ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন আর নেই
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন আর নেই। বুধবার সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
গত ১৮ আগস্ট মস্তিষ্কে রক্তরণে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আবদুল মতিনকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)তে নেয়া হয়। ২০ আগস্ট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মস্তিষ্কের জমাটবাঁধা রক্ত অপসারণ করা হয়। তখন থেকে তার অবস্থা অপরিবর্তিত ছিল। অবস্থার অবনতি হলে গত শুক্রবার সকাল ৮টায় তাকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়।
৮৮ বছরের এই ভাষা সংগ্রামী ডায়াবেটিস, রিকারেন্স হার্নিয়া ও প্রস্টেট গ্ল্যান্ডসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন।
আবদুল মতিনের স্ত্রী গুলবদন নেসা জানান, তার স্বামীর লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে দেয়া হবে। এ ছাড়া তার চোখ দেয়া হবে সন্ধানীকে।
উল্লেখ্য, গত ৪ অক্টোবর লাইফ সাপোর্টে দেয়ার আগে নিজের চোখ সন্ধানীকে দেয়ার ঘোষণা দেন আবদুল মতিন। জানা গেছে, মৃত্যুর পরপরই আইসিইউতে কর্ণিয়া সংগ্রহ করে সন্ধানী।
আবদুল মতিনের স্ত্রী আরো জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. ডা. হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি আবদুল মতিনকে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানো ও নামাজে জানাজাসহ অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে আবদুল মতিনের লাশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। সেখান থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে নেয়া হবে তার লাশ।
আবদুল মতিনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, সৌদি আরবে অবস্থানরত রাষ্ট্রপতি আজ এক শোকবার্তায় বলেন, আবদুল মতিন ১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন জাতি তা চিরদিন স্মরণ করবে।
তিনি বলেন, তার মৃত্যুতে জাতি একজন কৃতি সন্তানকে হারালো।
রাষ্ট্রপতি আবদুল মতিনের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
অপর এক শোকবাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের স্বাধীনতার সোপান রচনা হয় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। আর আবদুল মতিন সেই আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক। তার মৃত্যু একটি জীবন্ত ইতিহাসের অবসান।
প্রধানমন্ত্রী ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার এবং শোকগ্রস্ত প্রতিটি মানুষের প্রতি সমবেদনা জানান।
আবদুল মতিনের মৃত্যুতে খালেদা জিয়ার শোক
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভাষা সৈনিকের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি এ শোক প্রকাশ করেন। বিএনপির প্রেস উইং থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
একনজরে আবদুল মতিন
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের প্রাণশক্তি, যার ব্যাপক তৎপরতা যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নানামুখী তৎপরতা থেকে শুরু করে ছাত্রদের উজ্জীবিত করা, ১৪৪ ধারা ভঙ্গসহ যে সাহসী ও বিচক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাঙালি জাতিসত্তার লড়াইয়ের সেই প্রবাদপুরুষ ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার ধুবুলিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল জলিল, মায়ের নাম আমেনা খাতুন। ধুবুলিয়া গ্রামটি ছিল যমুনা নদীবেষ্টিত।
১৯৩০ সালের দিকে প্রমত্তা যমুনার সর্বগ্রাসী ভাঙনে গ্রামটি বিলীন হয়ে যায়। ফলে আবদুল জলিল তার পরিবারসহ শিশু মতিন ও অন্যান্য নাবালক সন্তান নিয়ে যমুনার বুকে জেগে ওঠা একটি চরের শৈলজানা নামের গ্রামে বসতভিটা গড়ে তোলেন। মধ্যম শ্রেণীর কৃষক আবদুল জলিলের যা জমিজমা ছিল তার সবই ছিল চরের মধ্যে। ফলে জমি থেকে আবদুল জলিল তেমন কিছু করতে পারতেন না। জমির ফলন ছিল নদীর খেয়ালিপনার শিকার। বানের তোড়ে মাঠের ফসল যেত নষ্ট হয়ে। ফলে তিনি ভাগ্যান্বেষণে হিমালয়ের পাহাড়ি গাছগাছালির শহর দার্জিলিং আসেন। এখানে ১৯৩০ এর দশকে জলা পাহাড়ের ক্যান্টনমেন্টে তিনি একটি চাকরি খুঁজে পান। তখন আবদুল জলিল এন্ট্রাস পাস ছিলেন। তা সত্ত্বেও কম মজুরির সুপারভাইজার হিসেবে তিনি গ্যারিসনে যোগদান করেন। মাসিক বেতন মাত্র ১৫ রুপি। এ সময় তিনি তার পরিবারের জন্য গ্যারিসনে একটি বাসা বরাদ্দ পান। ১৯৩২ সালে আবদুল জলিল সিরাজগঞ্জের শৈলজানা গ্রাম থেকে তার তিন ছেলে ও দুই মেয়েসহ সাত সদস্যের পরিবার সাথে নিয়ে দার্জিলিংয়ে চলে আসেন।
শিক্ষাজীবন
১৯৩২ সালে ছয় বছর বয়সে ভারতের দার্জিলিংয়ের মহারানী গার্লস হাইস্কুল নামের একটি বাংলা মাধ্যম স্কুলে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে আবদুল মতিনের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে তিনি দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৪৩ সালে এন্ট্রাস (মাধ্যমিক) পাস করেন।
১৯৪৩ সালে তিনি রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন এবং ১৯৪৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৫ সালে আবদুল মতিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস (পাস কোর্স) বিভাগে ভর্তি হন এবং ফজলুল হক কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে স্নাতক পর্ব শেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এম এ প্রথম ব্যাচে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতিনীতির বিরুদ্ধ হওয়ার পরও বিশেষ অনুমোদনে ড. মাহমুদ হাসান নিজ ইচ্ছায় তাকে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি করে নেন। একই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে ভর্তি হন।
