নতুন যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
বদরুদ্দীন উমর
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আর কোনো বিশ্বযুদ্ধ হয়নি। সেটা না হওয়ার মূল কারণ পারমাণবিক বোমা। এ বোমা আবিষ্কৃত ও ব্যবহারের পর এর মারণক্ষমতা যে আকারে দেখা গেছে তাতে এই অস্ত্র নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হলে কোনো পক্ষেরই জয় হওয়া সম্ভব নয়। এ যুদ্ধ দুই পক্ষের জন্যই আত্মঘাতী। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে লাখ লাখ মানুষকে হতাহত করা হয়। তার ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে যেসব রোগের বিস্তার হয় তার থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জাপানিরাও রক্ষা পাননি। অনেকে এখনও ভুগছেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে এই অস্ত্রের ধ্বংস ক্ষমতাই সব থেকে বিপজ্জনক ব্যাপার। বলা দরকার যে, ১৯৪৫ সালে জাপানে যে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল বর্তমানে তার থেকে শতগুণ বেশি ধ্বংস ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বোমা আমেরিকা থেকে নিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান এবং ইসরায়েলের হাতে রয়েছে। এই অবস্থায় লাখ লাখ কোটি ডলার খরচ করে এসব দেশ নিজেদের পারমাণবিক ধ্বংস ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ চালালেও এর ধ্বংস ক্ষমতাই এর ব্যবহার ঠেকিয়ে রেখেছে। এদিক দিয়ে এই যুদ্ধাস্ত্র বাবদ যে খরচ হয় তার সবটাই অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যাতে এই অপচয় বন্ধ হওয়ার কোনো আশা এখন নেই। ১৯৪৫ সালে জাপানে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে হুমকি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তার এই শক্তিকে হিসাবের মধ্যে রেখেই শান্তি আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় চুক্তি করতে হবে। এই হিসাব সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নিজের মতো করে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের উদ্যোগ সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে এবং অল্পদিনের মধ্যেই আণবিক বোমা তৈরি করে পাল্টা পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের একুশ বছর পর হয়েছিল বিশ্বজোড়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। কিন্তু দুই পক্ষের হাতে পারমাণবিক বোমার মতো বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার কারণেই আজ পর্যন্ত কোনো তৃতীয় মহাযুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধ হয়নি।
কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ না হলেও যুদ্ধের শেষ তো হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। কারণ পুঁজিবাদ এবং যুদ্ধ পরস্পরের সঙ্গে এমনই অবিচ্ছেদ্য যে, বিশ্বে পুঁজিবাদ যতদিন আছে ততদিন যুদ্ধ বন্ধের কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই ১৯৪৫ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধ দুনিয়ার কোথাও না কোথাও লেগেই আছে। ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করেছিল ইসরায়েল রাষ্ট্র। তার পর শুরু হয়েছিল কোরিয়ার যুদ্ধ। যুদ্ধ চলেছিল ভিয়েতনামে, আফ্রিকায়, লাতিন আমেরিকায় এবং কোথায় নয়? বিশ্বযুদ্ধের পরিবর্তে স্থানীয় এবং আঞ্চলিক যুদ্ধ ধারাবাহিকভাবে চলেই আসছে এবং তার মাধ্যমে পুঁজিবাদ শুধু নিজের যুদ্ধাবস্থাই বৃদ্ধি করে আসছে তাই নয়, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছে। নিজেরা নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইর মাধ্যমে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে এবং ইরাকে সাদ্দামের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুদের মিথ্যা অভিযোগ তৈরি করে আফগানিস্তান এবং ইরাকে বিরাট আকারে যুদ্ধ বাধিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমেরিকান পুঁজির খেদমত করেছিল। এ দুই যুদ্ধের নাকানিচুবানি খাওয়া সত্ত্বেও তাদের কিছু যায় আসেনি। কারণ তার মাধ্যমে আমেরিকান পুঁজির স্বার্থসিদ্ধ হয়েছিল। অল্প কিছুদিন দম নেওয়ার পর তারা এখন আবারও ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধে নামছে। পুঁজির বাধ্যবাধকতার ঊধর্ে্ব কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা কংগ্রেসের ওঠার ক্ষমতা যে নেই এটা এখন নতুনভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।
