১১ সেপ্টেম্বর : মার্কিন টুইন টাওয়ারে হামলার বার্ষিকী

9 11যে-কোনো সন্ত্রাসী হামলাই দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়। কারণ সন্ত্রাসী হামলার ফলে যারা আক্রান্ত হয় তাদের বেশিরভাগই থাকে নিরীহ মানুষ। বিনা অপরাধে কারও ওপর হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। পৃথিবীর সকল মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি-সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন কিংবা যে মতাদর্শেরই ধারক বা বাহক হোক না কেন, বিনা কারণে তার প্রতি অত্যাচার করা, তাকে হত্যা করা মহা অন্যায়। সন্ত্রাসী ঘটনার মাধ্যমে সেই অন্যায়টাই বেশি হয় যা কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য নয়, বরং সকল সন্ত্রাসী ঘটনাই নিন্দনীয় এবং ঘৃণ্য। ১১ ই সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল তা-ও এই দৃষ্টিকোণ থেকে একইভাবে অগ্রহণযোগ্য।
কিন্তু ওই সন্ত্রাসী ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী যে মুসলিম বিরোধী অভিযান শুরু করেছে তাও কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ওই দুর্ঘটনার হোতা যে কারা তা আজ পর্যন্তও নিশ্চিত হওয়া যায় নি। স্বয়ং আমেরিকারও বহু বিশেষজ্ঞ টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনায় মার্কিন সরকারেরই হাত রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। যাই হোক এই নিন্দনীয় ও ঘৃণ্য হামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত নিরপরাধ লোকজনের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে নাইন ইলেভেন বা ১১ই সেপ্টেম্বরের বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আমরা কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে যাত্রীবাহী বিমানের সাহায্যে হামলা করার পর বিশ্বের প্রায় সকল দেশই মার্কিন সরকার ও সেদেশের জনগণের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছিল। তবে আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্ররা ন্যাটো চুক্তির ধারা অনুযায়ী আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শান্তি বিঘ্নিতকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য সম্মিলিত প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করে। ১৯৪১ সালে মার্কিন পার্ল হার্বর পোর্টে জাপানি হামলার পর এটাই ছিল আমেরিকায় বড়ো ধরনের কোনো হামলা। ওয়াশিংটনে অবস্থিত মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগন এবং নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলায় সব মিলিয়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। উন্নত নিরাপত্তা প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ বলে দাবীদার যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশে যাত্রীবাহী বিমানের সাহায্যে এভাবে হামলা চালানোর ঘটনাটা ছিল একেবারেই অভিনব এবং অবিশ্বাস্য।
কিন্তু এই দুর্ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে বুশ সরকারসহ তার পরবর্তী ওবামা সরকারও যেভাবে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছে তাতে অনেকের মনেই বিশেষ করে বিশ্ব গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন জেগেছে ওই হামলা আসলে কারা ঘটিয়েছে এবং কীভাবে ঘটিয়েছে! এই ঘটনার আগে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বহু সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে কিন্তু টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার মতো অন্য কোনোটাই বিশ্বজুড়ে এতো তোলপাড় সৃষ্টি করে নি। কারণটা হলো মার্কিন কনজারভেটিভরা মনে করছে এই হামলা মার্কিন সভ্যতা ও গণতন্ত্রের ওপর হামলা। এ হামলা কেবল আমেরিকাকেই নয় বরং সমগ্র বিশ্বকেই হুমকিগ্রস্ত করে তুলেছে। মূলত এই হামলা মার্কিন যুদ্ধবাজদের সামনে একটা সোনালি সুযোগ এনে দিয়েছে।
