আমাদের জীবনে ঈদ : উৎসব ও শিক্ষা

eidহাসনাইন হাফিজ: আমাদের ভাষায় ঈদ মানে আনন্দ হলেও শাব্দিক ও সার্বিক বিবেচনায় ঈদ অর্থ শুধুই আনন্দ বা আনন্দ-উচ্ছ্বাস নয়, খুশির বন্যা, ভোগাসক্তি বা অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছলতাও নয়, বরং ঈদও একটি ইবাদত। ঈদুল আজহা যেমন হজ ও কোরবানির ঈদ, তেমনি ঈদুল ফিতর রোজা রাখা ও ফিতরা দানের ঈদ। উভয়টাই পৃথক এক একটা ইবাদত। তবে এই ইবাদতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আনন্দ।
মাসব্যাপী সিয়াম সাধনায় পুরস্কারের আশা অন্তরে পোষণ করাই হলো রোজা রাখার আনন্দ। আল্লাহর রহমত, গুনাহের ক্ষমা, দোজখ থেকে মুক্তি, শবেকদরে হাজার বছরের পুণ্য ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যলাভ—এ সবই রোজাদারের পুরস্কার। রোজাদার রোজা শেষে প্রত্যক্ষভাবে পুরস্কারগুলো না পেলেও তিনি বুঝতে পারেন, এগুলো তিনি পাবেন। তবে রোজা কবুল হওয়া-না হওয়া নিয়ে একটা সংশয় অবশ্যই থাকে। একবার হজরত আবু বকর (রা.) ঈদের দিন সকালে ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদছিলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার রোজা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে কিনা আমি তো নিশ্চিত নই, তাহলে খুশি হব কিসের ভিত্তিতে?’ পক্ষান্তরে গরিব-দুঃখীর মুখে হাসি ফোটাতে, তাদের ভালো খাওয়াতে ও পরাতে, তাদের সন্তানদের মুখে মিষ্টান্ন, ঈদের দিনে দু’মুঠো খাবার আর গায়ে নতুন জামা তুলে দিতে ধনীদের ফিতরাদান হলো রোজার আরেকটি আনন্দ।
আর ঈদের সূচনা হয় এভাবে—বায়হাকি শরিফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় উপস্থিত হলেন তখন তিনি তাদের দুটি উত্সব পালন করতে দেখেন। আর এ উপলক্ষে তারা বিভিন্ন আনন্দ-অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা যে এ দুটি জাতীয় উত্সব পালন কর, এর মৌলিকত্ব ও বিশেষত্ব কী? তারা বলল, আমরা অন্ধকার যুগে এ দুটি উত্সব পালন করতাম এবং তা আজও করছি। একথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহপাক তোমাদের এ দুটি উত্সবের পরিবর্তে এর চেয়ে অধিক উত্তম দুটি দিন ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর দান করেছেন। সুতরাং আগের উত্সব বন্ধ করে এ দুটি দিনের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানগুলো পালন করা শুরু কর।’ নিছক আনন্দ-উত্সব ও খেল-তামাশা এবং বাহারী দামি পোশাক-পরিচ্ছদের প্রদর্শনীর নাম ঈদ নয়। এতে ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুনের পরিবর্তে অনৈসলামিক কার্যকলাপের প্রসার ঘটে, যা পবিত্র ইসলামে কল্পনাও করা যায় না। ইসলামের আনন্দ-উত্সব হবে আল্লাহর নির্দেশ, নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী। এর বাইরে কোনো কিছুকে ইসলামের আওতাভুক্ত করা যায় না। এজন্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) জাহেলি যুগের বাহারী খেল-তামাশার আনন্দ-উত্সবকে বাতিল ঘোষণা করেছেন, আল্লাহর দেয়া বিধানকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। আমরা ঈদ উত্সবকে পরিণত করেছি বিলাসের উত্সবে। এদিনে কে কত দামি পোশাক পরে, কে কত পোলাও, কোর্মা, রোস্ট, রেজালা, বিরিয়ানি, জর্দা ও ফিরনি ইত্যাদি অধিক পরিমাণে রান্না করতে পারে—এসবের প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু ইসলামের আদর্শ কি এটা? মুসলমানদের ঈদের আনন্দ হলো, স্বার্থ ত্যাগের মাধ্যমে অভাবী, নিরন্নকে সাহায্য করার প্রাপ্ত আনন্দ। পরিতাপের বিষয়, আমাদের ঈদ-উত্সব এখন বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। ত্যাগের উত্সব পরিণত হয়েছে ভোগের উত্সবে। ঈদের দিনগুলোতে আমরা সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। তারা দিনে নিজের ভালো, পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড় পরিধান করতেন। অনেক বেশি দান করতেন। এমনকি সাধ্যের সবটুকু বিলিয়ে দিতেন। দীর্ঘ সময় মসজিদে কাটাতেন। অন্যান্য ইবাদতও বেশি করতেন। তাতেই অনেক বেশি আনন্দিত হতেন। পক্ষান্তরে আমাদের ঈদ-উত্সবে ত্যাগটা গৌণ, আর ভোগ ও ভোজনটাই মুখ্য। আমরা নাচ, গান, আড্ডা ও টেলিভিশন দেখে সময় নষ্ট করে দেই। মসজিদেও বেশিক্ষণ থাকতে চাই না। দামি ও বাহারী পোশাকের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হই এই দিনে। আবার কেউ কেউ ফিতরা দিতেও ইতস্তত বোধ করি। অথচ হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ফিতরা, জাকাত রোজাদারকে বেহুদা, অবাঞ্ছনীয় ও নির্লজ্জতামূলক কথাবার্তা বা কাজকর্মের মলিনতা থেকে পবিত্র করার এবং গরিব-মিসকিনদের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে অবশ্যই আদায়যোগ্য। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগেই তা আদায় করবে তা ওয়াজিব ফিতরা হিসেবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পর তা আদায় করবে, তা সাধারণ দানরূপে গণ্য হবে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)। প্রিয়নবী (সা.) ঈদের দিন সকালে পরিবার-পরিজন ও পাড়া-পড়শিদের সচেতন করে তুলতেন তাদের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) প্রত্যেক ঈদেই তার মেয়ে ও স্ত্রীদেরকে ফিতরা, দান-সাদকা আদায়ের নির্দেশ দিতেন। (মুসনাদে আহমদ)
সদকায়ে ফিতর আদায়ের ফলে একজন দীন-দরিদ্র লোকও ঈদের আনন্দে সামান্য হলেও শরিক হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে আজ যেভাবে ঈদ উত্সব পালন করা হয় তা কি প্রকৃত ঈদের আনন্দের আবেদনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এর উত্তর খুঁজলে নেতিবাচক জবাবই বেরিয়ে আসবে। রোজার সংযম, আত্মশুদ্ধি, ত্যাগ এবং ঈদের উদ্দেশ্য ও স্বরূপ থেকে আমরা আজ বহুদূরে অবস্থান নিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে ঈদের আনন্দ-উত্সব হচ্ছে, ইসলামী জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি এবং সর্বজনীন আবেদনময়, যা উত্কট পঙ্কিলতার সংস্পর্শ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহপাক খুশি হন তখন, যখন তার দেয়া নেয়ামতের শোকর আদায়ের গুণ বান্দার মাঝে প্রকাশ পায়। ঈদের পুণ্যময় আনন্দের মাঝে নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশনার বাস্তবায়ন যত বেশি হবে ততই ঈদ-উত্সব সফল ও সার্থক হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button