জ্বালানি বিপ্লবের প্রতিশ্রুতিতে জোরদার স্কটিশদের স্বাধীনতার দাবি
স্কটিশরা স্বাধীন হতে চান, নাকি ইউকের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে চান- এ প্রশ্নে স্কটল্যান্ডে গণভোট হতে যাচ্ছে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বরে। চিরাচরিত জাতীয়তাবাদী চেতনা স্কটিশদের স্বাধীনতার দাবির পেছনে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না, তারা স্বাধীন হতে চাচ্ছেন অর্থনীতি ক্ষেত্রে নিজেদের গণতন্ত্রসম্পন্ন ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের মধ্যকার বিতর্কে সবচেয়ে বড় ভূমিকা দেখা যাচ্ছে তেলের। স্কটল্যান্ডের স্বাধীন অস্তিত্বের বিরোধীরা আশঙ্কা জানাচ্ছেন, দূর বা অদূর ভবিষ্যতে তেলপ্রাপ্তি অনিশ্চিত পড়লে স্কটল্যান্ডের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিপর্যয় নেমে আসবে। অন্যদিকে স্কটিশ সরকার বলছে। অপপ্রচারে কান দেয়ার দরকার নেই। স্বাধীনতাপরবর্তী স্কটল্যান্ডের অর্থনীতি গড়ে উঠবে নর্থ সীর তেল ও গ্যাস ভান্ডরকে অবলম্বন করেই।
লক্ষণীয়, বহুজাতিক যে কোম্পানিগুলো পারস্পরিক যোগসাজশে নর্থ সীর তেল উত্তোলন ও সরবরাহে এতদিন ধরে কর্তৃত্ব করে এসেছে ‘এসএনসি’ (স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি) কথা দিয়েছে যে, ঐ কোম্পানিগুলো আর্থিক স্বার্থের কোনো ব্যাঘাত তারা ঘটতে দেবে না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নর্থ সী থেকে আশিলেপ এ পর্যন্ত যে বিপুল মুনাফা তুলে নিয়েছে তার তুলনায় স্থানীয় জনকল্যাণে ব্যয় হয়েছে খুবই কম পরিমাণ অর্থ। তেলের ওপর শুল্ক আরোপে দুনিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সবচেয়ে দুর্বল ব্যবস্থা ইউকেতে অবলম্বিত হওয়ার কারণে প্রতি ব্যারেল তেলের মূল্য ইউকে ২০০৮ সালে যে সময় নির্ধারণ করে ২১.৫০ ডলার। সে সময়ই নরওয়ের তেথল বিকোচ্ছিল ৪৮.৫০ ডলারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর স্বার্থের বিঘœ না ঘটিয়ে নর্থ সীর তেলের জোরে স্কটিশ জনগণের ভাগ্যের ‘এসএনসি’ উল্লম্ফন ঘটাবে কী করেÑ বোঝা মুশকিল। উল্লেখ্য, নিজেদের তেল উত্তোলন, শোধন ও বিপণন ব্যবস্থাপনায় কোনো বিদেশী বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে নরওয়ে কর্তৃত্বে বরণ করেনি। কিন্তু নর্থ সীতে ইউকে তা করেছে। যে কারণে নরওয়ের বেলায় না ঘটলেও ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তেল বাবদ রাজস্বে ইউকেকে গচ্চা দিতে হয়েছে ৭৪ বিলিয়ন পাউন্ড। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, স্বাধীন স্কটল্যান্ড সরকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তদবিরে ধরা দেবে না এবং দেশ ও জনগণের স্বার্থেই শুল্ক আরোপে নরওয়ে সরকারের পথ অনুসরণ করবে। ৭৪ বিলিয়ন পাউন্ড ছোট-খাটো কোনো রাশি নয়। সাউথ গ্লাসগো হাসপাতালের মতো দশটি নতুন বিশালায়তন হাসপাতাল স্কটল্যান্ড ঐ অর্থে গড়তে পারবে। নতুন ক্লিনিক গড়তে পারবে ১ হাজারটি। ১০ হাজার নতুন ডাক্তার ও ২০ হাজার নতুন নার্সকে চাকরি দেয়া সম্ভব হবে ঐ অর্থরাশি থেকেই। প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি কমিউনিটিতে একেকটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প গড়ে তোলা এবং প্রতিটি ঘরে সোলার প্যানেল পৌঁছানোও সম্ভব হবে ঐ অর্থেই। ঐ অর্থ দিয়েই আরও সম্ভব হবে এডিনবার্গ থেকে গ্লাসগো পর্যন্ত দ্রুতগতি রেইল গড়ে তোলা। স্কটল্যান্ডে একটি নতুন রেলওয়ে লাইন তৈরি করা এবং ফ্রি লোকাল বাস সার্ভিস চালু করাও সম্ভব ঐ অর্থ থেকেই। এমনকি স্কুলে ভর্তির জন্য অল্পবয়সী বিবেচিত শিশুদের জন্য বিনামূল্যে অনেক রাষ্ট্রীয় ‘চাইল্ডকেয়ার সেন্টার’ গড়া সম্ভব হবে।
