‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’-এর প্রতিবেদন : বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে রাজনৈতিক অস্থিরতা
বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন তরতর করে বেড়ে চলেছে, দেশটি যখন শিশুমৃত্যুর হার কমানোসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করছে, তখন ‘বিষময়’ রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশটিকে দারিদ্র্য মুক্তির পথ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে ব্রিটিশ দৈনিক ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’।
ব্রিটিশ দৈনিকটিতে গতকাল সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প সুনাম হারালেও দেশটির অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য খাতেও বেশ কিছু অর্জন সাধিত হয়েছে।
গত এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসে এক হাজারেরও বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটলেও জুন মাসে দেশটির রপ্তানি আয় ২৭০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আগের বছরের তুলনায় তা ১৬ শতাংশ বেশি।
‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্লেষকদের ধারণা, বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও জনবহুল এ দেশটির অর্থনৈতিক বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এর ‘বিষময়’ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। দেশটির জীর্ণ কারখানাগুলোর চেয়েও আতঙ্কের বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যকার রেষারেষি।
‘দ্য ডেইলি স্টার’-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’-কে বলেন, অর্থনৈতিক সাফল্যের জন্য সবাই এখন বাংলাদেশের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা হাতড়ে বেড়িয়েছি, হোঁচট খেয়েছি, অনাড়ির মতো কাজ করেছি, কিন্তু অবশেষে লক্ষ্যে পৌঁছেছি। কিন্তু হঠকারী রাজনীতিকদের জন্য এটি (অর্থনৈতিক বিকাশ) হুমকির মুখে পড়ে গেছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজার ধসের পর দেশটির শ্রমিকদের জন্য কতটুকু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশের কর্মকর্তা ও শিল্পপতিরা এ ঘটনাকে ‘আগাম সতর্কতা’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, ‘এ ঘটনার শিক্ষা হলো, সোনার ডিমপাড়া হাঁসটিকে মেরে ফেলা উচিত নয়।…আপনাকে চিন্তা করতে হবে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে।’
‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ বলছে, যে বাংলাদেশ একসময় ‘দারিদ্র্য ও ক্ষুধার’ প্রতিশব্দ হিসেবে পরিচিত ছিল, তা প্রায় নিঃশব্দে অর্থনৈতিক বিকাশের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দেশটির এখন গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ। এ ছাড়া এটি এখন চীন ও ইতালির পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। যদিও এখানকার শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম বেতন ৩৮ ডলার (তিন হাজার টাকা) এবং মাসিক গড় বেতন ৬৫ ডলারের (প্রায় পাঁচ হাজার টাকা) কাছাকাছি।
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, কারখানার মালিকেরা যদি কর্মপরিবেশ ও অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে পারেন, নতুন দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারেন এবং রাজনৈতিক সংঘাতকে এড়াতে পারেন, তবে কয়েক বছরের মধ্যে তৈরি পোশাকের ব্যবসা দ্বিগুণ বড় হয়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের জাহাজনির্মাণ ও পোশাক শিল্পের উপকরণ (যেমন: বোতাম) তৈরির ক্ষেত্রকে সম্ভাবনার নতুন খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে ব্রিটিশ পত্রিকাটি।
১০ কোটি ডলারে তহবিল দ্য ফ্রন্টিয়ার ফান্ডের ব্যবসায়িক অংশীদার খালিদ কাদরি বলেন, ‘কাজে লাগানো যেতে পারে (বাংলাদেশের) এমন জনশক্তির পরিমাণ বিপুল। উত্পাদন খাতে বাংলাদেশ হতে পারে ছোটখাটো চীন। উত্পাদন খাত বিকাশের জন্য এটি যথাযথ স্থান। অনেক সমস্যা থাকলেও বাংলাদেশ এখনো একটি গতিশীল অর্থনীতি।’
