বাংলাদেশ থেকে টুপি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে
মিজানুর রহমান মিন্টু, কুড়িগ্রাম থেকে: পাশাপাশি ১০টি গ্রাম। এসব গ্রামের গৃহবধূ, কলেজ-স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী- এমনকি অশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত, বেকার কিশোরী-তরুণীরা এখন দারুণ ব্যস্ত টুপি তৈরির কাজে। তৈরি করা টুপি রপ্তানি হয় ওমান, কুয়েত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। বছরে গড়ে ৬০ হাজার টুপি তৈরি হয় এখানে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিটি টুপির মূল্য গড়ে ১ হাজার টাকা। সেই হিসেবে বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকার টুপি তৈরি হয় এসব গ্রামে। সারা বছরই এই টুপি তৈরির কাজ চললেও এখন ঈদকে ঘিরে টুপি তৈরিতে ব্যস্ত নারীদের হাত। এভাবেই অনেকেই ভাগ্য বদল করেছেন মঙ্গাপীড়িত এ জনপদে। আর এ স্বাবলম্বিতার গল্পটির স্রষ্টা মোর্শেদা পারভীন নামের এক সংগ্রামী নারী। টাওয়াল ফ্যাক্টরির ডিজাইনার হিসেবে টাঙ্গাইলে থাকার সময় হাতে-কলমে টুপি তৈরির কাজ শেখেন। এরপর ১৩ বছর আগে নিজ গ্রামে ফিরে প্রশিক্ষণ দিয়ে টুপি তৈরির কলাকৌশল ছড়িয়ে দেন সবার মাঝে। উলিপুর উপজেলার পাতিলাপুর ও সংলগ্ন আরও ৯টি গ্রামের প্রায় ৬ হাজার নারী এখন টুপি তৈরির কাজে নিয়োজিত। উলিপুর উপজেলার সদর থেকে ৫ কি.মি. দূরে অবস্থিত মোর্শেদার পাতিলাপুর গ্রাম। এ গ্রামে কারও হাতে সাদা আর কারও হাতে রং-বেরঙের কাপড়। সুইয়ের ফোঁড়ে ফুটে উঠছে নান্দনিকতা। বিশেষ কায়দায় সেলাই করা কাপড় বা রেশমার উপর নক্শা তৈরি করে টুপি তৈরির করছে এলাকার বিভিন্ন বয়সী নারীরা। এ গ্রামের মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নেয়া অদম্য নারী মোর্শেদা বেগম। পড়াশুনা দশম শ্রেণীর পর্যন্ত। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে টাঙ্গাইলের একটি টাওয়াল ফ্যাক্টরিতে কাজ করার জন্য চলে যায় ১৯৯৫ সালে। সে সময় প্রতিবেশী কমলা বেগমের টুপি তৈরির কাজ দেখে দেখে রপ্ত করেন কলাকৌশল। প্রথম টুপি তৈরির করে মজুরি পান ৩৫০ টাকা। ১৩ বছর আগে ফিরে আসেন গ্রামে। মোর্শেদা জানান, সে সময় তার কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে বেসরকারি সংস্থার একজন কর্মকর্তা তাকে ৫০টি টুপি তৈরির অর্ডার দেন। এতে লাভ হয় ১৭ হাজার টাকা। এরপর মোর্শেদার মনে স্বপ্ন উঁকি দেয় দিনবদলের। তিনি গ্রামে ফিরে আসেন ২০০০ সালে। মঙ্গাপীড়িত এ এলাকার বেকার নারীদের আয়ের ব্যবস্থা করে দরিদ্রতা দূরীকরণের সংগ্রামে নেমে পড়েন তিনি। শুরু করেন নিজ বাড়িতে প্রশিক্ষণ। তার সাফল্যের খবর এলাকায় চাউর হয়ে যায়। ফলে দলে দলে নারীরা আসতে থাকে তার বাড়িতে। বর্তমানে নাগরাকুড়া, থেতরাই, কুকুয়াপাড়া, চরুয়াপাড়া, দলদলিয়া, থেতরাই, পান্ডুল, গুনাইগাছ, বাঙালি গ্রামসহ পৌর এলাকার কয়েকটি পাড়ায় চলছে টুপি তৈরির কাজ। মোর্শেদা জানান, ফেনীর দু’জন ব্যবসায়ীর কাছে তিনি তৈরি করা টুপি বিক্রি করেন। আর এ টুপি মধ্যপ্রাচ্যে বিক্রি হয়। ওই ব্যবসায়ীরা তার কাছে রেশমা সরবরাহ করেন। এরপর তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের সঙ্গে নিয়ে সুই সুতা দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের নক্শাখচিত টুপি। প্রতিটি টুপি তৈরির জন্য পারিশ্রমিক পান ৩০০-৩৫০ টাকা। এতে সুই সুতার খরচ ৩০-৪০ টাকা। প্রতি টুপিতে তিনি কমিশন পান ৩০-৪০ টাকা। প্রতি গ্রামে সুপারভাইজার নিয়োগ করে কাজের তদারকির পাশাপাশি ঝড়-বৃষ্টি উপক্ষো করে পায়ে হেঁটে ও রিকশায় চড়ে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে তিনি টুপির তৈরির কাজ দেখভাল করেন। এভাবে মাসে গড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টুপি সরবারহ করেন। তবে ধান কাটার মওসুমে গ্রামের নারীরা ব্যস্ত থাকে বলে উৎপাদন কমে যায়। হাতে অন্য কাজ না থাকলে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে টুপি তৈরির কাজে। মিয়াপাড়ার সীমা (২২), হোকডাঙার রোকসানা (১৯), খাদিজা (২০) জানান, তারা মোর্শেদা বেগমের কাছে ট্রেনিং নিয়ে তিন বছর ধরে টুপি তৈরির কাজ করছেন। বেকার এই যুবতী, কিশোরী ও গৃহবধূরা আয় করেন ৭০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা। থেতরাই হাইস্কুলের ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী শাপলা বলেন, ‘স্কুল থেকে এসে কিছুক্ষণ এ কাজ করি। নিজের উপার্জন দিয়ে খাতা, কলম ও ভাল পোশাক কিনি। গরিব বাবার কোন বোঝা হয় না তাতে’। দরিদ্র মোর্শেদা টুপি তৈরি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ৪ রুম বিশিষ্ট আধাপাকা বাড়ি করেছেন। জমি কিনেছেন ২ লাখ টাকার। দু’মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। এখন মোর্শেদার স্বপ্ন এলাকার দরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী করা। এজন্য ১০-১২ লাখ টাকা পুঁিজ পেলে টুপি তৈরির প্রধান উপাদান রেশমা তৈরির কারখানা দেবেন। আর এটা সম্ভব হলে এ এলাকার ১৫-২০ হাজার নারীর কাজের ব্যবস্থা তিনি করতে পারবেন। কুড়িগ্রাম বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প)-এর কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান জানান, জেলায় টুপি শিল্প বিকাশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। শিল্প উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে এ শিল্পের বিকাশ দ্রুত ঘটবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া সম্ভব।