আইএস দমনে পাশ্চাত্যের সমরশক্তি প্রয়োগে হিতে বিপরীত ঘটবে
বৈদেশিক হামলার মুখে সদস্য দেশগুলোকে সুরক্ষা পৌঁছানোর ঘোষণা দিয়ে গড়ে ওঠে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর রণনীতি ভিত্তিক জোট ন্যাটো (নর্থ এটলান্টিক ট্রিটি আর্গানিজেশন)। অন্যভাবে বলা যায় শান্তি নিশ্চিত করাই ছিল ন্যাটো গড়ে তোলার উদ্দেশ্য। অস্ত্রশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শান্তি সুনিশ্চিত করা সম্ভব- এ হচ্ছে ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর প্রাথমিক ধারণা। সারা দুনিয়ায় মারণাস্ত্রবাবদ ব্যয়িত অর্থের ৭০ শতাংশের বেশি খরচ করে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। ন্যাটোর বিশেষ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো ওয়েলসে। ন্যাটোর ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে ঐ বৈঠকে। স্বঘোষিত ইসলামিক স্টেট প্রসঙ্গে নীতি নির্ধারণী বিবৃতি সেখানে পেশ করেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বিবৃতি প্রকাশের প্রয়োজন ছিল মনে করেন ভাষ্যকারেরা। তারা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে- কোথাও আগের পরিস্থিতি আজ আর বিদ্যমান নেই। মধ্যপ্রাচ্যে আজকাল যে বীভৎস সহিংসতা দেখা যাচ্ছে, এমনটি আগে দেখা যায়নি। ন্যাটোর জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে রয়েছে ইউক্রেন বেশ কিছু দিন ধরে।
পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ায় কঠোর অবরোধ আরোপের হুমকি দিতে থাকলেও প্রতিযোদ্ধা দেশ হিসেবে রাশিয়াকে ন্যাটো কখনো বিবেচনা করেনি। ন্যাটোর মতে রাশিয়াকে প্রতিযোদ্ধা দেশ ঘোষণার অর্থ হবে আর একবার স্নায়ুযুদ্ধ উসকে দেয়া। রাশিয়া ও পাশ্চাত্য- উভয় পক্ষেই মৈত্রী জোট ও সমঝোতা তৈরির ক্ষেত্রসহ ব্যবসা বাণিজ্যেও স্নায়ুযদ্ধের পরবর্তীতে রদবদল ঘটে গেছে বিস্তর। নতুন কোনো উৎস খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপরেই নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে ইউরোপকে। যে কারণে প্রচার চালিয়ে যাওয়া হলেও ইউক্রেনকে ন্যাটোর শামিল করে নিয়ে পুরোপুরি শত্রুর অবস্থানে রাশিয়াকে ঠেলে দিতে চাইবে না ন্যাটো। রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাত ন্যাটো চায় না। বরং রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগও সংলাপের সম্পর্ক ন্যাটো ধরে রাখতে চায়।
অবরোধ আরোপ করে রাশিয়াকে সংলাপে রাজী করানো সম্ভব হবে না- ন্যাটো বোঝে। এছাড়া তার মিত্র দেশগুলোকে ভাগিয়ে নিয়ে রাশিয়াকে কোণঠাসা করার পর অবরোধ আরোপ করলে রাশিয়া কাবু হয়ে যাবেÑ এই পরিকল্পনাতেও কারুর কোনো কল্যাণ হবে না। ইউক্রেনে রাশিয়া ভুল করে থাকলেও ইউক্রেনকে ঘিরে সংকট ঘোরতর হয়ে উঠতে পেরেছে পশ্চিমাদের ভুলের জন্য- একথা ভুললে চলবে না- মনে করেন পর্যবেক্ষকেরা। বিশেষভাবে গ্রেট বৃটেন ও সাধারণভাবে সারা ইউরোপের জন্য বড়ো এক সমস্যা ন্যাটো দেখতে পাচ্ছে- ইদানীং স্কটল্যান্ড প্রশ্নে। স্কটল্যান্ড পৃথক হবে না ইউকের সঙ্গে থাকবে এ প্রশ্নে গণভোট হতে যাচ্ছে সেকানে ১৮ সেপ্টেম্বর। তেল কে ঘিরে উদ্ভ’ত হয়েছে সমস্যাটি। স্কটল্যান্ড মনে কর নর্থ সীর তেলমজুদ কাজে লাগানোর একচ্ছত্র অধিকার তার হস্তগত হলে দুনিয়ার অন্যতম ধনী দেশগুলোর একটিতে পরিণত হবে স্কটল্যান্ড।