কাদরি বলেন, রাজনৈতিক সমস্যা না থাকলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। তিনি বলেন, ‘হাসিনার আওয়ামী লীগ ও খালেদার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল উভয়ের বস্তাপচা চিন্তাভাবনা একই ধরনের।…গন্ডগোল হলো দুই পরিবারের। ধর্মীয় সমস্যা, জাতিগত ঝামেলা, আদর্শিক ব্যাপার স্যাপার, আঞ্চলিক ইস্যু এগুলো ফালতু বাত। ব্যাপারটি হলো একেবারে ব্যক্তিগত, মোটেই রাজনৈতিক নয়। “আমি তোমাকে ঘৃণা করি”—এটিই এর মোদ্দা কথা। দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলে, এর প্রবৃদ্ধির হার হবে দুই অঙ্কের।’
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করতে একটি কথা বেশ ব্যবহূত হয়, ‘জয়ীরাই সব খায়।’ অর্থাত্ যে দল বা জোট ক্ষমতায় যায়, তারাই দেশের সব আত্মসাত্ করে। ক্ষমতায় থাকা দলের নেতারা কেবল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে না, ব্যাপক দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিও চালায়। নিন্দুকেরা বলছে, বর্তমান সরকার এত দুর্নীতি করেছে যে দলটির জনসমর্থন তলানিতে এসে ঠেকেছে এবং সামনের নির্বাচনে দলটির সাফল্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক ও দেশটির মানবাধিকার কর্মীরা দেশটির বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, গত ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে দেড় শ জনকে বিচার ছাড়াই হত্যা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত সপ্তাহে বাংলাদেশের হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী নিবন্ধন বাতিল করেছেন। এতে রাজনৈতিক ঝামেলা আরও জটিল হয়েছে।
‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ বলছে, মাত্রাহীন দুর্নীতি বাংলাদেশকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বিদেশি দাতা সংস্থা ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে বলা হয়, ব্যাংক ডাকাতি করে, বিদ্যুত্ খাতে দুর্নীতি করে বা সড়ক যোগাযোগ খাতে লুটপাট করে একশ্রেণীর মানুষ দেশটির কোটি কোটি ডলার বিদেশে পাচার করছে। এ বছর বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণ খাতে প্রতিশ্রুত ২৯০ কোটি ডলারের সাহায্য স্থগিত করেছে। ব্যাংকটি বলেছে, ব্যাপক দুর্নীতির সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিকেও দায়ী করেছে পত্রিকাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামীকে সাজা দিতে গিয়ে ও উদারপন্থীদের জন্য পথ সুগম করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার অপ্রত্যাশিত আক্রমণের শিকার হয়েছে। গত মে মাসে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এদের থামাতে গিয়ে সরকার যে বল প্রয়োগ করে তাতে কমপক্ষে ৫৮ জন মারা গেছে এবং শত শত মানুষ আহত হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রধান আদিলুর রহমান বলেন, ‘শুরু থেকেই বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন চলে আসছে এবং এখনো চলছে।…একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হতে বাংলাদেশের সংগ্রাম এখনো চলছে।’
রানা প্লাজার দুর্ঘটনা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের দুর্বলতা ফাঁস করে দিয়েছে। পিরামিড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর হামিদ চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, পরিদর্শনের অভাবে রানা প্লাজার দুর্ঘটনা ঘটেছে এমনটি নয়, বরং দুর্নীতি ও রাজনৈতিক ব্যর্থতাই এ জন্য দায়ী।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকানোর সব ব্যবস্থা দেশটিতে ছিল। কিন্তু তার কোনোটিই প্রয়োগ করা হয়নি। তাই আমি বলব, রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতিই রানা প্লাজার দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজার মালিক রানা ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠনের অন্যতম নেতা। এ কারণেই তিনি সব আইন অমান্য করে ভবন নির্মাণ করতে পেরেছিলেন এবং ছাদে জেনারেটর বাসাতে পেরেছিলেন।
রানা প্লাজায় স্থাপিত কারখানাগুলোর একটির কর্মকর্তা আজাদের বক্তব্যও উদ্ধৃত করা হয় প্রতিবেদনে। তিনি বলেন, ‘সেদিন আমি সকাল সাড়ে আটটার দিকে কারখানায় যাই। বিদ্যুত্ ছিল না। ঘটনার সময় আমি ছিলাম আট তলায়। কম্পিউটার খুলে বসেছি এমন সময় বিকট শব্দে জেনারেটর চলা শুরু হলো। আমি সবাইকে বললাম ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু তারপর সব ধসে পড়ল।’