সামাজিক যোগাযোগের প্রভাব
আঞ্জুমান আরা বেগম
মনে করা হয় তথ্যপ্রযুক্তির অত্যাধুনিক সময়ে আমরা বাস করছি। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে এখন যোগাযোগ কোনো ব্যাপারই নয়, মুহূর্তেই সম্ভব। ফলে প্রত্যেকের জীবনেই এখন অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগ সাধারণ ঘটনা। আবার এ যোগাযোগ বাস্তব জীবন থেকে ভার্চুয়াল জগতেই বেশি। ফেসবুকিংই বর্তমান প্রজন্মের যেন ধ্যানজ্ঞান। এর প্রভাব সমাজে পড়ছে। বিশেষ করে নারীদের ওপর। ভলো-মন্দ দুটোই আছে এমন কিছু ঘটনার বিবরণ নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন আঞ্জুমান আরা বেগম
পরলোকগত বাংলাদেশের বিখ্যাত একজন অভিনেতার কন্যা ঐন্দ্রিলা অসম্ভব সুন্দরী, মেধাবী সু-অভিনেত্রীও বটে। আজ থেকে ১০-১২ বছর আগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এক তরুণের সাথে পরিচয়। প্রেম, অতঃপর বিয়ে। শেষমেশ দেখা গেল সেই ছেলেটি আসলে তার পরিচয় গোপন করে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ঐন্দ্রিলাকে বিয়ে করেছিল। কারণ সময় গড়াতেই ঐন্দ্রিলা টের পায় ছেলেটি আসলে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড, সে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেছে তা-ও মিথ্যে। এসব কথার সত্যতা জানতে চাইলে ছেলেটি মেয়েটিকে গায়ে হাত তুলত। ঠিকমতো দাম্পত্য কোনো সম্পর্কই চলত না। আর তাই ঐন্দ্রিলা সব মায়া কাটিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসে চিরদিনের মতো।
ঘটনা-২ : মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে আবির। নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করত; সেটা আজ থেকে আট বছর আগের কথা। অফিসের কাজের ফাঁকে দেশ-বিদেশের বন্ধুদের সাথে চেনাজানা, কথা বলা, চ্যাট করা এমনি করে কানাডার ভেনকুবারের বাসিন্দা ডরিনের সাথে পরিচয়। মেয়েটা দেখতে খুই সুন্দরী, দুধে-আলতা গায়ের রঙ, মন একেবারে বাঙালি মেয়েদের মতো। একবার আবির ডরিনকে বাংলাদেশে বেড়াতে আসতে বললে ডরিন তো খুবই খুশি। সেই বছরের সামার ভ্যাকেশনে কলেজ ছুটি হলেই ১৮ বছরের মেয়েটি মা-বাবাকে বলে বাংলাদেশে চলে আসে। আর মনে মনে প্রিপারেশন নিয়ে রাখে ছেলেটি রাজি থাকলে বাংলাদেশেই মেয়েটি তাকে বিয়ে করবে। যেই কথা সেই কাজÑ ডরিনকে দেখে আবিরের বাবা-মা, ভাই-বোন খুবই পছন্দ করল। আর ওদের বিয়েও হয়ে গেল। বিয়ের পর ডরিন আবিরকে কানাডায় নিয়ে গিয়ে ভালো চাকরির ব্যবস্থাও করল। সাথে সাথে আবিরের বাবা-মা, ভাই-বোনও কানাডায় সেটেলড হয়ে সবাই এখন খুবই ভালো আছে। এই তো গত জুলাই মাসে সবাই বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিল।
ঘটনা-৩ : ঢাকার ইংলিশ মিডিয়াম ও নামীদামি বাংলা মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রছাত্রী পিয়াস, ত্বন্বী, তাপস, বিপাশা, ছন্দা খুবই ভালো পড়ালেখায়। ওরা সারাক্ষণই যেন একসাথেই থাকে। স্কুলের সময় ছাড়া কোচিং, বাসার বাইরে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম সেলফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াইটআপ, টুইটার, ভাইভার। কারণ, ওরা যখন যেখানে যা করছে সবই চলে যাচ্ছে স্মার্টফোনের মাধ্যমে এসব ওয়ের