নোবেল পুরস্কার ও মুসলমান

Nobleহাসান শরীফ
প্রতিবছর যখন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হতে থাকে, তখন বেদনাদায়কভাবে মুসলমানদের নাম অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি ফুটে ওঠে। মুসলিম দেশগুলোর সংখ্যা কম নয়, এমনকি জনসংখ্যায়ও পিছিয়ে নেই। কিন্তু সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার হিসেবে চিহ্নিত নোবেলপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে মুসলমানরা হতাশাজনকভাবে পিছিয়ে আছে। মুসলমান দেশগুলো থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এদের মাত্র দুজন সাহিত্যে, দুজন বিজ্ঞানে এবং ছয়জন শান্তিতে। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তরা হচ্ছেন মিসরের নাগিব মাহফুজ (১৯৮৮), তুরস্কের ওরহান পামুক (২০০৬), পদার্থ বিজ্ঞানে পাকিস্তানের ডঃ আবদুস সালাম (১৯৭৯) ও রসায়নে মিসরের আহমদ জেরয়াইল (১৯৯৯); শান্তিতে মিসরের আনোয়ার সাদাত (১৯৭৮), ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত (১৯৯৪), ইরানের শিরিন ইবাদি (২০০৩), মোহাম্মদ আল বারাদেই (২০০৫), বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূস (২০০৬) ও ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান। মোহাম্মদ আল বারাদেই আন্তর্জাতিক আনবিক কমিশনের প্রধান হিসেবে পুরস্কারটি পেয়েছেন। আরও তিনজন আরব খ্রিস্টান বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন-ইলিয়াস জেমস কোরেই, পিটার মেডাওয়ার ও ফরিদ মুরাদ- তবে তারা সবাই পশ্চিমা দেশ-ভিত্তিক।
তবে মুসলমানদের মধ্যে যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছে, তাদের প্রায় সবাই মুসলিম সমাজে বিতর্কিত। সাহিত্যে প্রথম আরব ও মুসলমান হিসেবে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত নাগিব মাহফুজের উপন্যাসগুলো ১৯৫৯ সালে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় নিষিদ্ধ করেছিল। ১৯৯৪ সালে জনৈক জঙ্গি মুসলমান বিতর্কিত সাহিত্য রচনার জন্য তাকে ছরিকাহত করেছিল। ‘তুর্কি মূল্যবোধকে’ অপমান করার জন্য ওরহান পামুককে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। শান্তিতে নোবেল পাওয়া আনোয়ার সাদত, ইয়াসির আরাফাত, শিরিন ইবাদি, আল বারাদেই সবাই নিজ সমাজে বিতর্কিত হয়েছিলেন। আরব গণ-জাগরণের প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালে লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ ও একই দেশের শান্তিবাদী কর্মী লেমাহ বোয়িই’র সঙ্গে শান্তিতে নোবেল পান ইয়েমেনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী তাওয়াক্কুল কারমান। পশ্চিমারা ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আবু আবদুল্লাহ সালেহবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী কারমান ওই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। এ ক্ষেত্রে মোহাম্মদ ইউনূস অনেকাংশেই ব্যতিক্রম।
কিন্তু তারপরও নোবেল পুরস্কারে মুসলমানদের বঞ্চিত থাকাটা বেশ হতাশাজনক। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তদের মধ্যে মাঝে মাঝে চীন, জাপান ও ইসরায়েলের নামও শোনা যায়। তবে বেশির ভাগ পুরস্কার প্রাপ্তরা হচ্ছেন পশ্চিমা। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তদের মধ্যে ইহুদিদের সাফল্যকাহিনীও বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ ইহুদিদের মধ্য থেকে এপর্যন্ত ১৬৩ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। এদের মধ্যে আবার ১৫১ জন বিজ্ঞানে। শুধু পদার্থ বিজ্ঞানেই তারা ৪৪ বার পুরস্কারটি পেয়েছে। অবশ্য ইসরায়েলি নাগরিক হিসেবে ইহুদিরা মোট ৮টি নোবেল পেয়েছে।
এটা কি মুসলিম বিশ্বের জন্য কোনো শিক্ষা? মুসলমানরা কি এথেকে বেরিয়ে আসতে পারবে? কিংবা কেন পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ এতো বেশি এই পুরস্কারটি পাচ্ছে? সন্দেহ নেই, নোবেল পুরস্কারটি পশ্চিমা লোকদেরই কুক্ষিগত। তারা তাদেরই পছন্দীয় লোকদের পুরস্কার প্রদান করে থাকে। মুসলিম বিশ্ব কেন, পশ্চিমা দেশেরও অনেক নামকরা মানুষ নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই পুরস্কার প্রাপ্তির সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতির গভীর সম্পর্ক আছে বলে ধারণা করা হয়। ফলে নিবেদিতপ্রাণ মুসলমানের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনা এমনিতেই কমে যায়। মহাকবি ইকবালের লোকের নাম বিবেচিতই হয়নি একারণেই।
