স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ড : দ্বন্দ্ব ও ঐক্যের গল্প

Scotlandইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মধ্যকার ভালবাসা ও ঘৃণার সম্পর্কের স্মৃতি হিসেবে গত কয়েকশ বছরের রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্ধনের ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগীয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, রাজকীয় বিবাহ উৎসব ও প্রাণদন্ড যে নিদর্শন হয়ে রইবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। স্কৃটিশরা যখন ইংল্যান্ডের সাথে ৩০০ বছরের বন্ধন ছিড়ে স্বতন্ত্র হওয়ার জন্য ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন, ‘কোন একসময় যে স্কটল্যান্ডের একটি স্বীকৃত জাতি হিসেবে অস্তিত্ব ছিলো, সেই পুরোন ইতিহাস যা এতদিন তাদের ভাগ্যকে বেঁধে রেখেছিলো সেটাই আবার দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে।
স্কটল্যান্ডের অধিকাংশ জাতীয় ইতিহাস দেশটির সাথে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কের ভিত্তিতেই রচিত। তবে আগামী সপ্তাহের গণভোটে যাই ঘটুকনা কেন স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডকে একই ভূমিতে পূর্বের ন্যায় মিলেমিশেই বসবাস করতে হবে। আর স্কটল্যান্ডের ভাগ্য এখনও আন্ত:সীমান্ত সম্পর্কের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত।
অভিন্ন রাজার শাসনের অধীনে থাকার জন্য ৩০০ বছর আগে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড। চুক্তিবলে এতদিন ইংল্যান্ডের রাজপরিবার ছিল স্কটল্যান্ডের শাসক। শেষ হয়েছে সেই চুক্তির মেয়াদ। ১৬০৩ সালে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের রাজবংশ রাজা প্রথম জ্যাকবের অধীনে একত্রিত হয়। ১৭০৭ সালে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের আইনসভা একত্রিত হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড নিজস্ব বিচারব্যবস্থা, নিজস্ব গির্জা, নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা, এমনকি নিজস্ব টাকা ধরে রেখেছে। ১৯৯৯ সাল থেকে স্কটল্যান্ডের নিজস্ব আইনসভা রয়েছে এবং তখন থেকে দেশটি স্বায়ত্বশাসিত। অতীতে ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড চারটি আলাদা দেশ ছিল এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। ১৫৩৬-এ কিংডম অফ ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রিন্সিপালিটি অফ ওয়েলস। ১৭০৭ সালে কিংডম অফ স্কটল্যান্ড যুক্ত হয় কিংডম অফ ইংল্যান্ডের সঙ্গে। তখন ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের সম্মিলিত নাম হয় কিংডম অফ গ্রেট বৃটেন। এরপর ১৮০১ সালে কিংডম অফ আয়ারল্যান্ড সংযুক্ত হলে এই চারটি দেশের সম্মিলিত নাম হয় ইউনাইটেড কিংডম অফ গ্রেট বৃটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড। ৬ ডিসেম্বর ১৯২২-এ অ্যাংলো-আইরিশ চুক্তির পরে পঞ্চ-ষষ্ঠাংশ আয়ারল্যান্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন ইউকের নতুন নাম হয় ইউনাইটেড কিংডম অফ গ্রেট বৃটেন অ্যান্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। সংক্ষেপে ইউকে পরিচিত বৃটেন নামেও। তবে গ্রেট বৃটেন হচ্ছে বৃটিশ দ্বীপ যেখানে রয়েছে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলস।
যেসব কারণে স্কটল্যান্ডের নীতিনির্ধারকরা আলাদা হতে চাইছেন তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি কারণ হল, স্কটল্যান্ডের তেল সম্পদ। স্কটিশ সরকারের ধারণা, ইউকে সহ ইইউ-এর তেল সম্পদের মধ্যে ৬৪% স্কটল্যান্ডের সমুদ্র সীমায়, নর্থ সি-তে।  রিনিউয়েবল এনার্জি বা নবায়নযোগ্য শক্তি। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার এলেক্স স্যালমন্ডও বলেছেন, এর ফলে স্কটল্যান্ডের নতুন শিল্পায়ন সম্ভব হবে।  স্কটল্যান্ডকে ইউকের অন্তর্ভুক্ত রাখার পক্ষে বলা হচ্ছে স্কটিশদের কাছ থেকে ইউকের মানুষকে পৃথক করা দুঃসাধ্য হবে।
২০১১-র আদমশুমারির মতে প্রায় সাত লাখ প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের জন্ম হয়েছিল স্কটল্যান্ডে, তারা এখন ইউকের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করে। অন্যদিকে প্রায় চার লাখ সত্তর হাজার প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের স্কটল্যান্ডের বাইরে ইউকের অন্য অঞ্চলে জন্ম হয়েছিল, তারা এখন স্কটল্যান্ডে বাস করে। তাছাড়া সামরিকভাবে বৃটেন খুব শক্তিশালি দেশ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের অন্যতম বৃটেন। বিশ্বের ষষ্ঠতম বৃহৎ অর্থনীতি বৃটেনে এবং রয়েছে অষ্টম বৃহৎ ক্রয় ক্ষমতা। তাই মিলিটারি, অর্থনৈতিক, সাংষ্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক এবং রাজনৈতিক কারণে বৃটেন আন্তর্জাতিকভাবে খুব প্রভাবশালী। এসব কারণে স্কটল্যান্ডের না ভোটের পক্ষপাতীরা এবং বৃটেনের অন্যান্য অঞ্চলের ভোটাররা এতদিন মনে করেছিল স্কটিশরা নিজেদের স্বার্থেই ইউকে-তে থাকবে। ইউকের কিছু সাম্প্রতিক জনমত জরিপে এমনটাই প্রতিফলিত হচ্ছিল। কিন্তু চার সপ্তাহ আগে স্কটল্যান্ডে গৃহীত একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে না ভোটের সংখ্যা কমে গেছে। আগে না ভোট ছিল ৫০.৩%। এখন কমে হয়েছে ৪৭.৬%। আগে হ্যা ভোট ছিল ৩৭.২%। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৪১.৬%। অর্থাৎ না এবং হ্যা ভোটের মধ্যে ব্যবধান কমে এখন হয়েছে ৬%। এর ফলে বৃটেনের রাজনীতিবিদরা বেশ দু:শ্চিন্তায় রয়েছেন।
এদিকে বাকিংহ্যাম প্রাসাদ সূত্র জানিয়েছে, রানী এলিজাবেথ প্রতিদিনই গণভোটের সর্বশেষ খবর নিচ্ছেন। আগামী ১৮ অক্টোবর সেখানে স্বাধীনতা ইস্যুতে গণভোট হবে। স্কটল্যান্ড যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তবে এলিজাবেথ আর স্কটল্যান্ডের রানী হিসেবে বহাল থাকতে পারবেন না।
তবে ব্রিটেনের ৪৫ ভাগ মানুষ মনে করেন, স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলেও এলিজাবেথকে রানী হিসেবে বহাল রাখা উচিত। এদিকে স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে ব্রিটেনেও সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। কয়েকজন এমপি এরই মধ্যে স্কটল্যান্ড স্বাধীন হয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে পদত্যাগ করতে বলেছেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button