আলাপচারিতা ঈদ স্মৃতি : হৃদ্যতায় অপার আনন্দ
[আগেকার দিনে ঈদের আনন্দ ছিল অকৃত্রিম। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিল না ভণিতা, লোক দেখানোর কুটকৌশল, স্বার্থপরতা কিংবা কৃত্রিমতার ছোঁয়া। আমাদের দাদা-দাদী, নানা-নানী, ফুফু-খালা, চাচা-মামারা সেই আনন্দের ভাগীদার ছিলেন। বিশ, ত্রিশ বা চল্লিশের দশকে মুসলিম সমাজে বিশেষ করে রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে ঈদের আনন্দে ছিল নির্মল আমেজ, শরাফতি ও সহমর্মিতার স্বচ্ছ আবহ। আধুনিক জীবনযাত্রার সমকালীন উৎকর্ষতার যুগে ঈদ আনন্দ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কপটতা, স্বার্থপরতা, লোক দেখানো, ফ্যাশন ও প্রদর্শনী উপজীব্য হয়ে উঠেছে। সর্বত্র যেনো এক প্রাণহীন কৃত্রিমতার দাপট লক্ষণীয়। লাগামহীন বিলাস-ভোগসর্বস্বতা আর বেলেল্লাপনার ছড়াছড়িতে আসমানী তাগিদবাহী ঈদ আনন্দ তার আবেদন হারাতে বসেছে। পুরনো দিনের এমনি ঈদের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন সিলেটের শিল্পনগরী খ্যাত ছাতক সংলগ্ন বাতিরকান্দি গ্রামের বাসিন্দা আশি বছর বয়সী আফতাবুন্নেছা। উল্লেখ্য, তিনি ছাতকের বারকাহন গ্রামের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে কারাবরণকারী মাওলানা আব্দুল লতিফ (রহ.) এর কনিষ্ঠ মেয়ে। আফতাবুন্নেছার বড় ভাই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও আলেম সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা সাইদুল হাসান (রহ.)। তাঁর সঙ্গে এ আলাপচারিতা সাজিয়েছেন কবি আশরাফ হাসান।]
প্রশ্ন : আপনার আশি বছরের দীর্ঘ জীবনপথে আপনি অনেক ঘটনা, অনেক স্মৃতির সাক্ষী বহন করছেন। শৈশব-কৈশোরের ঈদের দিনের স্মৃতি নিশ্চয় আজও আপনার মনে রেখাপাত করে। সে সময়ের ঈদের দিনটা কিভাবে শুরু করতেন?
আফতাবুন্নেছা : আমার মনে আছে আমরা যখন ছোট ছিলাম-ঈদের দিন খুব ভোরে ফজরের আগে ঘুম থেকে জাগতাম। সবাই গোসল করে যার যার নতুন জামা কাপড় পরে নিতাম। আমাদের পরিবারে ইসলামী বিধি-বিধান কঠোরভাবে পালন করা হতো। আমার পিতা ও দাদা ছিলেন অত্যন্ত দ্বীনদার, ঐতিহ্যবাহী আলেম পরিবারের। স্বাভাবিকভাবে আমাদের জীবন যাত্রায় ইসলামের পাবন্দি ছিল। ঈদের দিনের মতো একটা অবারিত আনন্দের দিনেও এ বৈশিষ্ট্যের ব্যতিক্রম হতো না। অথচ আমাদের ঈদের আনন্দটা ছিল পূর্ণ মাত্রায় এবং নির্মল। তো ঈদের দিন কাপড় পরে ফজরের নামাজ পড়তাম, কুরআন তেলাওয়াত করতাম। এরপর হাতে তৈরি নানা পদের পিঠা, সেমাই এগুলো দিয়ে নাস্তা পরিবেশন করা হতো। পরিবারের সবাই একসাথে বসে খাওয়া হতো। তখন পুরুষরা চলে যেতেন ঈদের জামাতে। আমাদের ঈদের দিন এভাবেই শুরু হতো।
প্রশ্ন : আপনি তো বর্তমান সময়েও ঈদের দিন অতিক্রম করছেন। আগের দিনের ঈদ উদযাপন এবং এই সময়ের ঈদ পালনে কী ব্যবধান আপনার চোখে পড়ে।
