সৌদি আরবের জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে মাননীয় রাষ্ট্রদূতের বাণী
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম
সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জগতের রব আল্লাহ তায়ালার জন্য আর সালাত ও সালাম মহাবিশ্বস্ত নবী ও তাঁর সমস্ত সাহাবা ও বংশধরদের ওপর।
সৌদি আরবের জাতীয় দিবস একটি মহান দিন যা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পালন করা হয়। এ বছরও এটা দেশটির একত্রকরণের ৮৪তম বছরের স্মরণে পালন করা হচ্ছে। আর এটা ১৩৫১ হিজরি মোতাবেক ১৯৩২ সালের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। যেহেতু রাজকীয় সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা (আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন) বাদশাহ আবদুল আযিয বিন আবদুর রহমান আল সাউদ দেশটিকে একীভূত করতে সম হন এবং আরব উপদ্বীপের জনগণকে রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্ধনে একত্র করেন, এ কথা স্মরণ করে আজ আমাদের অন্তরগুলো গর্ব ও সম্মানে ভরে যায়। যখন আমরা দেখি কালেমা তাওহিদ খচিত পতাকা সৌদি আরবের আকাশে পতপত করে উড়ছে, আর এটা আমাদেরকে এক নিকট ইতিহাসের গভীরে ডুব দিতে আহ্বান করে, যাতে আমরা ঘটনা বুঝতে পারি যে, এই পতাকার পেছনে কত ঝড়ঝঞ্ঝা পাড়ি দিতে হয়েছে। আর এই পতাকার উত্তোলনকারীরা আরব বাজপাখি বাদশাহ্ আবদুল আযিযÑ আল্লাহ তাঁর কবরকে আলোকিত করুন-এর নেতৃত্বে তারা উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাই আজকে আমরা সৌদি আরবের জাতীয় দিবস উদযাপনের গুরুত্ব অনুধাবন করি। এ দেশ বিচ্ছিন্নতা, উদভ্রান্ততা ও ধ্বংসের সব কিছুকে বিদায় দিয়েছে, যাতে করে এটা সব অগ্রগতি ও সভ্যতার দরজায় কড়া নাড়ে এবং মহা সম্মানের শীর্ষচূড়ায় উন্নীত হতে পারে।
বাদশাহ্ আবদুল আযিযÑ আল্লাহ তাঁর কবরকে আলোকিত করুন। উত্তম বরকতময় জিনিসের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। তাঁর পরে তাঁরই সুযোগ্য সন্তানেরা তা রা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন।
তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্ব, ধৈর্য ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে এই মহা কর্তব্যকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেন। সুতরাং কথার আগেই কাজ হয়েছে বিবৃতির আগেই উৎপাদন সম্পন্ন হয়েছে। কাজেই সৌদি আরব একটি আলোকবর্তিকার মতোই হয়ে গিয়েছে যা সভ্যতা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অগ্রগতি ও উন্নয়নের নেতৃত্বের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিণত হয়েছে।
তাই আমরা যখন আমাদের জাতীয় দিবস উদযাপন করি, তখন সমস্ত মূল্যবোধ, নীতিমালা, ত্যাগ ও অবিরাম প্রচেষ্টাগুলো উপস্থাপন করি, যেগুলো এ মহান অবয়ব গড়তে সহায়ক হয়েছে। এই পবিত্র ভূমির জন্য আমাদের অন্তরে যে ভালোবাসা ও মূল্যায়ন রয়েছে, আল্লাহর পরে যাদের অবদানে আমাদের এই বরকতময় ভূমিতে কল্যাণ ও শান্তি বিরাজ করছে তাদেরকে গভীরভাবে স্মরণ করি। এটা এই পবিত্র ভূখণ্ডের ওপর আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ দয়া যে, তিনি এর মর্যাদা ও বিশেষত্বসমূহের সাথে সঙ্গতি রেখে এর নেতাদেরকে বাছাই করেছেন। এর প্রতিষ্ঠাতার হাতে আল্লাহ তাঁকে রহম করুন এই ভূমি একত্র হওয়ার পরে এর কল্যাণ ও অগ্রগতির ধারা আর থেমে থাকেনি। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর সন্তানদের হাতে এবং বর্তমান বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আযিযের স্বর্ণযুগ পর্যন্ত অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই সমস্ত ব্যাপারে সৌদি আরব যে সভ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছে তা অন্যান্য রাষ্ট্র শত শত বছরেও করতে পারেনি।
যদি আমরা এই মহান অর্জন সম্পর্কে বলতে চাই, তাহলে কয়েক খণ্ডের গ্রন্থের প্রয়োজন হবে। এই দেশ নিরাপত্তা, শিা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যা অর্জন করেছে তা বর্ণনা করা দু:সাধ্য ব্যাপার, আর তা অগণিত, তাই সেগুলো আঞ্চলিক ক্ষেত্রে স্থিতি সমৃদ্ধি ও উন্নতির উপমায় পরিণত হয়েছে। এ উপলে যা বলতেই হবে; তা হলো যে, এটা সৌদি নাগরিকদের শিা, পুনর্বাসন ও যোগ্যতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিণের মাধ্যমে গড়ে তোলার প্রতি বৃহত্তর গুরুত্ব প্রদান করেছে।