উচ্চতর শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক মঞ্জুরি দেয়াও সম্ভব হবে ঐ অর্থ থেকে। বলা হচ্ছে, সব স্কটিশ বাসিন্দার বার্ষিক আয় ওপরে উঠে পৌঁছাবে ২ হাজার ২০০ পাউন্ডে। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্তদের কাছে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের বর্ণিত আর্থিক উন্নয়ন সম্ভাবনা কাল্পনিক কাহিনীস্বরূপ মনে হতে পারে। তাদের পক্ষে বোঝা সত্যিই অসম্ভব যে জনসম্পদ জনস্বার্থে ব্যবহৃত হলে জনজীবনে কতখানি বড় ধরনের বৈপ্লবিক উন্নয়ন সঞ্চার সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
তেলের ওপর বেশি দিন স্কটল্যান্ড নির্ভরশীল থাকতে পারবে না, স্বাধীনতা বিরোধীদের এই প্রচার একেবারে উড়িয়ে দেয়ার বিষয় নয়। মেনে নেয়া হলেও অন্য যে বাস্তবতাও মেনে নিতে হবে- সেটি হচ্ছে, স্কটল্যান্ডের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ভবিষ্যৎ। স্কটল্যান্ডের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে বায়ুপ্রবাহ শক্তির বিপুল অবদান সম্ভাবনার কথা সংবাদ মাধ্যমে যথাযথ চর্চিত যা হওয়াতেই শুধুমাত্র স্কটল্যান্ডের অর্থনীতিকে নির্ভরশীল দেখিয়ে দেশটির ভবিষ্যৎ আর্থিক দৌর্বল্য চিহ্নিত করার একদল অর্থ বিশেষজ্ঞ সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। বায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুভাগীয় ও উপকূলবর্তী বায়ুপ্রবাহ জ্বালানি উৎপাদন কাজে লাগিয়ে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক বিদ্যুৎ রফতানিকারক দেশে স্কটল্যান্ড পরিণত হওয়ার সামর্থ্য রাখে। জ্বালানি উৎসগুলোকে বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেয়ার অতীতের ভুল স্বাধীন স্কটল্যান্ড করবে না- এ হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের অভিমত ও প্রত্যাশা। তারা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, শুধুমাত্র পানি, সূর্যরশ্মি ও বায়ুপ্রবাহ জ্বালানি উৎপাদন কাজে ব্যবহার করে আইল অব আইগন স্কটিশ দ্বীপটির বিদ্যুতের ৯৫ শতাংশ চাহিদা ইতোমধ্যেই পূরণ করে যাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের শেষদিন ঘনিয়ে এসেছে- সবাই মানেন। স্কটল্যান্ড সম্বোন্ধে বিশেষজ্ঞদের প্রত্যয়ী ঘোষণা হচ্ছে, যে ২ লাখ চাকরির তেল শিল্পে এ পর্যন্ত সংস্থান হতে পেরেছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি লোকের স্কটল্যান্ড জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারবে বায়ু, পানি ও সূর্যরশ্মিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন শিল্পে। মজুদ কয়লা রূপান্তরিত করার মাধ্যমে লঘুমাত্রার কঠিন কার্বনসংবলিত সিন্থেটিক গ্যাস উৎপাদনেও স্কটল্যান্ড এগিয়ে যাবে- এই আশাবাদও ব্যক্ত করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্কটল্যান্ডের স্বনির্ভর জ্বালানি বিপ্লবের প্রতিশ্রুতিদৃষ্টে বিপি ও শেল অয়েলের মতো বহুজাতিকরা নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বোন্ধে প্রমাদ গুনবে- এটিই স্বাভাবিক। স্বাধীন স্কটল্যান্ডের পক্ষে প্রচারের ইতোমধ্যেই বিরোধিতা করেছেন বিপির কর্তা বরং ডাডলি। তিনি বলেন, একসঙ্গে থাকাটাই ভালো হতো। ১৮ সেপ্টেম্বরেই স্কটিশদের সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে- বলা যাবে না। নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য স্কটল্যান্ডের অর্থনীতিতে মরণকামড় বলতে উদ্যত হবে বহুজাতিকরা দেশটি স্বাধীন হওয়ার পরেও- এ কথা অবধারিত। অতীতের তিক্ত আর্থিক অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি রোধের প্রবল মানসিকতা নিয়েই স্বাধীনতার দাবির পথে এগিয়েছেন, একই সঙ্গে এ কথাটিও মান্য হতে হবে। আল জাজিরা।