সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ আছে দুই দলেই
সোহরাব হাসান: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। এটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি খবর বটে। যেসব দেশে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার মধ্যে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা হয়, সেসব দেশে এটি খবর নয়। বরং সেসব দেশে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ না হলেই সেটি খবর হয়। গত সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শেখ হাসিনার শুভেচ্ছা কার্ড নিয়ে সংসদ ভবনে যান প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল কর্মকর্তা শেখ আখতার হোসেন। অন্যদিকে বেলা দেড়টায় বিরোধীদলীয় নেতার সহকারী একান্ত সচিব সুরাতুজ্জামান প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আসেন তাঁর কার্ড পৌঁছে দিতে। ডেইলি স্টার মঙ্গলবার শিরোনাম করেছে, ‘কার্ডস, নট টকস’। অর্থাৎ কার্ড বিনিময়, কথা নয়। আমরা আশা করব, শুভেচ্ছার ডালি ভরা এই ঈদকার্ড ঈদের পর যেন হিংসা ও ঘৃণার বিস্ফোরণে পরিণত না হয়। দেশবাসীর আশঙ্কা, দুই দল নির্বাচন নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারলে ঈদের পরে মহাপ্রলয় ঘটবে।
আমরা হলফ করে বলতে পারি, ওই সব গণতান্ত্রিক দেশে এমনটি হলে জনগণ তাঁদের প্রত্যাখ্যান করত। বাতিল করে দিত। কিন্তু আমাদের দেশে নেতা-নেত্রীরা কখনোই বাতিল হন না, বাতিল হয়ে যায় সাধারণ মানুষ। জনগণ নিরুপায় বলেই তারা একসময় যাঁকে ধিক্কার জানায়, পাঁচ বছরের ব্যবধানে তাঁকেই ভোট দিয়ে জিতিয়ে আনে। এ ক্ষেত্রে নেতা-নেত্রীদের কোনো কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব আছে জনগণের। তাঁরা পাঁচ বছরের ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটান ভোটের মাধ্যমে। ২০০৯ সালে বিএনপির নেতাদের মলিন চেহারার সঙ্গে আজকের উৎফুল্ল ও উজ্জীবিত চেহারা মিলিয়ে দেখুন। একইভাবে ২০০৯ সালে বিজয়ী আওয়ামী লীগের নেতাদের চেহারার সঙ্গে আজকের নেতাদের বিধ্বস্ত ও উদ্বিগ্ন চেহারা মিলিয়ে দেখুন। আজ বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব কথায় কথায় সরকারি দলকে ধমক দেন, এই ধমকের রাস্তাটা ক্ষমতাসীনেরাই প্রশস্ত করেছেন তাঁকে একাধিকবার জেলে পাঠিয়ে। বাংলাদেশে যাঁরা জেলে যান, তাঁরাই বড় নেতা ও মন্ত্রী হন।
দুই
প্রধানমন্ত্রী কথায় কথায় অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ টানেন। কিন্তু তিনি কি একবার ভেবে দেখবেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে কীভাবে আচরণ করেন। আবার বিরোধী দলের নেতা যে নতুন ধারার সরকার গঠনের আগাম ওয়াদা দিয়েছেন, প্রশ্ন হলো, সেই নতুন ধারার সরকারে বিরোধী দলের নেতার অবস্থান কী হবে, সেই বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। তিনি ক্ষমতায় গিয়ে যে ২০০১-২০০৬ সালের শাসনের পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন না, তার নিশ্চয়তা কী? শেখ হাসিনা দিনবদলের অঙ্গীকার নিয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। দিন যে বদল হয়নি তার প্রমাণ ঢাকা মহানগরে বিলবোর্ড-অভ্যুত্থান।
কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। জীবনের সব ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকীকরণের প্রতিবাদে এই কবিতা লেখা এবং সম্ভবত কলকাতা শহরকে মনে রেখে তিনি তা লিখেছিলেন। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর পুরোটাই ঢেকে গেছে মহাজোট সরকারের উন্নয়নে। চীনা বিপ্লবের নেতা মাও সে-তুং বলতেন, গ্রাম থেকে শহর দখল করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে শহুরে মানুষগুলোই গ্রাম, নদীনালা, হাওর-বাঁওর সব দখল করে নিচ্ছে। এমনকি সারা দেশের নির্বাচনী আসনগুলোও এখন ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দাদের দখলে। তিন শ আসনে তাঁরা তিন শ জমিদারি কায়েম করেছেন। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তাদের জমিদারি স্থায়ী হয়। এই জমিদারি দখলের লড়াইয়ে দুই দলই মরিয়া। দলের নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে হলেও এই জমিদারি রক্ষা করতে হবে। একদল জমিদারি ফিরে পাওয়ার জন্য এবং অন্য দল জমিদারি পুনরুদ্ধারের জন্য জনগণের কাছে আশার বাণী তুলে ধরবে। কিন্তু নির্বাচনটি হয়ে যাওয়ার পর সেই জনগণের আর খোঁজখবর নেওয়ার দরকার হয় না। শুনেছি জাতীয় পার্টির একজন নারী সাংসদ গত সাড়ে চার বছরেও নাকি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় যাননি। বিএনপির একাধিক নেতাও দু-একবারের বেশি নির্বাচনী এলাকায় যাননি বলে খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু তাতে তাঁদের জমিদারি খোয়া যায়নি।
কিছুদিন ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা আক্ষেপ করে আসছিলেন যে গত সাড়ে চার বছরে তাঁরা এত উন্নয়ন করেছেন; কিন্তু মানুষ সেই উন্নয়নের খবর জানতে পারেনি। তাদের জানানো হয়নি। কেউ কেউ আরও এক ধাপ বাড়িয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রচার সেল খুবই দুর্বল। তারা বিএনপির মিথ্যাচারের জবাব দিতে পারেনি বলেই পাঁচ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। আসলে আওয়ামী লীগের নেতারা রোগ না ধরতে পেরে এর উপসর্গ নিয়ে এখন টানাটানি করছেন। দুর্বল প্রচার সেল হঠাৎ করে সক্রিয়তা দেখাতে গিয়ে যে কাণ্ড করেছে, তাকে বদহজম বলাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দলের মহাবিজ্ঞ নেতারা বুঝতে পারছেন না যে প্রেম লুকিয়ে করা গেলেও উন্নয়ন লুকানো যায় না। সরকার দেশ ও জনগণের জন্য উন্নয়ন করলে তা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করারও প্রয়োজন নেই। জনগণ তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনেই সেটি উপলব্ধি করবে, অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে মিলিয়ে দেখবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কথামতো দিনে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং দিয়ে জনগণকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এ বছর যে ঈদের সময় অন্তত ঢাকায় বিদ্যুতের তেমন সমস্যা হয়নি; এ কথা ঢাকার মানুষ কি অস্বীকার করেছেন? কিংবা জিনিসপত্রের দামও মোটামুটি নাগালের মধ্যে রাখা গেছে, পথে পথে পুলিশের চাঁদাবাজি, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তানি না থাকলে পণ্যের দাম আরও সহনীয় হতো। পুলিশের চাঁদাবাজির জন্য আমরা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো মন্তব্য পাইনি; তবে কোনো পুলিশ কর্মকর্তাও দায় নিয়ে পদত্যাগ করেননি, কিন্তু এফবিসিসিআইয়ের একজন সহসভাপতি পদত্যাগ করেছেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। বাংলাদেশে কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে চান না। ক্ষমতার সাড়ে চার বছরের মাথায় এসে যদি আওয়ামী লীগকে উন্নয়নের কথা জানাতে রাতের অন্ধকারে অন্যদের বিলবোর্ড ছিনতাই করতে হয়, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কী থাকতে পারে!