প্রাথমিক শিা দেশের সব প্রান্তরে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষায়িত শিাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। বিদেশে সৌদি ছাত্রদের শিার সুযোগ প্রদান করা হয়েছে, যা আল্লাহর ইচ্ছায় ইতোমধ্যেই ব্যাপক ফলপ্রসূ হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
এ মহান উপলে আমাদের সবাইকে যে বিষয়টি উল্লেখ করতেই হয় তা হলো, সৌদি আরব আরব ও মুসলিম জাহানের জন্য যে বিশাল খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছে এটা এ দেশের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এ দেশ ওহি অবতীর্ণ হওয়ার স্থল, রিসালাতের সূচনা স্থল এবং মুসলমানদের কিবলা।
তাই এ দেশ শুরু থেকেই ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বিশ্বের আনাচে কানাচে মসজিদ ও নামাজের ঘর তৈরি করেছে । আর তা মূলত শুরু হয়েছে পবিত্র দুই মসজিদের মাধ্যমেই। এই দুই মসজিদের সর্বযুগের বৃহত্তম সম্প্রসারণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাই বর্তমানে হজ খুবই স্বাচ্ছন্দ্যময় ও সহজ হয়েছে, যা আগে ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। এই পবিত্র দুই মসজিদের বিশাল ইমারত প্রত্যেক মুসলমানের গর্বের স্থানে পরিণত হয়েছে। তেমনিভাবে আল্লাহর ঘরের হাজী ও মসজিদে নববী জিয়ারতকারীরা সব সুবিধা ভোগ করছেন। আর তাদের খেদমতের কাজকে এই রাষ্ট্র বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছে এবং সব কিছু উজাড় করে দিয়েছে, যা দূরের কাছের সবাই অবলোকন করছে।
অতঃপর আল্লাহর কিতাবের মুদ্রণ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত লাখ লাখ কপি ছাপানোর কাজ করছে যাতে করে যে যেই ভাষাভাষী বা যেখানেই অবস্থানকারী হোক না কেন প্রত্যেক মুসলমান যেন তা অনায়াসে পেতে পারে। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে এ নেতৃত্বমূলক ভূমিকার ধারাবাহিকতায় ও মুসলমানদের ব্যাপারে এর গুরুত্ব প্রদানের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুসলিম উম্মাহর ব্যাপারগুলো সহযোগিতা পেয়ে আসছে ও আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত— গ্রহণের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছে।
এমনকি এটা আরবীয় ও ইসলামি কণ্ঠস্বরের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিভিন্ন সংস্থা, ফোরাম ও সংগঠনের সাথে সংলাপের ক্ষেত্রে, আর তা আল্লাহ তায়ালা একে যে অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থান দিয়েছেন তার সাহায্যে। আর এই সহযোগিতা বিশেষ করে মুসলিম ও অমুসলিম দেশে দুর্গতদের সহযোগিতায় দ্রুত এগিয়ে আসার মাধ্যমে যেন সৌদি আরব সর্বদা প্রতিটি অভাবী ও দুস্থ মানবতার সেবায় অগ্রগামী ও মানবতার রাষ্ট্র হতে পারে।
সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতার যুগ থেকেই এর বৈদেশিক নীতি পবিত্র ইসলামি নীতিমালা ও প্রাচীন আরবীয় বিধিবিধানের ওপর শক্ত ও মজবুত ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত এবং এর অনন্য বৈদেশিক নীতির কার্যক্রম হচ্ছে, আরবীয় ইসলামি ঐক্যে সহায়তা প্রদান ও আরবীয় ইসলামি ব্যাপারাদি হেফাজতকরণে কাজ করা ও অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তপে না করা।
আরবি ইসলামীয় আন্তর্জাতিক েেত্র বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের মাধ্যমে সৌদি আরব বর্তমান বাদশাহর আমলে ইসলামি ব্যাপারে সহায়তা প্রদান ও ইসলাম সংরণে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছে এবং এর উন্নত বার্তা এবং ন্যায় ও শান্তির স্বপে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদিতা প্রতিরোধ এবং বিভিন্ন ধর্ম ও সাংস্কৃতিক অনুসারীদের মাঝে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নেতৃত্ব এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করছে।
