মুসলিম উম্মাহর সেবায় সউদি আরব

Makkah“মুসলিম ও আরব দেশের ভাইদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে আমরা সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব এবং মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করব।”
সাবেক খাদিমুল হারামাইন বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আযীযের উপরোল্লিখিত বক্তব্যে ইসলাম এবং সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য সউদী আরবের ত্যাগের স্বরূপ প্রতিবিম্বিত হয়েছে। সউদী আরব বিভিন্নভাবে মুসলিম উম্মাহর সেবায় নিয়োজিত। আর্থিক সাহায্য হিসাবে রাজকীয় সউদী আরব শত শত কোটি ডলার সারা বিশ্বে খরচ করেছে। প্রতি বছর পবিত্র মক্কা নগরীতে মুসলমানদের নির্বিঘেœ ও নিরাপত্তা সহকারে হজ্জ, উমরাহ ও জিয়ারত সম্পাদনের নিমিত্তে ব্যাপকভাবে বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং রাস্তাঘাটসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে। বিপুল অর্থ ব্যয়ে মক্কায় পবিত্র মসজিদুল হারাম এবং মদীনায় মসজিদে নববীর বিস্তৃৃতি সাধন করা হয়েছে। তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য উল্লেখিত বৃহৎ প্রকল্প ছাড়াও সউদী আরবের অসংখ্য মানবসেবামূলক প্রকল্পসমূহের মধ্যে রয়েছে- অমুসলিম দেশে অবস্থিত সংখ্যালঘু মুসলমানদের নানাবিধ সেবাপ্রদান করা। পরিচিত মুসলিম বিশ্বের বাইরেও কোটি কোটি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে নিজ নিজ দেশে সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করছে এবং ক্রমে তাদের সংখ্যা আরও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসলামের সূতিকাগার হিসেবে সউদী আরব শুধু মুসলিম বিশ্বের প্রতি নয়, বরং এর বাইরে অবস্থিত মুসলামনদের প্রতিও বিশেষ দায়িত্ব অনুভব করছে। এ দায়িত্ব পালনার্থে গত কয়েক দশক ধরে সউদী আরব অমুসলিম সমাজে ক্রমবর্ধমান মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় প্রয়োজন মেটাতে এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে তাদের সম্পর্ক জোরদার করতে অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব প্রকল্পের পুরোভাগে রয়েছে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্রসমূহ নির্মাণ করা। এ ধরনের প্রকল্প বহু পূর্ব থেকে শুরু হলেও আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসব প্রকল্প ব্যাপকতা লাভ করে। যার ফলে বিশ্বজুড়ে ১৫০০ মসজিদ ও ২১০টি ইসলামী কেন্দ্র সউদী সরকারের খরচে নির্মিত হয়েছে। এ কেন্দ্রগুলো বহুমুখী ভবনরূপে নির্মিত হয়েছে, যা শুধু ধর্মীয় চাহিদাই নয়, বরং মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য চাহিদাও মেটাতে সক্ষম হয়েছে। উক্ত ইসলামী কেন্দ্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নিউইয়র্ক, লসএঞ্জেলস, সানফ্রান্সিসকো, শিকাগো, মাদ্রিদ, লন্ডন, রোম, প্যারিস, বন, ব্রাসেলস, জেনেভা, টোকিও, টরেন্টো, ভিয়েনা, লিসবন, বুয়েন্স আয়ারস, এডিনবরায় এবং রিওডি জেরিনোতে। এর পাশাপাশি তুলনামূলক ক্ষুদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাসমূহে প্রয়োজন মাফিক ছোট আকারের মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্রসমূহ নির্মাণ করা হয়েছে। যেগুলো সাধারণত এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত। মুসলিম ও আরব বিশ্বের মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বব্যাপী ইসলামী দাওয়াত প্রচারের লক্ষ্যে সউদী আরব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের কয়েকটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। সেগুলো হলো- (১) ইসলামী সহযোগিতা (সম্মেলন) সংস্থা (ওআইসি) (২) রাবেতা আল আলম আল ইসলামী (৩) বাদশাহ ফয়সাল ফাউন্ডেশন। সউদী আরব মুসলিম বিশ্বের ইসলামী ভাবধারা সমৃদ্ধকরণ ও ইসলাম, আরবী ও ইসলামী খেদমতকে ত্বরান্বিত করার জন্য বাদশাহ ফয়সাল ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে কিং ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘোষণা করেন ১৯৭৯ সাল থেকে এবং এ পর্যন্ত এ পুরস্কার অব্যাহত রয়েছে। এ পুরস্কার ইসলামের খেদমত, ইসলামী শিক্ষা, আরবী সাহিত্য, চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের উপর দেয়া হচ্ছে। যা মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে প্রাপ্ত হচ্ছে। (৪) ওয়ার্ল্ড এসেম্বলি অব মুসলিম ইউথ (ওয়ামি) (৫) আন্তর্জাতিক ইসলামী ত্রাণ সংস্থা (আইআইআরও) (৬) বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স। ইহা বাদশাহ ফাহাদের নিজস্ব উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে মদীনা মুনাওয়ারার তাঁবুক রোডের পাশে ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার জমির উপর নির্মিত হয়। এ কমপ্লেক্স শুরু থেকে অদ্যাবধি প্রায় ১৫ কোটিরও অধিক মুসহাফে মদীনা কপিরও অধিক পবিত্র কুরআন এবং লাখ লাখ কপি অডিও ক্যাসেট এবং বাংলাসহ পৃথিবীর প্রধান প্রধান ৫৭টি ভাষায় ইতোমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। (৭) বসনিয়া-হারজেগোভিনার মুসলমানদের জন্য সাহায্য সংগ্রহের উচ্চ কমিটি। উক্ত সংস্থাসমূহের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে-
১. বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট নানাবিধ দুর্যোগে আক্রান্তদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আর্থিক সাহায্যদান ও পুনর্বাসন ২. কৃষি সম্প্রসারণ ৩. বাঁধ নির্মাণে কারিগরি সহায়তাদান ৪. কূপ খনন ৫. বিচ্ছিন্ন স্থানসমূহের সাথে যোগাযোগ স্থাপন ৬. কিনিক স্থাপন ও ৭. স্বাস্থ্যসেবা দান ইত্যাদি মানবিক সেবাসমূহ প্রদান করা এ সংস্থাসমূহের মূল দায়িত্ব।