তিন
কুড়িল ফ্লাইওভার উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতাশার সুরে বেশ কিছু কথা বলেছেন। তিনি বরাবরের মতো উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নৌকায় ভোট চেয়েছেন। বলেছেন, জনগণই ভোটের মালিক। তাঁরা যাঁকে ভোট দেবেন তাঁরাই জয়ী হবেন। তাঁরা যদি সৎ ও ভালো লোককে বাদ দিয়ে সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজদের ভোট দেন, তাহলে কিছু করার নেই। তবে তিনি পবিত্র আমানত ভোট খেয়ানত না করার জন্য জনগণের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই আবেদন আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ মনে হলেও বাংলাদেশের রাজনীতির কলুষতাই প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, সৎ না অসৎ, জনসেবক না জনবিরোধী, উন্নয়নকামী না উন্নয়নবিধ্বংসী, ভালো না সন্ত্রাসীকে নির্বাচিত করবে, সেটি জনগণের ওপর ছেড়ে দিলাম। প্রধানমন্ত্রী যেদিন এই বক্তব্য দেন, তার ছয় দিন আগেই গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে ফিল্মি কায়দায় যুবলীগের এক নেতাকে হত্যা করেন যুবলীগের আরেক নেতা। হত্যাকারী র্যাবের হাতে ধরা পড়ে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হলেও এ ঘটনার নেপথ্যে যাঁরা আছেন, তাঁরা এখনো ধরা পড়েননি। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী যুবলীগের নেতা রিয়াজুল হক মিল্কির হত্যাকারী জাহেদ সিদ্দিকী তারেক একজন পেশাদার খুনি। এর আগে ১০-১২টি খুন করেছেন। আবার মিল্কিও নাকি তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের দায় সংগঠন হিসেবে যুবলীগ এবং সেই যুবলীগের অভিভাবক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী এড়াবেন কীভাবে?
তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী ছাত্রদল, যুবদল, বিএনপি ও জামায়াতের খুনি-সন্ত্রাসীরা দৌরাত্ম্য দেখাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে অপরাধ সংঘটন করছে এবং তারা আগামী নির্বাচনে প্রার্থীও হবে। না হলে তিনি জনগণকে সতর্ক করে দেবেন কেন? কথা হলো আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের শেষে এসে কেন প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের চোর ডাকাত খুনি সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করে দিচ্ছেন? কেন এত দিনেও তাদের পাকড়াও করে জেলে দেওয়া হলো না? জেলখানাগুলো তাহলে কাদের দ্বারা ভর্তি করা হয়েছে?
আর খুনি সন্ত্রাসীরা যে কেবল বিরোধী দলে নেই, প্রধানমন্ত্রীর নিজের বা সহযোগী দলেও আছে, তার প্রমাণ যুবলীগের মিল্কি হত্যা। চট্টগ্রামে টেন্ডারবাজিতে এক শিশুসহ দুজনের মৃত্যু। তার প্রমাণ প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হানাহানি, মারামারি।
যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী র্যাবের ক্রসফায়ারের তদন্ত দাবি করেছেন, এত বড় কেলেঙ্কারির পরও সংগঠনের কোনো ক্ষতি হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন; কিন্তু দুজনকে বহিষ্কার করা ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংগঠনটি। যুবলীগ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে বদনাম কুড়িয়েছে, তাতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের বোঝা কেবল ছাত্রলীগ নয়, যুবলীগও।
প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে জনগণকে সজাগ থাকতে বলেছেন, তাদের ভোট না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। খুবই ভালো পরামর্শ। কিন্তু তিনি নিজের দলের (যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ) সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে কিছুই বলেননি। দেশবাসী তাঁর কাছ থেকে এই প্রশ্নের সদুত্তরই আশা করে।
আগামীকাল বা পরশু ঈদ। এই ঈদে নেতা-নেত্রীরা সৎ দুর্নীতিমুক্ত থাকার শপথ নিন। শপথ নিন, তাঁরা সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজকে প্রশ্রয় দেবেন না। তাঁদের দলে এ ধরনের সমাজবিরোধী ব্যক্তি থেকে থাকলে বের করে দেবেন। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজদের ভোট না দিতে বলেছেন, সেহেতু প্রথমে তাঁর দল ও সহযোগী সংগঠনে থাকা সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজদের বাদ দিয়ে প্রমাণ দিন, তিনি সত্যি সত্যি একটি সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চান। একই সঙ্গে আমরা বিএনপির নেত্রীকেও বলব, তাঁর দলেও কোনো সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবেন না। জনগণের ভোট নিয়ে তাঁরা ক্ষমতায় আসুন, কিন্তু ২০০১-২০০৬ সালের অন্ধকার যুগে দেশকে ফিরিয়ে নেবেন না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।