দীর্ঘ ১৭ বছরেও সুরাহা হলো না ডায়নার মৃত্যু রহস্য
প্রিন্সেস ডায়না এবং তার প্রেমিক দোদি ফায়াদ প্যারিসে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৯৯৭ সালের ৩০ আগস্ট। ১৭ বছর আগে ঘটে যাওয়া এ সড়ক দুর্ঘটনার রহস্য আজো উদ্ঘাটিত হয়নি।
সেদিন সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল মধ্য রাতের একটু পরে। পাপ্পারাজি নামে পরিচিতি নাছোড়বান্দা ফটো সাংবাদিকদের লেন্স থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য ডায়না এবং দোদি ফায়াদ অনেকটা গোপনে এবং তীব্র বেগে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন রিৎজ হোটেল থেকে। গাড়িটির চালকের আসনে ছিলেন হোটেলটির নিরাপত্তা বিভাগের উপ প্রধান হেনরি পল। প্যারিসের পন্ট-ডি-আলমা রোড টানেলে পাড় হওয়ার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। দোদি-ডায়নাকে বহনকারী মার্সিডিজ গাড়িটি ঘণ্টায় ৬৫ মাইল বেগে আঘাত করে টানেলের ১৩তম স্তম্ভকে। কংক্রিটের এ স্তম্ভের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার পরিণামে গাড়িটি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। আর ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান দোদি ও গাড়ি চালক হেনরি পল।
ব্রিটেনের সাবেক রাজবধূ এবং রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাবেক বধূ মারা যান এ দুর্ঘটনার কিছু পরেই।
ব্রিটিশ রাজপরিবারের সাবেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এ দুর্ঘটনায় প্রাণ না হারালে হয়ত এটি একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত হতো। কিন্তু মৃত্যুর কয়েকে ঘণ্টার মধ্যেই ডায়নার মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা শুরু হয়। এ সব, প্রশ্নের প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ রাজপরিবার বিশেষ করে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
মাতাল চালকের কারণেই ডায়নার গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে। এ কথা জোর দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে দাবি করেছ ব্রিটিশ প্রশাসন। কিন্তু দুর্ঘটনার বিষয়ে পুরো সত্যি কথা এ বিবৃতিতে দেয়া হয় নি বলেই অনেকেই মনে করেন। দুর্ঘটনার ১৭ বছর পরেও মানুষ এ দুর্ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। তারা মনে করছেন এ দুর্ঘটনায় হয়ত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের গোপন হাত রয়েছে।
তারা বলে থাকেন, দোদির সঙ্গে ডায়নার সর্ম্পক ব্রিটিশ রাজ পরিবারের কট্টর ভাবর্মূতরি প্রতি হুমকিই ছিল। তাই রাজ পরিবার তা মেনে নিতে পারেনি এবং দুর্ঘটনা সাজিয়ে ডায়নাকে হত্যা করা হয়েছে।
ডায়ানার মৃত্যুকে ঘিরে অনেক প্রশ্নের জবাব এখনও পাওয়া যায় নি। মনে করা হয় এ দুর্ঘটনার পেছনে একযোগে কাজ করেছে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৫ এবং ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
এবারে এ সব প্রশ্ন খতিয়ে দেখি:
১. রাজপরিবারে মুসলমানের অস্তিত্ব কি মেনে নিতে পারে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ?
ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ রাজার সৎ পিতা হিসেবে একজন মুসলমানকে মেনে নিতে পারে নি ব্রিটিশ রাজপরিবার। মধ্যযুগে এমন ঘটনা ঘটলে সরাসরি ডায়ানার শিরোচ্ছেদ করা হতো।
ডায়ানা মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোড়ন তুলেছে এ প্রশ্ন। ডায়নার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজপরিবারে ভাবমূর্তি সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ কারণে। একই সঙ্গে মুসলিম বিশ্বে ব্রিটিশ রাজপরিবার নিয়ে নানা সংশয় সৃষ্টি করেছে।
ডায়নার সঙ্গে দোদির সম্পর্কের নিয়ে ব্রিটিশ রাজপরিবারের উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে নানা স্পর্শকাতর কথা বলেছেন তার বাবা মোহাম্মদ। তিনি মনে করেন, প্রিন্স ফিলিপ কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি যে ইংল্যান্ডের ভবিষ্যত রাজার সৎপিতা হবেন একজন মুসলমান। রিৎজ হোটেল থেকে বের হওয়ার আগে দোদি ও ডায়না তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন বলে দাবি করেছেন মোহাম্মাদ। একই সঙ্গে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও ব্যক্ত করেছিলেন তারা।
২. সত্যিই কি চালক মাতাল ছিলেন গাড়ি চালক?
দুর্ঘটনার দু’দিন পরই ফরাসি পুলিশ দাবি করে, ডায়নার গাড়ি চালক মাতাল ছিলেন। নির্ধারিত মাত্রার তিনগুণ বেশি মদ পান করেছিলন সে দিন হেনরি পল। কিন্তু চারদিন পর ফরাসি পুলিশের সে বক্তব্য প্রত্যাখান করেন দোদির পরিবার। তারা নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে নিরাপত্তা ভিডিওর একটি ফুটেজ প্রকাশ করেন। এতে হেনরি পলকে দেখে মনে হচ্ছিল না তিনি মাতাল ছিলেন বা অতিমাত্রায় মদ পান করেছিলেন। এ ভিডিও বেশ বিশ্বাসযোগ্য ছিল। ফরাসি পুলিশের বক্তব্য এতে একবারে ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়।
এরপর এগিয়ে আসে ব্রিটিশ পুলিশ।। ডায়নার গাড়ি চালকের রক্তের নমূনা পরীক্ষা করে তাতে উচ্চ মাত্রায় মদ পাওয়া গেছে বলে জানায় ব্রিটিশ পুলিশ। তাতে বোঝা যাচ্ছে পুরো মাত্রায় মাতাল ছিলেন হেনরি পল।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পলের রক্তের নমুনায় আলবেনডাজোল নামের একটি ওষুধের উপস্থিতি ধরা পড়েছে বলে ব্রিটিশ পুলিশ দাবি করেছে। কিন্তু পলেরি চিকিৎসক কখনো ব্যবস্থাপত্রে এ জাতীয় ওষুধের কথা লিখেন নি বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে পল নিয়মিত অ্যকামপ্রোসটেট নামে একটি ওষুধ খেতেন কিন্তু রক্তের নমূনায় এর উপস্থিতি ধরতে পারে নি ব্রিটিশ পুলিশ। সাদা চোখেই ব্যাপারটি রহস্য জনক মনে হবে যে কারো কাছে। তাই নয় কি!
৩. রহস্য রয়েছে মার্সিডিজ বেঞ্চ নিয়েও
দুর্ঘটনার সময়ে ডায়ানা ও দোদি কালো রঙের মার্সিডিজ এস২৮০ গাড়িতে ছিলেন। প্যারিসের একটি কোম্পানি থেকে এ গাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল। সে রাতে এ ছাড়া ডায়ানার চড়ার উপযোগী আর কোনো গাড়ি পাওয়া যায় নি। ভাড়া করার আগে এ গাড়িটি চুরি গিয়েছিল এবং ফরাসি পুলিশ পরে এটাকে খুঁজে বের করেছিল। গাড়িটির একটি মাত্র কম্পিউটার চিপ(সিইউ) খোয়া গিয়েছিল। এই চিপের সাহায্যে গাড়িটির গতি, চলার দিক, স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে। কেউ কেউ মনে করেন, গাড়িটি চুরি করে তাতে রদবদল ঘটিয়ে নতুন একটি চিপ বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। গাড়িটিকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ভাবে চিপ বসিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
সবচেয়ে রহস্যজনক হলো, মার্সিডিজ কোম্পানি কখনোই গাড়িটির ধংসাবশেষ পরীক্ষা করে নি। যদিও মারাত্মক দুর্ঘটনার পর এ জাতীয় পরীক্ষা করার রেওয়াজ প্রচলিত আছে। এ ভাবে পরীক্ষা করে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সত্যিই কোনো রদবদল করা হয়েছে কিনা তা সহজেই নির্ধারণ করতে পারেন একজন দক্ষ প্রকৌশলী ।
৪. চিকিৎসা দল পৌঁছাতে ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করেছে?
