অজুহাত আইএস, লক্ষ্য আসাদ
সাইফুল সামিন: যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পদক্ষেপকেই সরল-মনে নেওয়ার উপায় নেই। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের নির্মূল করতে সিরিয়ায় হামলা চালানোর মার্কিন ঘোষণাটি আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ মনে হয়। কিন্তু বৃত্তের বাইরের ভাবুকদের চোখে আইএস একটি অজুহাত মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য দামেস্কের বর্তমান সরকারের পতন।
বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে গত সপ্তাহে জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ১৫ মিনিটের ওই ভাষণে তিনি আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন উদ্যোগের কৌশলগত রূপরেখা তুলে ধরতে গিয়ে ইরাকের মতো সিরিয়ায়ও বিমান হামলা চালানোর ঘোষণা দেন।
ওবামার ঘোষণাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন বিশ্লেষক প্যাট্রিক মার্টিন ও ওয়াশিংটনভিত্তিক খ্যাতিমান ফ্রিল্যান্স লেখক মাইক হুইটনি।
উদারবাদী হুইটনির ভাষ্য, পূর্বসূরি জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো ওবামাও মার্কিনিদের বিভ্রান্ত করতে যাচ্ছেন। আইএসের জঙ্গিদের দমনের কথা বলা হলেও তাঁর ভাষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়। অঞ্চলটিতে নৈরাজ্য সৃষ্টি, বিদ্যমান সীমান্ত নিশ্চিহ্ন করা ও ক্রীড়নক সরকার বসাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
আইএসের উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত গল্পকে চ্যালেঞ্জ করে রীতিমতো হাঁড়ির খবর দিয়েছেন মার্টিন ও হুইটনি। মূলত পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের সহযোগীরা জঙ্গিগোষ্ঠীটিকে সৃষ্টি করেছে বলে দাবি হুইটনির । তাঁর ভাষ্য, আরেকটি রক্তক্ষয়ী আগ্রাসনের পথ সুগম করতেই গোষ্ঠীটিকে তৈরি করা হয়েছে। আইএসের জন্মকে মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের উপজাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মার্টিন।
হুইটনি ও মার্টিনের এই ভাষ্যকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সন্ত্রাসী তৈরি করে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের নামে সারা বিশ্বে ঝামেলা পাকানোর মার্কিন কৌশল এখন আর কারও অজানা নয়। যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থেই এই যুদ্ধকে বাঁচিয়ে রেখেছে, বাঁচিয়ে রাখবে। আইএস দমনের যুদ্ধও একই লক্ষ্যে পরিচালিত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যনীতি, আগের ঘটনাবলি ও ওবামার ভাষণ বিশ্লেষণ করলে আইএসবিরোধী যুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়।
ওবামা বলেছেন, ‘আমাদের দেশের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা যেকোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের খুঁজে বের করব।’
তার অর্থ দাঁড়ায়, ওবামার এই নতুন যুদ্ধের কোনো ভৌগোলিক সীমা নেই। জঙ্গি দমনের নামে ওয়াশিংটন শুধু ইরাক ও সিরিয়াতেই বোমা ফেলবে না, ভবিষ্যতে যেকোনো দেশেই হামলা চালাতে পারে। মার্কিন স্বার্থের কাছে আন্তর্জাতিক আইন, সীমান্ত বা জাতীয় সার্বভৌমত্ব তুচ্ছ। আসল হলো তেল, অর্থ ও ক্ষমতা।
আইএসকে এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না হলে গোষ্ঠীটি পুরো অঞ্চলসহ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন ওবামা। কিন্তু আইএস কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তার ব্যাখ্যা নেই। মার্কিন লেখক হুইটনির দাবি, এই দাবি পুরোপুরি বাগাড়ম্বর। সত্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য আইএস কোনো হুমকি সৃষ্টি করেনি। মাত্র ১২ মাস আগেই আসাদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ এনে দেশটিতে বিমান হামলা চালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন ওবামা। বিশ্লেষক প্যাট্রিক মার্টিনের ভাষ্য, সেই একই উদ্দেশ্য অর্জনে এবার ভিন্ন পন্থা নিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সিরিয়ায় হামলা চালাতে আইএসকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি। তাঁর উদ্দেশ্য আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে দামেস্কে মার্কিন-সমর্থিত একটি অথর্ব সরকার বসানো।
আইএস দমনে যুক্তরাষ্ট্রসহ যেকোনো দেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দামেস্ক। কিন্তু ওয়াশিংটন ও তার মিত্ররা এ প্রস্তাব নাকচ করেছে। সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে বিমান হামলার পরিকল্পনা করলেও দেশটির সরকারের সঙ্গে কাজ করবে না ওবামা প্রশাসন।
দামেস্ক বারবার সতর্ক করে বলছে, সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে হলে অনুমোদন নিতে হবে। সমন্বয় ছাড়া যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপ আগ্রাসন বলে বিবেচিত হবে।
ইরাক-সিরিয়ায় জঙ্গিদের ওপর একতরফা মার্কিন হামলা হলে তা ‘আইনের স্থূল লঙ্ঘন’ হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে দামেস্কের মিত্র মস্কো। আরেক মিত্র ইরানও হুঁশিয়ার করেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। এদিকে সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখাতে বলেছে চীন।
যে যা-ই বলুক না কেন, তাতে ওবামা কান দেবেন বলে মনে হয় না। তিনি তাঁর ভাষণে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, আইএসবিরোধী যুদ্ধে আসাদকে সহযোগী হিসেবে দেখছেন না তিনি। বরং আসাদের পতন অনিবার্য।
আসাদের সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাঁর প্রতিপক্ষকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোন বিশেষ স্বার্থ হাসিলের মতলব আঁটছে, তা বুঝতে কারও বাকি থাকার কথা নয়।
সবার নজর থাকবে নৃশংস আইএসের দিকে। যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাবে তার গোপন ছক ধরে। –প্রথম আলো