ইউরোপের এক তৃতীয়াংশ নারী সহিংসতার শিকার
ইউরোপে নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমেই বাড়ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক তৃতীয়াংশ নারী কোনো না কোনো সময় শারীরিক ও যৌন হামলার শিকার হয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৌলিক অধিকার বিষয়ক গবেষণা সংস্থা এফআরএ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের প্রতি তিন জন নারীর মধ্যে একজন ১৫ বছর বয়সেই শারীরিকভাবে নির্যাতন কিংবা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে একজন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে এবং প্রতি ২০ জনের মধ্যে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশের ৪২০০০ নারীর সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৌলিক অধিকার বিষয়ক গবেষণা সংস্থা এফআরএর এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, নারীদের ওপর সহিংস আচরণের ঘটনা ঘটলেও খুব কমই তা প্রকাশ পায়। নারীদের ওপর যেসব সহিংস আচরণ করা হয় তার মাত্র ১৪ শতাংশই প্রকাশ পায় এবং বাকি ঘটনা কেউ জানতেও পারে না।
সাক্ষাৎকার নেয়া ৪২০০০ নারীর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ বলেছেন, তারা কোনো না কোনো সময় শারীরিক ও যৌন হামলার শিকার হয়েছেন। সংস্থার প্রধান মর্টেন কিয়েরুম বলেছেন, পথে ঘাটে, কাজের জায়গায়, এমনকি নিজেদের বাড়িতেও নারীরা নিরাপদ নন। ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের নারীরা সবচেয়ে বেশি হামলার কথা জানিয়েছেন। এই তিনটি দেশে যথাক্রমে ৫২, ৪৭ এবং ৪৬ শতাংশ নারী নিজেদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন।
কাউকে মারধর করা হয়েছে, শরীরে আগুন দেয়া হয়েছে, গলায় দড়ি দিয়ে দমবন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে, ধর্ষণ বা অন্যান্য যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। ১৫ বছর বয়স থেকেই এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকের।
স্পেন, ইটালি ও গ্রিসের মতো ইউরোপের দক্ষিণের দেশগুলিতে নারীদের অবস্থা আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা ভালো। তবে এফআরএ-র গবেষকদের মতে, শুধু পরিসংখ্যান থেকে এমনটা দাবি করা যায় না যে ইউরোপের উত্তরাঞ্চলে নারীদের উপর বেশি নির্যাতন চলে বা দক্ষিণে নারীদের অবস্থা তুলনামূকভাবে ভালো।
আসলে উত্তরের দেশগুলির নারীরা দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে অনেক সহজে নিজেদের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা বলার সাহস রাখেন। অনেক নারীর জন্য পরিবারের মধ্যেও সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই। স্বামী বা সঙ্গীই তাদের উপর অত্যাচার চালিয়ে থাকে। শিশু ও কিশোর বয়সে তাদের উপর বাবা-মা নির্যাতন করেছেন, এমন ঘটনাও বিরল নয়।
নারী নির্যাতনের প্রবণতা বন্ধ করতে স্পেনের সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে এফআরএ-র রিপোর্টে। এ বিষয়ে সমাজে সচেতনতা বাড়াতে অনেক প্রচার অভিযান চালানো হয়েছে, যার ফলও পাওয়া যাচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৌলিক অধিকার বিষয়ক গবেষণা সংস্থা এফআরএ’র এই প্রতিবেদনে গৃহে নারীদের ওপর সহিংসতা বিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যোগ দেয়ার জন্য ইউরোপের সব দেশের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। ইউরোপে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ঘটনা শুধু শারীরিক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় একই সঙ্গে তারা সামাজিক ও লিঙ্গ বৈষম্যেরও সম্মুখীন হচ্ছে।
ইউরোপের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী হলেও তারা নানাভাবে গৃহে কিংবা সামাজিকভাবে বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। ইউরোপে পর্যাপ্ত আইন থাকলেও তা নারীদের যৌন হয়রানি রোধে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
অবশ্য ইউরোপে শুধু নারীরাই নানা ক্ষেত্রে হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তা নয় একই সঙ্গে এসব দেশে বসবাসকারী অভিবাসী এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে ব্যাপক বৈষম্য করা হচ্ছে এবং বহু ক্ষেত্রে তাদের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় দেশগুলোতে সংখ্যালঘু মুসলিম নারীদের ওপর বহু সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এসব দেশে বসবাসকারী মুসলিম নারীদের ইসলামি শালীন পোশাক বা হিজাব ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা উল্লেখ করা যায়। ইউরোপীয় সমাজ সাংস্কৃতিক ভিন্নতা বা বৈচিত্র্যের বিষয়টি মেনে নেয়ার পরিবর্তে মুসলিম নারীদের হিজাব ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তৎপর উগ্র খ্রিস্টান গোষ্ঠীগুলো কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে তাই নয় একই সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিরুদ্ধেও তারা অবস্থান নিয়েছে।
ইউরোপীয় সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হতে দেখা যায় এবং ইউরোপীয় দেশগুলো সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে মেনে নেয়ার পরিবর্তে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠদের অবস্থান ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে নারী হোক, মুসলিম হোক কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ যেই হোক না কেনো তাদের কাছে কোনো পার্থক্য নেই।