সহায়তায়। খুব ভালো কথা, এভাবে দিনকাল ওদের ভালোই কাটছিল। পড়াশোনা, বিদেশী বন্ধুদের সাথে একসাথে গ্রুপ চ্যাট করা, নতুন কোনো প্রযুক্তির উদ্ভাবন সবই যেন এক মুহূর্তে পেয়ে যায় যেকোনো একজন তা শুনতে পেলে। এভাবে কিছু দিন আগে বিপাশা ও তাপসের কানে ও ব্রেনে একটা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। এর কারণ হিসেবে ডা: বলেছেন, সারাক্ষণ ফোনে কথা বলা, ঘুম কম ও রাতভর একটানা কম্পিউটার বা সেলফোনের আলোকরশ্মির নেগেটিভ প্রভাব কান ও ব্রেনের স্নায়ুগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে। এতে ভবিষ্যতে হয়তো স্নায়বিক কোনো প্রবলেম হতে পারে।
ঘটনা-৪ : সুন্দরী মেরির বিয়ে হয়েছে তাপস নামের এক গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর সাথে। অত্যন্ত শান্তশিষ্ট ও ভদ্র বলে পরিচিত লোকটি দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই যেন বিজি থাকে ব্যবসার কাজকর্ম নিয়ে। তাই মেরি তার অবসর সময় কাটায় ফেসবুক ও টুইটারে। কারণ বড় লোকের স্ত্রী হওয়ায় ৬-৭টা চাকরবাকর ঘর-গৃহস্থালি সামলায়। একমাত্র মেয়ে তাকেও দেখে কাজের বুয়া। সন্তানের স্কুল বাড়ির পাশে। সুতরাং মেরির চলমান দিন কাটে এই ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডদের নিয়ে। তেমনি দেশ-বিদেশের ফ্রেন্ডদের মধ্য থেকে হঠাৎ সুদর্শন জাভেদ মেহতা নামের ইন্ডিয়ান ওর প্রেমে পড়ে। দিনে দিনে বন্ধুত্ব, ভালো লাগা, একটু একটু প্রেম নিবেদন। এসব ঘটনা মেরি বুঝতে পেরে ওকে আনফ্রেন্ড বানিয়ে ব্লক করে দেয় যাতে মেরিকে ও আর বিরক্ত না করে; কিন্তু মেরি লোকটিকে ইগনোর করে আনফ্রেন্ড করার কারণে একদিন জাভেদ মেরির প্রোফাইল হ্যাক করে ওর প্রোফাইলে ঢুকে উল্টাপাল্টা কনভারসেশন লিখে সব মেরির স্বামী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, মা-বোন ভাইকে পোস্ট করে দেয়। এতে মেরির রেপুটেশন যায় নষ্ট হয়ে। স্বামী ও আত্মীয়স্বজন ওকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে; কেউ ওর সাথে মেশে না। দাম্পত্য কলহ শুরু হয়Ñ এখন স্বামী-স্ত্রী একই বাড়ির দুই ঘরে ঘুমায়; কেউ কারো মুখ দর্শন পর্যন্ত করে না। শুধু একটি সন্তান ও সামাজিক কারণে সম্পর্কটি কোনোমতে টিকে আছে। অথচ মেয়েটি এ সমস্যায় পড়েছে নিজের ভুলের কারণেই। অচেনা কাউকে যাচাই-বাছাই না করে বন্ধুত্ব করা অনেক সময়ই বিপদ বয়ে আনে।
সরকারি তিতুমীর কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তালাত সুলতানা বলেন, সমাজে ফেসবুকের নেগেটিভি এবং পজেটিভ প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, গ্লোবালাইজেশনের যুগে ফেসবুক বা অন্য যেকোনো উন্নত প্রযুক্তি থেকে কেউ পিছিয়ে থাকুক আমি তার পক্ষে নই। সেটা বৃদ্ধ বয়সে হোক, অল্প বয়সে হোক অথবা আমাদের মতো মাঝবয়সী হোক, সে উদ্দেশ্যে আমি একে পজেটিভই বলব। যেহেতু মুহূর্তেই আমরা দেশ-বিদেশের খবর জানতে পারি টুইটার, ফেসবুক, সাইবার, হোয়াটস আপ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তের খবর মুহূর্তেই চলে আসে। এটা শুনে আমার খুবই ভালো লাগে যে আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন কত বেশি কিছু জানে এবং জানার সুযোগ বেড়েছে। আমারও টিনএইজ মেয়ে আছে। আমি দেখি ওরা কত বেশি এগিয়ে আছে। কম্পিউটার রিলেটেড অনেক নিউজই আমি আমার মেয়ের কাছ থেকে জানতে পারছি। এই অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন, প্রতিমূহূর্তে পৃথিবী যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেভাবে এগিয়ে যেতে পারছে এই ফেসবুকের আপগ্রেডের মাধ্যমে। প্রতিদিনের ফ্যাশন, নতুন আবিষ্কার, মুহূর্তেই খেলার খবর, রাজনীতি সব যেন হাতের মুঠোয়। যেকোনো অজানা বিষয় জানতে গুগল সার্চ দিয়ে পেয়ে যাচ্ছে। এতে নিজের পড়াশোনা সম্পর্কিত অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে পারছে মনের মতো করে। এটা আমার কাছে অনেক বেশি আনন্দের ও সুখকর বলে মনে হয়। এটা আমরা যদি অন্যভাবে দেখি তাহলে ফেসবুকের নেগেটিভ সাইড। তবে আমি একজন সমাজবিজ্ঞানী বা অভিভাবক হিসেবে বলতে চাই ভার্চুয়াল এই ফ্রেন্ডশিপের ক্ষেত্রে অনেকে নকল ছবি ও নকল ইনফরমেশন দিয়ে একে অন্যের সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এ রকম বহু অঘটন ঘটছে সমাজে, যা আপত্তিকর। যাকে সাইবার ক্রাইম বলে অভিহিত করা হয়। এটা ছাড়াও অনেক ধরনের ক্রাইম তো প্রতিদিন আমাদের চার দিকে হচ্ছেই, তবে ফেসবুকের ক্রাইম ধরা খুব সহজ নয়। অর্থাৎ সহজে যে কেউ ক্রাইম করতে পারে। এতে অনেক তরুণী বিপথগামী হয়ে ঘর ছেড়েছে, জীবন বিপন্ন হয়েছে। এসব বিপদ থেকে সন্তানকে রক্ষা করার জন্য প্রথমেই মা-বাবাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সন্তান কখন কী ধরনের পেইজ ইন্টানেটে উল্টাচ্ছে, কাদের সাথে তার বন্ধুত্ব তা খতিয়ে দেখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা সন্তানের মগজে খুব স্বাভাবিক পারিবারিক পরিবেশ দিয়ে তাকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে, তাতে ছোটবেলা থেকেই শিশুটি সুবুদ্ধি বিবেচনাসমৃদ্ধ একজন মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠলে বড় হয়ে সে অন্তত ভুল কাজটি করার আগে দশবার চিন্তা করবে। এ ব্যাপারগুলো সবচেয়ে সাপোর্ট দিতে পারেন মা, স্কুলের শিক্ষক, বাবা ও গুরুজনেরা। কারণ তাদের কাছ থেকেই তো ভালো-মন্দ বিচার করতে শিখতে হয়। তবে শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের ক্ষেত্রে বলতে চাই, সারা রাত জেগে ফেসবুকে চ্যাট করা, একদৃষ্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা শরীর, চোখ ও ব্রেনের ওপর মারাত্মক ক্ষতি করে আর অচেনা কাউকেই ফ্রেন্ড করার সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তা ছাড়া পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অপপ্রভাব ছাড়াও নানা ধরনের মুভি, ফ্যাশন যা নৈতিক মূল্যবোধে প্রভাব পড়তে পারে এসব এড়িয়ে যদি তারা শুধু পজেটিভলি ফেসবুককে ব্যবহার করে তাহলে মন্দ হয় না। বড়দের ক্ষেত্রে বলব, রিটায়ার্ড করার পর অথবা একাকিত্ব কাটানোর জন্য এটা খুব ভালো একটা মাধ্যম। কারণ আমার মা মারা গেছেন; বাবা একজন আইনজীবী। তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে যোগাযোগ করে নিজেকে অনেকটাই ব্যস্ত রাখেন। এতে তার একাকিত্ব কেটে যায়। প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যাতে করে কেউ যেন সহজেই ফেসবুক একাউন্ট হ্যাগ না করতে পারে।