সৌদি জাতির জন্য সমসুযোগ-সুবিধা ও ব্যাপক সম্মানজনক ভাবে জীবনযাপনের সুবিধা করে দেয়া হয়েছে। আর এসব কার্য ও পদপে তাঁর আল্লাহ তাঁকে সুরা দান করুন-সমুন্নত চরিত্র ও অনন্য গুণাবলি ও বিশ্বমানের নেতা হিসেবে তাঁর অবস্থানের পরিচায়ক। তেমনিভাবে এটা একটি নেতৃত্বদানকারী দেশ হিসেবে সৌদি আরবের অবস্থান নির্ণয়ে অবদান রেখেছে, যা বিশ্ব অর্থনীতির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী গ্র“প ২০-এ এর প্রবেশকে সুগম করেছে।
সৌদি আরব সাহসিকতা, দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্পষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে সন্ত্রাস দমন করছে, যা দায়িত্বশীল লোকদের দৃঢ়তা ও জাতীয় নেতৃত্বের সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে অপূর্ব সফলতা অর্জন করেছে, যা সবাই প্রশংসা করেছে আর এটা বিশ্ববাসীর সামনে একটি উপমা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে আমি খাদেমুল হারামাইন আল শরিফাইন বাদশাহ আবদুল্লাহর মহানুভব পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৫ সালে রিয়াদে অনুষ্ঠিত সন্ত্রাস মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কথা উল্লেখ করতে চাই, যা বাহ্যত অপরাধ প্রতিরোধে সঠিক নেতৃত্বের গুরুত্বারোপ করে।
সৌদি আরব বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় আয়ের ০.৭% হারে সাহায্য প্রদান করে। আর এটা জাতিসঙ্ঘভুক্ত দাতা দেশগুলো যা দান করে তার সমপরিমাণ। সৌদি আরব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তার জাতীয় আয়ের ৫.৪৫% প্রদান করে। আর এই পরিমাণটা শিল্পোন্নত বড় বড় দেশের বৈদেশিক সহায়তার চেয়েও বেশি।
সৌদি উন্নয়ন তহবিল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সৌদি উন্নয়নমূলক সহায়তা প্রদান প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। আরব ও ইসলামি রাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে তিগ্রস্তদের সহায়তা দানে যেসব দেশ এগিয়ে আসে তাদের মধ্যে সৌদি আরব অগ্রগামী। আর এটা খাদেমুল হারামাইন আল শরিফাইন কর্তৃক প্রদত্ত সংস্থা ও জাতীয় কমিটির মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।
সৌদি-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিষয়ে যা বলতে হয়, তা হলো এই সম্পর্কটি দৃঢ় ও চমৎকার। সৌদি আরব স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সব দল, নেতা ও সরকারের সাথে সম্পর্ক রেখেছে। সৌদি আরবের প্রতিটি সেক্টরে বর্তমানে ২৫ লাখের অধিক বাংলাদেশী কাজ করছে। তারা উন্নয়ন ও দেশ গঠনের অংশীদার। এখনো সৌদি আরব অনেক শ্রমিক আমদানি করছে। ইতোমধ্যেই সৌদি বাদশাহ অবৈধ বাংলাদেশী শ্রমিকদের বৈধ্য করার রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করেছে এবং কফিল পরিবর্তনের সুযোগ প্রদান করেছেন। এ বছরই সৌদি-বাংলাদেশ যৌথ কমিটির বৈঠক শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে যা দু’দেশের সব ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
সৌদি জনগণ ও এর নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশী জনগণকে সত্যিকারভাবে মূল্যায়ন করেন। আল্লাহর কাছে কামনা করি তিনি যেন বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে সর্বদা নিরাপদে রাখেন এবং আরো বেশি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি প্রদান করেন।
পরিশেষে, আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি আল্লাহ যেন এ দেশের সম্মান, নেতৃত্বের মর্যাদা ও জনগণের উন্নতি সর্বদা দান করেন। আর আমাদের সবাইকে নাগরিক হিসেবে পরিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করার তওফিক দেন, যাতে করে আল্লাহর রহমতে আমাদের দেশ সম্মানের শীর্ষ স্থানে পৌঁছাতে পারে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের বাদশাহ জাতির কাণ্ডারি আবদুল্লাহ বিন আবদুল আযিয ও যুবরাজ আমির সালমান বিন আবদুল আযিযকে হেফাজত করেন এবং তাঁদেরকে সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দান করেন। ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পদ হিসেবে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন।
ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।
ড. আবদুল্লাহ বিন নাসের আল-বুশাইরি
বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত
৩১. ০৮. ২০১৪