সোনালি সুযোগ মানে হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউরোপে মার্কিন সামরিক ছাতা হিসেবে পরিচিত ন্যাটোর অস্তিত্বের বিষয়টি প্রশ্নের সম্মুখিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণে আমেরিকার এমন এক নতুন শত্রুর প্রয়োজন দেখা দিল যার বিরুদ্ধে লড়বার অজুহাতে সমগ্র বিশ্বে তাদের নেতৃত্ব ও হস্তক্ষেপের একটা পটভূমি তৈরি হয়। টুইন টাওয়ারে হামলার মধ্য দিয়ে সেই পটভূমি তারা তৈরি করে নিলো এবং ফিলিস্তিন, লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনকেও তারা অনায়াসে সন্ত্রাসী পদক্ষেপ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালালো।
বেশ কয়েকটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে মার্কিন অর্থনীতির গর্বিত স্থাপনা টুইন টাওয়ার এবং তাদের সামরিক অভেদ্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনে হামলা চালানোর ঘটনায় আমেরিকার জনগণসহ তাদের মিত্ররা ভীষণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। ঘটনাটা সত্যিই উদ্বিগ্ন হবার মতোই ছিল। ফরাশি বামপন্থি দৈনিক লামন্ড এই ঘটনায় মার্কিনীদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে লিখেছিল: ‘আমরা সবাই আমেরিকান’। এই ভীতিকর পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ আমেরিকার অভ্যন্তরে এবং বিশ্ব অঙ্গনেও তাদের আধিপত্যবাদী নীতিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চালায়। হঠাৎ করেই আফগানিস্তানের তালেবান গোষ্ঠি এবং ওসামা বিন লাদেনকে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে পরিগণিত করা হয়।
১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশ আফগানিস্তানে মিসাইল ও বোমা বর্ষণের মধ্য দিয়ে ভয়াবহ হামলা চালায়। মজার ব্যাপার হলো এই তালেবান গোষ্ঠিকে জন্ম দিয়েছিল মার্কিন, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনী ও সামরিক বিভাগ। তাদের সহযোগিতাতেই তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। আবার বিন লাদেনকে টুইন টাওয়ারে হামলার জন্য দায়ী করে আফগানিস্তানে হামলাও চালায় আমেরিকা। বিন লাদেন কিন্তু ব্রিটিশ এবং মার্কিন গোয়িন্দা বিভাগগুলোর হাতে গড়া। আফগানিস্তান দখল করার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে হোয়াইট হাউজ তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালায় ইরাকে। ইরাক এমন একটি দেশ যে দেশে রয়েছে দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলের মজুদ। তাছাড়া ভৌগোলিক দিক থেকে একটি কৌশলগত অঞ্চলে ইরাকের অবস্থান।
এই ইরাকে হামলা করার জন্য আমেরিকা যুক্তি বা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রকে। বলা হলো ইরাকে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের হাতে এই মারণাস্ত্রগুলো নিরাপদ নয়। ইরাক অবশ্য বরাবরই এই অভিযোগ সত্য নয় বলে জানিয়ে এসেছে। সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের কর্মসূচির সাথে এই গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংস করার ব্যাপারটি যুক্ত হয়। যদিও জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক দল বহুবার ইরাকে অস্ত্র তল্লাশি চালিয়ে কোনো গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের অস্তিত্ব খুঁজে পান নি। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল কিছু জাল স্যাটেলাইট ইমেজ দেখিয়েছিল নিরাপত্তা পরিষদে। কিন্তু বিশ্ব জনমতের কাছে ততক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। সবাই বুঝতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র আসলে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা থেকে ফায়দা নিতেই ইরাকে হামলার পাঁয়তারা করেছিল।
সে সময় থেকে মার্কিন সরকারের যুদ্ধকামী নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন স্বয়ং মার্কি মুল্লকেও গড়ে ওঠে। ইরাকে যেসব মার্কিন সেনা মারা গিয়েছিল তাদেরকে মার্কিনীরা বীর হিসেবে মনে করে না বরং হোয়াইট হাউজের যুদ্ধকামী নীতির শিকার বলে মনে করে।
যাই ১১ ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর তের বছর কেটে গেছে। বিশ্ববাসীরে উচিত আরও বেশি সচেতন হওয়া এবং মার্কিন যুদ্ধকামী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button