অরাষ্ট্রীয় (হড়হ-ংঃধঃব) সংগঠনের কাছে অস্ত্র বিক্রির জন্য তারা নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে যেভাবে গত কয়েক দশক ধরে আল কায়দাসহ অসংখ্য ছোট-বড় সন্ত্রাসী সংগঠন বিশ্বজুড়ে খাড়া করেছে, তেমনি তাদের এই খেলার সর্বশেষ খেলোয়াড় হলো ইরাকের ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামে ইসলামী মৌলবাদীদের এক চরম প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন। তারা এখন ইরাকে এক বড় ধরনের সশস্ত্র উপদ্রব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই বিপজ্জনক উপদ্রব সৃষ্টি করে তারা সেটা দমনের জন্য মাঠে নামছে। ‘ইসলামিক স্টেট’ নামধারী এই অদ্ভুত সংগঠনটি ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কিছু অংশ দখল করে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। ইরাকে ইসলামিক স্টেটের সামরিক সাফল্য এবং অগ্রগতি হতে থাকায় প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষণা করেছিলেন যে, তারা আগের মতো ইরাকে কোনো যুদ্ধে আর জড়িত হবেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই নির্লিপ্ততা বজায় রাখা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি তার সেই অবস্থান থেকে সরে এসে এখন ইরাক ও সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করেছেন। এটা কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যাপার নয়। মনে রাখা দরকার যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যতই ক্ষমতাধর হন তিনি এবং সেই সঙ্গে মার্কিন কংগ্রেস মার্কিন পুঁজির আজ্ঞাবাহী। এই পুঁজির অন্তর্নিহিত তাগিদ হচ্ছে মুনাফা এবং আরও মুনাফা। ওয়াকিবহাল মহলের এটা অজানা নয় যে, মার্কিন অর্থনীতির তিন-চতুর্থাংশ হচ্ছে যুদ্ধ-অর্থনীতি। যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত উৎপাদনেই তাদের তিন-চতুর্থাংশ পুঁজি নিয়োজিত আছে। এই পুঁজির মুনাফা, এমনকি অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন যুদ্ধ। এই প্রয়োজনের তাগিদেই মার্কিন সামরিক শিল্প পুঁজি মালিকরাই যেভাবে আগে মার্কিন সরকারকে নানা যুদ্ধের শর্ত তৈরি করতে এবং যুদ্ধে জড়িত হতে বাধ্য করেছে, ঠিক সেভাবেই এখন তারা বারাক ওবামার ওপর নতুন যুদ্ধের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে। ইরাক ও সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদীরা এবং সেখানকার বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা যে যুদ্ধ চালাচ্ছে তার দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কোনোভাবেই বিপন্ন হয় না। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজেদের নিরাপত্তার কথা বলে ইরাক ও সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করেছেন। আসলে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সেখানকার জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নয়, তিনি এটা করতে বাধ্য হচ্ছেন মার্কিন সামরিক শিল্প পুঁজির মুনাফা এবং তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। এ পুঁজির আজ্ঞাবাহী বা খেদমতগারি হিসেবেই তিনি প্রেসিডেন্ট পদে সমাসীন আছেন এবং এদের চাপের মুখেই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধে নামানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইরাক ও সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করেছেন।
এই বিমান হামলা শুরুর সময় তিনি বলেছিলেন যে, তারা এই যুদ্ধের সম্প্রসারণ করে সেখানে কোনো স্থলযুদ্ধ করবেন না। কিন্তু ইতিমধ্যেই তিনি সামরিক প্রশিক্ষণের ছদ্মবেশে ইরাকে কয়েকশ’ মার্কিন সৈন্য পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন। শিগগিরই যে তারা সেখানে স্থলবাহিনী ব্যাপকভাবে নামাবেন এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই তাদের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বর সানডে টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন সিনিয়র কংগ্রেসম্যান পিটার কিং বলেছেন যে, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই সিরিয়ায় সৈন্য পাঠাতে হবে। সৈন্য না পাঠানোর ঘোষণা ওবামা পুনর্বিবেচনা করছেন’ (যুগান্তর ২২.৯.২০১৪)। কিন্তু শুধু সিরিয়ায় নয় ইরাকেও তাদের স্থল সৈন্য পাঠানোর প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে।
পত্রপত্রিকায় শুধু এসব যুদ্ধের খবর প্রকাশিত হয় এবং এই যুদ্ধগুলোর কারণ সম্পর্কে নানা কথা বলা হয়। এসব কথা হলেও কী মৌলিক কারণে এ যুদ্ধগুলো হচ্ছে এ নিয়ে কোনো আলোচনা সংবাদপত্র বা অন্যান্য পত্রপত্রিকায় দেখা যায় না। এর ফলে পুঁজিবাদী ধ্বংসাত্মক অর্থনীতি এবং জনগণের জীবনে তার থেকে উদ্ভূত বিপদ সম্পর্কে জনগণ কিছু জানতে পারে না। যুদ্ধের অনুকূল সংবাদের মাধ্যমে তা আড়ালেই রক্ষা হয়। কিন্তু বাস্তব ব্যাপার হলো, বিশ্বযুদ্ধ মেনে নিয়ে সব রকম যুদ্ধই পুঁজিবাদের মুনাফা এবং অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। এজন্য সাম্রাজ্যবাদীরা শুধু যে নিজেরাই সমরাস্ত্র কিনে সরাসরি তা ব্যবহার করে তাই নয়, দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের শর্ত তৈরি ও যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি এবং যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়াতেও তাদের হাত থাকে। এর ফলে এসব দেশে সমরাস্ত্রের প্রয়োজন হয় এবং সামরিক শিল্প পুঁজি তাদের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের সহায়তায় তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে। এই বাস্তবতার দিকে না তাকিয়ে শুধু সংবাদপত্রে পরিবেশিত যুদ্ধের কাহিনী পড়ে এসব যুদ্ধের আসল কারণ বোঝা সম্ভব নয়। যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পুঁজিবাদের ধ্বংস যে অপরিহার্য এটা বোঝাও কোনো মতেই সম্ভব নয়।
লেখক: সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল