স্কটল্যান্ডের গণভোটের দিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব
বহুচর্চিত গণভোট শুরু হয়েছে স্কটল্যান্ডে। স্কটল্যান্ড ব্রিটেনে থাকতে চায় নাকি সব বাঁধন ছিঁড়ে স্বাধীন হবে, জবাব মিলবে ওই গণভোটে। সেই উত্তর জানতেই আজ গণভোটের চূড়ান্ত রায়ের দিকে তাকিয়ে গোটা দুনিয়া। ফলে সময় যত গড়াচ্ছে, জল্পনার পারদ চড়ছে।
স্কটল্যান্ডে স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট কেবল গ্রেট ব্রিটেনকে নয়, পুরো বিশ্বকেই বিভক্ত করে ফেলেছে। কোনো কোনো দেশ বা জাতিগোষ্ঠী স্কটল্যান্ডের স্বাধীতা পাওয়ার সম্ভাবনায় যেমন উজ্জীবিত, আবার নিজ দেশে ওই ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে মনে করে কয়েকটি দেশ এর ঘোর বিরোধী।
স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে ব্রিটেনের শক্তি হ্রাস পাবে এমন সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ায় রাশিয়া বেশ খুশি। খুশি স্পেনের বার্সেলোনা ও বাস্ক এলাকার মানুষ। তবে নাখোশ স্পেন। ভারত, চীনও চাচ্ছে না স্কটিশরা স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিক।
যুক্তরাজ্যের সম্ভাব্য ভাঙনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ হতবুদ্ধিকর অবস্থায় পড়ে গেছেন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘যুক্তরাজ্যের ভাঙন? আমার মনে হয় না, সে ধরনের কোনো আশঙ্কা আছে। ঈশ্বর না করুন!’ তবে তিনি অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘এটা স্কটল্যান্ডের ব্যাপার। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।’
ক্যাটালানরা ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় গণভোটের বিষয়টির দিকে তীèভাবে তাকিয়ে আছে। তারা মনে করছে, স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে তারাও স্পেনের কবল থেকে মুক্তি পাবে। বার্সেলোনার মেয়র হ্যাভিয়ার ত্রিয়াস বলেন, ‘আমাদের আশা করি, ক্যাটালোনিয়ার প্রতি যেন শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়, ঠিক যেমনভাবে স্কটল্যান্ডের প্রতি যুক্তরাজ্য সরকার দেখিয়েছে।’
বৃহস্পতিবার বার্সেলোনার রাজধানীতে হাজার হাজার লোক স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে মিছিল করে।
স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যারিয়ানো রাজয় আবারো তার দেশের কোনো অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এমন দাবি হবে অবৈধ।
চীন কিন্তু বেশ উদ্বেগের সাথে স্কটল্যান্ডের বিষয়টি লক্ষ করছে। স্কটিশরা হ্যাঁ ভোট দিয়ে স্বাধীনতা পেয়ে গেলে তাতে উজ্জীবিত হতে পারে তিব্বত ও জিনজিয়াং। ফলে বিষয়টি চীনা নেতাদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম দিকে লন্ডন সফরকালে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং গণভোট প্রশ্নে জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘তারা শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ যুক্তরাজ্য’ চান।
যুক্তরাজ্য ভেঙে যাচ্ছে- এমনটা ভেবে বেশ খুশি রাশিয়ার জাতীয়তাবাদীরা। তারা মনে করছে, এর ফলে তাদের শত্রু লন্ডন বেশ চাপে পড়বে আর ভøাদিমির পুতিনের অবস্থান আরো পোক্ত হবে।
উল্লেখ্য, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ওয়েলস এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড- এই চারটি ভূখণ্ড নিয়ে হলো গ্রেট ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ সাংবিধানিক কাঠামোয় থেকে এরা নির্দিষ্ট ক্ষমতা ভোগ করে।
১৭০৬ সালের আগে স্কটল্যান্ড স্বাধীন দেশই ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আধিপত্যকে আরো মজবুত করতে ১৭০৬ সালের ২২ জুলাই ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের নেতারা মতৈক্যের ভিত্তিতে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। একে বলা ট্রিটি অফ ইউনিয়ন বা সংযুক্তিকরণ চুক্তি। এর ফলে ১৭০৭ সালের পয়লা মে থেকে গ্রেট ব্রিটেনে যোগ দেয় স্কটল্যান্ড।
৩০৭ বছর গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে থাকার পর স্কটল্যান্ডের অভিযোগ, নানা ইস্যুতে তারা বঞ্চিত। লন্ডনের কর্তারা এ জন্য দায়ী। তাই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে পথে নামে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি। এই দলের নেতা অ্যালেক্স স্যালমন্ড ২০১১ সাল থেকেই স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করছেন। প্রথমে স্কটরা এ বিষয়ে পাত্তা না দিলেও ক্রমশ জনমত শক্তিশালী হয়েছে অ্যালেক্স স্যালমন্ডের পক্ষে।
স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির আন্দোলনের জেরে ঠিক হয়, চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর একটি গণভোট নেয়া হবে। স্কটল্যান্ডের সাধারণ মানুষই ঠিক করবেন, তারা ব্রিটেনে থাকবেন নাকি ভেঙে বেরিয়ে যাবেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে যথেষ্ট চাপে ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, উপ-প্রধানমন্ত্রী নিক কেইগ এবং বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড এক সুরে বলেছেন, স্কটদের আরো ক্ষমতা দেয়া হবে। রাজনীতিক, আর্থিক, আইনি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাড়ানো হবে ক্ষমতা। কিন্তু তারা যেন ব্রিটেন ছেড়ে না বেরোন। স্কটল্যান্ডের সাধারণ মানুষের মন জয় করতেই এই চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।
আবেগ উসকে দিয়ে ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, ‘ব্রিটেন একটি পরিবার। ব্রিটিশরা সেই পরিবারের সুখী সদস্য। মনে রাখবেন, ওয়াল্টার স্কটের মতো কবি, আলেকজান্ডার ফেমিংয়ের মতো বিজ্ঞানী, জে কে রাওলিংয়ের মতো সাহিত্যিক, অ্যান্ডি মারের মতো খেলোয়াড় উঠে এসেছেন স্কটল্যান্ড থেকেই। স্কটল্যান্ড আমাদের গর্ব।’
তবে আপাতত এখন স্কটল্যান্ডের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা সেখানকার নাগরিকদের হাতে৷ তাঁরা যদি স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেন, তবে তিনশো বছরের ব্রিটিশ শাসনে থাকার পর মুক্তি পাবে স্কটল্যান্ড৷ সারা দুনিয়ার মানুষ আপাতত সেই ঐতিহাসিক রায়ের দিকেই তাকিয়ে।