আফতাবুন্নেছা : ব্যবধান বা অসামঞ্জস্য অনেকটাই চোখে পড়ে। আগের দিনগুলো ছিল অনেক বেশি মমতাপূর্ণ ও হৃদ্যতায় ভরা। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও পরিচিতজনরা ঈদের দিন একে অন্যের খোঁজ খবর নিতেন আনন্দচিত্তে। শুধু দায়িত্ব ভেবে নয় তাদের মনের টানটা ছিল বেশি। গ্রামে তো বটেই শহরেও দেখেছি এমন চিত্র। আরেকটা বিষয় পরিবারে বড়দের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, সমবয়সীদের মধ্যে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও ছোটদের প্রতি বড়দের স্নেহ ছিল কানায় কানায়। আজকাল এ দৃশ্য পাল্টে গেছে। ঈদে বেশির ভাগই কেউ কারো খবর করে না, দেখতে যাওয়া-আসা তো দূরের কথা। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আদব, মায়া-মমতায় যেনো ভাটা পড়েছে অনেক বেশি। কিছু লোকের মধ্যে এগুলো থাকলেও তা দায়সারা গোছের। এ কারণে আগের ঈদের আনন্দ এখন আর নেই।
প্রশ্ন : আপনার শৈশব-কৈশোরে বড় ছোটদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্নেহ সম্পর্কে কিছু বলুন।
আফতাবুন্নেছা : ঈদের দিন আমরা ছোটরা বাবা-মা, দাদা-দাদীকে পায়ে ধরে সালাম করতাম। বড়রা ছোটদের স্নেহ করতেন অনেক বেশি। এছাড়া বাড়ি, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়দের একে অন্যের ঘরে যেতেন। সালাম করতেন, কুশল বিনিময় করতেন। একে অন্যকে আপ্যায়ন করাতেন আন্তরিকভাবে।
প্রশ্ন : আপনার রক্ষণশীল পরিবারে ঈদের দিন ছোটদের আনন্দ, হৈ-হুল্লোড় কেমন ছিল। আপনাদের বেড়ানো সম্পর্কে কিছু বলুন।
আফতাবুন্নেছা : আমাদের সময়ে ছোটদের হৈ-হুল্লোড় যে ছিল না তা নয়। তবে তা একটি মাত্রায় সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা তা আদবতমিজকে রক্ষা করেই করতাম। আমরাও বেড়াতে যেতাম। তবে পর্দার সাথে। এক্ষেত্রে পুরুষ-মহিলার পর্দার বিধানকে মানা হতো শক্তভাবে। শহরেও দেখেছি রিকসার সামনে কাপড় পেচিয়ে পর্দা করে মহিলারা চলাচল করতেন।
প্রশ্ন : তখন ঈদের জামাত সম্পর্কে আপনার কিছু মনে আছে?
আফতাবুন্নেছা : তখন ঈদের জামাত হতো। গ্রামের সকল পুরুষ এতে শরীক হতেন। একটি ঘটনার কথা মনে আছে। জামাতে আসা সকলকে ইমাম সাহেব লক্ষ্য করে বলতেন যে, কারা রমজানের রোজা রাখেননি। এভাবে কিছু লোক বেরিয়ে আসতেন যারা রোজা রাখেননি। তখন ইমাম সাহেব তাদের কাছ থেকে ওয়াদা নিতেন যেনো কোনদিন রোজা ছাড়া না পড়ে। অনেক সময় তাদের মৃদু শাস্তি দেওয়া হতো। সবার সামনে কান ধরে উঠ বস করানো হতো। এ সময় কেউ কেউ বলতেন সরলভাবে-‘আমি রোজা রাখতে পারিনি, তাই আমার পুত্র রোজা রেখেছে।
প্রশ্ন : ঈদের দিন পারস্পরিক বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, সংঘাত এগুলো কি তখন মিটমাট হতো?
আফতাবুন্নেছা : সে সময়ে সমাজে বিবাদ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ এগুলো ঈদের দিন মিটমাট হয়ে যেতো। স্থানীয় মুরুবিবগণ এর উদ্যোগ নিতেন। বিশেষ করে মসজিদের ইমামগণ যাদেরকে সবাই নেতা হিসেবে মান্য করতেন, তারা ও মুরুবিবগণের যৌথ প্রচেষ্টায় সকল বিবাদ ঝগড়ার সমাধান করে দিতেন। এভাবে আমাদের ঈদের দিন কাটতো অনাবিল আনন্দের মধ্য দিয়ে।