স্কটল্যান্ড প্রসঙ্গ ন্যাটো বৈঠকে তুলে ধরে ইউকে। পেছনের তিনশ’ বছর ব্যাপী ঐক্যের দোহাই নিয়ে ইউকের সঙ্গে থাকার স্কটল্যান্ডকে আহ্বান জানায় ইউকে। কিন্তু জ্বালানি স্বার্থের তাগিদে ভুভাগ বিশেষের ঐক্য ভেঙে বেরিয়ে পড়ার প্রবণতা সমকালীন বিশ্বে দেখা দিয়েছে বাস্তবতা হয়ে- এই তথ্যটি অস্বীকার করারও উপায় নেই।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক স্টেট প্রসঙ্গটি ন্যাটো সদস্যদেশগুলোকে বিবেচনায় নিতে দেখা যাচ্ছে ঐক্যের ভিত্তিতে নয়, বরং নিজস্ব ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে। তুরস্ক মনে করে আইএসকে মোকাবেলা করার প্রশ্নে তাকে বাদদিয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ ন্যাটোর পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়। অথচ এমন বেশ কিছু প্রশ্ন রয়েছে যার প্রস্তাবে তুরস্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমত হতে পারছে না। স্বাধীন ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ তুরস্ক প্রতিবেশী অঞ্চলে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মূল্যায়ন করতে চাইলেও আন্তর্জাতিক হুমকির সম্মুখীন হওয়ামাত্র ন্যাটোর সদস্য পদের দোহাই দিয়ে জোটের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতেও বিলম্ব করে না। অথচ প্রতিবেশী অঞ্চলকে ঘিরে তার নীতি নির্ধারণে ন্যাটোর শক্তিশালী সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শও মেনে নিতে তুরস্ক বাধ্য নয়-তা সে জানিয়ে দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়া সম্বন্ধে তুরস্কের রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন। এই দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান স্থির করতে আগ্রহী তুরস্ক। শুধু পশ্চিম নয়, রাশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলেও মৈত্রী সম্পর্ক রয়েছে তুরস্কের। এই তথ্যের এমন অর্থ করা যাবে না যে, কিছু কথিত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মোতাবেক পশ্চিমকে পরিত্যাগ করে শুধু পূর্বমুখী মৈত্রী গড়তে এগোচ্ছে তুরস্ক। তুরস্ক জানে এমন উদ্যোগ হবে তার জন্য আত্মঘাতী। সে পথ তুরস্ক ধরতে যাচ্ছে না। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মধ্যস্থলে অবস্থিত তুরস্ক নিজস্ব মূল্যবোধে ও মর্যাদাবোধে উজ্জীবিত হয়ে দ্রুত রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের পথে এগোচ্ছে। প্রতীচ্য ও প্রাচ্য উভয়ের সামনে একটি রোল মডেল হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করার লক্ষ্যে। আইএসএর অভ্যুদয়কে সন্ত্রাস ও সহিংসতার অভ্যুত্থান আখ্যায়িত করে সশস্ত্র সহিংসতার মাধ্যমে আইএসকে মোকাবিলা করার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর দেশগুলো যে ওকালতি শুরু করেছে-একদল বিদগ্ধ বিশ্লেষক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এর ফলে সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। উপরন্তু আরো বহুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত সমস্যা সম্প্রসারিত হবে। এই বিদগ্ধজনদের সুপারিশ হচ্ছে, পরস্পর সম্পর্কিত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। একইসঙ্গে তারা মনে করেন মানসিকতা পরিবর্তনের এই চেষ্টায় মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে সার্থক ভূমিকা নিতে পারবে একমাত্র তুরস্ক।