অনেকেই এপ্রসঙ্গে কয়েকজনের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সময়ের কথা উল্লেখ করেন। রবীন্দ্রনাথ বৃটিশ-রাজের প্রশংসা করে কবিতা রচনা করেছিলেন। পঞ্চম জর্জকে তিনি ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে’ বলে অভিহিত করেছিলেন। পরবর্তীতে এই গানটিই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তার দুবছরের মধ্যেই তিনি নোবেল পুরস্কারটি পেয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথের মহান প্রতিভাকে অবশ্য কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তবে তার আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কারণেও এই পুরস্কার প্রাপ্তিটি ত্বরান্তিব করেছে বলে অনেকে মনে করেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভিএস নইপল নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তার বিষয়বস্তুও ছিল মুসলিমবিদ্বেষ। মিসরের নাগিব মাহফুজ নিজের দেশেই বেশ বিতর্কিত। নোবের পুরস্কার পাওয়া বিশ্ব রাজনীতির বাইরের কোনো ঘটনা নয়। তাছাড়া পশ্চিমাদের পছন্দীয় কাজ করতে পারলে নোবেল পুরস্কার সহজেই পাওয়া যেতে পারে। নইপলের নোবেল পাওয়ার ঘটনা সেটাই নতুন করে প্রমাণ করেছে। বলা হয়ে থাকে, তিনি মুসলিম এবং প্রাচ্য বিদ্বেষ সংক্রান্ত ‘নোবেল পাওয়ার সহজপন্থা’ অনুসরণ করেই পুরস্কারটি পেয়েছেন। রাশিয়ার কয়েকজন লেখকের এই পুরস্কারটি পাওয়ায় প্রশ্নটি আরো বড় করে দেখা দেয়। ইভান বুনিন, বোরিস পস্টারনাক, মিখাইল শলোকভ, আলেক্সান্ডার সোলঝেনিৎসিন, যোশেফ ব্রডস্কি-যারা সমাজতান্ত্রিক আমলে নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছেন, তারা সবাই বিতর্কিত। তারা হয় রাশিয়া থেকে বিতাড়িত কিংবা কমিউনিজমের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড রকমের সরব ছিলেন।  ইভান বুনিন রাশিয়ার এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি ‘মেমোরিস এন্ড পোট্রের্ট’ গ্রন্থে রুশ বিপ¬বের বিরুদ্ধে লিখেছেন। তিনি রুশ বিপ্ল-বের ভয়াবহতা দেখেই নাকি দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তখন মার্কিনীদের প্রতিপক্ষ সোভিয়েতের বিরোধী হওয়াটা ছিল নোবেল পুরস্কার পাওয়ার একটি সহজপন্থা। এখন হয়তো মুসলিম দেশে থেকে মুসলমানদের বিরোধীতা করার মাধ্যমেই পাওয়া যেতে পারে এই পুরস্কারটি। একারণেই হয়তো ইরানের শিরিন ইবাদি গত বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। আগামীদিনগুলোতে একারণেই এই পুরস্কার বিজয়ীদের মাঝে মুসলমান সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন।
এতো সমালোচনা সত্ত্বেও এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, পশ্চিমা সমাজ উদার সমাজ। পশ্চিমাদেশগুলোতেই অন্য যেকোন স্থান থেকে অনেক বেশি জ্ঞানসমৃদ্ধ ও আলোকিত মানুষ বসবাস করে। মুসলিম বিশ্বের এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা।
সাধারণভাবে কুপমণ্ডুকতা ছাড়াই পশ্চিমারা অনেক বেশি ধর্মানুসারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন চক্রে এখন নিউ-কনজারভেটিভদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। কিন্তু তারপর দেশটির একটি বড় অংশের নারী ও পুুরুষ বিজ্ঞান, আর্ট, সাহিত্য, চ্যারিটি এবং মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজে আগ্রহ তুলনামূলকভাবে অনেক কম দেখা যায়।
মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকল দেশ থেকেই প্রতিনিয়ত আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাচ্ছে জ্ঞান অর্জনের জন্য। তারাই নিজ দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখছে। পাকিস্তানে থাকলে আবদুস সালাম কখনও নোবেল পুরস্কার পেতেন কিনা সন্দেহ আছে।
অথচ মুদ্রার অন্য পিঠে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ইউরোপ যখন মধ্যযুগের অন্ধকারে আচ্ছন্ন, তখন মুসলিম বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনায় সমুজ্জ্বল। বিজ্ঞান সাধনায় প্রতিনিয়তই আলোকিত মানুষেরা এগিয়ে আসছে। মুসলিম বিশ্বই তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল। এমনকি খৃস্টান বিশ্ব থেকেও শিক্ষার্থীরা ছুটে আসতো মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানার্জনের জন্য। বিশ্ব এখনও তাদের সেই অবদানের স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্ত তা কি অব্যাহত রাখা গেছে?
স্পেনের ইবনে রুশদকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের প্রথম মুক্ত-চিন্তার নায়ক। ইবনে খালদুনকে বলা হয় ‘ইতিহাসের জনক’। চিকিৎসাশাস্ত্রে ইবনে সিনার অবদান অনস্বীকার্য।  তার আল-কানুন ১৭শ শতকেও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছিল পাঠ্য। তার অন্যতম ছাত্র ছিল এক ইহুদি পণ্ডিত ইবনে গ্যাবিরল।
মুসলিম বিশ্বে সে সময়ে জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ ছিল সহিষ্ণু পরিবেশ। সারা বিশ্বের নির্যাতীত, নিপীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল মুসলিম দেশগুলো। এমনকি ইউরোপে অন্যত্র থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা মুসলিম স্পেনে তাদের প্রতিভা বিকাশের সবচেয়ে অনুকূল স্থান বিবেচনা করতো। আর সেই মুসলমানদের অবস্থা এখন কোথায়?

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button