন্দেশ (মালফা) ছিল প্রধান। এই পিঠে-পুলি বানিয়ে এবং খাইয়ে মা-বোনেরা পেতেন পরম আনন্দ। ঘরে ঘরে অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলতো। প্রতিটি পরিবার নিজের খাবার ফর্দ গোপন রাখতো। ফিরনি, পায়েশ, পোলাও, সন্দেশ, সেমাই ছিল ঈদের খাবার। গরিবের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া হতো। অনেক ক্ষেত্রে গোপনে, এ আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে মহিলারা সাজগোজের আনন্দও ভোগ করতেন। তবে কসমেটিকসের বাড়াবাড়ি ছিল না। মা, চাচী, ভাবীরা গোসল সেরে একটু দেরিতে নতুন কাপড় পরতেন। আমরা সালাম করতাম। এখন যুগ বদলেছে, খাবার-দাবার-বিনোদনে, পোশাক-আশাকে জৌলুস এসেছে। অথচ মূল যে জিনিসটি চাই সেটিই যেন নেই। কেমন করে নিষ্প্রাণ হৈ চৈ, ব্যক্তি বা পরিবার কেন্দ্রিক সবকিছু। বাইরে চাকচিক্য, ভেতর ফাঁকা ফাঁকা। কৃত্রিম যান্ত্রিকতায় ক্লান্ত হয়ে তাই ঈদের সময় স্মৃতির ডানায় ভর করে পেছন ফিরে তাকিয়ে আনন্দ পাই।