নির্যাতিত মুসলিম জনতার পাশে সউদী আরব : সউদী আরব শুধু বিশ্বব্যাপী মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র নির্মাণ করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। বরং যেখানেই মুসলমানরা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছে সেখানেই তাদের পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়েছে। যেমন- (১) সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সউদী আরব এবং এর ইসলামী সংস্থাসমূহ মধ্য এশিয়ার নব সৃষ্ট মুসলিম প্রজাতন্ত্রসমূহকে সাহায্যের ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। রাশিয়ার কমিউনিজমের শাসনামলে বৃহত্তর রাশিয়ার কোটি কোটি মুসলমান নির্যাতিত হয়েছিল এবং তাদের মুসলিম বিশ্ব থেকে সাত দশক বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল। এ সময় মুসলমানগণ কোনক্রমে আত্মরক্ষা করলেও অধিকাংশ মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এবং পবিত্র কুরআন শরীফের প্রকট অভাব দেখা দিয়েছিল। সউদী আরব অতি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে ৬টি মুসলিম প্রজাতন্ত্রের রাজধানীতে বিশাল বিশাল ইসলামী কেন্দ্র স্থপন করেছে এবং প্রজাতন্ত্রসমূহের ছোট শহরগুলোতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছে। একইসাথে স্থানীয় ভাষায় অনূদিত এবং মদীনার বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্সে মুদ্রিত লাখ লাখ কপি পবিত্র কুরআনুল কারীম বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বিমানযোগে ওইসব দেশের মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্রসমূহে প্রেরণ করা হয়েছে।
(২) সউদী আরবের জাতীয় কর্মসূচির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মুসলিম বিশ্বের বাইরে অবস্থিত বিভিন্ন মুসলিম জনগোষ্ঠীর শিশু ও যুবকদের জন্য ইসলামী ও আরবী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত মাসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্রসমূহকে বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর পাশাপাশি সউদী আরব উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে বিভিন্ন ইসলামী একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব একাডেমি পরিপূর্ণ স্কুল হিসেবে আরবী ও ইসলামী শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দিয়ে স্থানীয় ভাষায় অন্যান্য সিলেবাস ও পাঠদান করে থাকে। এ ছাড়া সউদী আরব সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ছাত্রদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করে বিভিন্ন সউদী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বর্তমানে হাজার হাজার ছাত্র এ ধরনের বৃত্তির সুযোগ নিয়ে মক্কা ও মদীনার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে।
(৩) ইসলামের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে এবং ইসলামের সঠিক জ্ঞান প্রচারার্থে সউদী আরব নিজস্ব অর্থায়নে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী শিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ল’ স্কুল এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ও মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী বিভাগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রসমূহের মাধ্যমে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত মুসলমানদের বিবিধ প্রয়োজন মেটানো এবং মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের মধ্যে উত্তম সমঝোতার আবহ সৃষ্টি করাই সউদী আরবের মূল লক্ষ্য।
(৪) বসনিয়া-হার্জেগোভিনার মুসলমানরা যখন সার্ব বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার শিকার হয় তখন সেখানকার মুসলমানদের সউদী সরকার সউদী আরবে এনে রক্ষা করে এবং তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেয়।
(৫) ২০১২ সালে মিয়ানমারের মুসলমানরা গণহত্যার শিকার হলে সউদী আরব ওআইসির চতুর্থ বিশেষ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে ও তাদের জন্য ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদানের ঘোষণা করে। সউদী আরবে অবস্থিত ৫০ হাজার আরাকানীদের নাগরিকত্ব প্রদান করে। বর্তমানে আরও ৫ লাখ আরাকানী মুসলমান সউদী গমনের ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
ড. আব্দুল আযীয হুসাইন আসসুওয়াইগ তার রচিত ‘সউদী আরব ও মুসলিম বিশ্বের উন্নয়ন’ পুস্তিকায় উল্লেখ করেছের যে, বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মার সেবায় সউদী আরব যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা মূলত চার প্রকার। ১. রাজনৈতিক কারণে ২. সাংস্কৃতিক কারণে ৩. অর্থনৈতিক কারণে ও ৪. মানবিক কারণে। এসব বিষয় বিবেচনায় দেখা যায় যে, সউদী আরব মুসলিম বিশ্বের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করছে।
পরিশেষে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সউদী আরব বিশ্বের মুসলমান ও নিপীড়িত জনগণের জন্য যে প্রভূত সহযোগিতার হাত বৃদ্ধি করেছে তা এক নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি হয়েছে। ত্রিশের দশকে সমৃদ্ধির পথে হাঁটি হাঁটি করে পা চলা দেশটি অল্প সময়ের মাঝেই তার বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে খানিকটা এগিয়ে দিয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সউদী আরব বিশ্বের মুসলমানদের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার যে রোডম্যাপ সৃষ্টি করেছে তা অমুসলিম উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের রোলমডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button