সরকারি নানা বক্তব্য থেকেই জানা গেছে মারাত্মক ভাবে আহত ডায়নাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিতে ৭৫ থেকে ৯৫ মিনিট লেগেছে। প্যারিসের ব্যস্ত মুর্হুতে দুর্ঘটনাস্থল থেকে এ হাসপাতালে পৌঁছাতে বড়জোর ১১ মিনিট লাগে। এ দুর্ঘটনা ঘটেছিল মধ্যরাতের প্রায় নির্জন রাস্তায়। তাই হাসপাতালে পৌঁছাতে এরচেয়েও অনেক কম সময় লাগাটাই তো স্বাভাবিক ছিল!
এ ছাড়া ডায়নাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স প্যারিসের ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামের কাছে থেমে ছিল। অ্যাম্বুলেন্সের লগ থেকে এ কথা জানা গেছে। বলা হয়েছে, ডায়নার অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠায় এ ভাবে অ্যাম্বুলেন্সকে দাঁড়া করিয়ে রাখা হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সকে এখানে ১০ মিনিট দাঁড়া করিয়ে রাখা হয়েছিল। অথচ এখান থেকে হাসপাতালে যেতে ৩০ সেকেন্ডের বেশি লাগার কথা নয়। এ ছড়া, ডায়নার অবস্থা শোচনীয় হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কাউকে অ্যাম্বুলেন্সে জরুরি তলব দেয়া হয় নি।
৫. দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা আগেভাগেই টের পেয়েছিলেন ডায়না
সাবেক বাটলার পল ব্রুররেলের কাছে লেখা চিঠিতে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পূর্বাভাষ দিয়েছিলেন ডায়না। তিনি লিখেছিলেন, ক্যামেলিয়াকে বিয়ের পথ সুগম করার জন্য তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন রানির স্বামী( প্রিন্স ফিলিপ)। গাড়ি দুর্ঘটনা, ব্রেক ফেইল বা মাথায় মারাত্মক কোনো আঘাত যেন পায় তার ষড়যন্ত্র চলছে বলে এ চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন ডায়না। এর কয়েক মাস আগে বিবিসির প্যানোরমা অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন ডায়না।
৬. মরদেহ ও দুর্ঘটনা স্থলের আলামত নষ্ট করা
ফরাসি আইনের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও ডায়নার মরদেহ শীতল হয়ে আসার আগেই তাতে অবৈধভাবে পচনরোধক রাসায়নিক উপাদান মাখান হয়। দেহ ত্বককে যেনো সুন্দর দেখা যায় সে জন্য মৃতদেহের রক্ত বের করে যন্ত্রের সাহায্যে দেহে ঢোকান হতে থাকে কিছু রাসায়নিক উপাদান। ফলে মৃতদেহের সঠিক ময়না তদন্ত কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। অ্যাম্বুলেন্সে করে আহত ডায়নাকে নিয়ে যাওয়ার পথে তার দেহে কোনো কিছু করা হয়েছিল কিনা এ কারণে তা নির্ণয় করতে পারেন নি চিকিৎসকরা।
এদিকে, যখন ডায়নার মরদেহে যখন এ উপাদান মাখার কাজ জোরেশোরে চলছে তখন ভিন্ন আরেক নাটক চলছে দুর্ঘটনাস্থলে। দ্রুত ধুয়েমুছে সাফ করা হয় দুর্ঘটনাস্থলকে এবং তা জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়। দুর্ঘটনার মাত্র এক ঘণ্টা বা তার চেয়ে একটু বেশি সময়ের মধ্যেই এ কাজটি তড়িঘড়ি করা হয়েছিল।