১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার ভাষণে ‘উর্দু কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ উচ্চারণ করলে আবদুল মতিন দাঁড়িয়ে তীব্র কণ্ঠে প্রতিবাদ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের এক প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার সময় পুলিশ সচিবালয়ের কাছ থেকে আবদুল মতিনকে গ্রেফতার করে এবং দুই মাসের আটকাদেশ দিয়ে কারাগারে পাঠায়।
জেলে যাওয়ার আগে তিনি কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিসের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য সরকার জেলারের মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে আবদুল মতিনকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেয়। শর্ত হলো ভবিষ্যতে তিনি কখনো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবেন না, এই মর্মে মুচলেকায় স্বাক্ষর দিতে হবে। আবদুল মতিন ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। দু’মাস পর কারাগার থেকে মুক্তি পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আবদুল মতিনকে তার কক্ষে ডেকে পাঠান এবং একই ধরনের একটি মুচলেকায় স্বাক্ষর করতে বলেন, মতিন তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল থেকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করে। আবদুল মতিন ফজলুল হক হল ছেড়ে চলে যান এবং ইকবাল হলের পাশের ব্যারাকে থাকার ব্যবস্থা করেন।
১৯৫০ সাল রাষ্ট্রভাষা দিবসের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে ১১ মার্চ ক্যাম্পাসে আয়োজিত ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সমাবেশে আন্দোলনকে সংগঠিত এবং সঠিক পথে পরিচালনার জন্য আবদুল মতিন একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করলে উপস্থিত সাধারণ ছাত্রদের সিদ্ধান্তে তাকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই সংগ্রাম পরিষদের বেশির ভাগ সদস্য কোনোরকম কর্মকাণ্ডে না থাকলে এমনকি বারবার সভায় উপস্থিত না হলে আবদুল মতিন এই পরিষদ পুনর্গঠন করেন এবং পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুনদের অন্তর্ভুক্ত করে আট সদস্যের কমিটি গঠন করেন। আন্দোলনের কর্মসূচির খরচ মেটানোর জন্য জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে ১৯৫১ সালের ৫ এপ্রিলকে পতাকা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সাধারণ ছাত্রছাত্রী দিবসটি উদযাপনে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেন এবং এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তারা আশাতীত অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
১৯৫০-৫২ এই তিন বছর সময়ের মধ্যে আবদুল মতিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচিকে জনপ্রিয় ও সফল করার লক্ষ্যে সারা দেশে বিভিন্ন বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটে বেড়িয়েছেন। ২৭ জানুয়ারি ১৯৫২ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় মুসলিম কাউন্সিলের এক সভায় ঘোষণা দিলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। নাজিমউদ্দিনের এই বক্তব্যের প্রতিবাদে তার পর দিনই আবদুল মতিন ও সহযোগী ছাত্র নেতারা এক বিশাল প্রতিবাদ বিক্ষোভের আয়োজন করেন।
১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে দেশের অবিসংবাদিত নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আহূত রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রনেতাদের সমাবেশের আলোচনা সভায় কাজী গোলাম মাহাবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আবদুল মতিন পরিষদের অন্যতম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক হিসেবে আবদুল মতিন ১৯৫২ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্রদের এক সমাবেশ আহ্বান করেন। ওই সমাবেশ থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের ঘোষণাসহ তাদের ২১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আবদুল মতিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী এক কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
ছাত্রদের আন্দোলন কর্মসূচিকে প্রতিহত করতে সরকার ২১ ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে সারা দেশে ১৪৪ ধারা জারি করে। আবদুল মতিনের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্র-কর্মীরা সরকারের ১৪৪ ধারা ভেঙে ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাদের নির্ধারিত কর্মসূচি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারির ঠিক আগে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ ছাত্র নেতারা শহরের নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয়ে এক সভায় মিলিত হন। দীর্ঘ সময়ব্যাপী অনুষ্ঠিত ওই সভায় আবদুল মতিন এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম। আবদুল মতিন সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে দীর্ঘ বক্তব্য দেন এবং নানা যুক্তি হাজির করেন। সভায় উপস্থিত বেশির ভাগ নেতা ছিলেন নানা শঙ্কায় শঙ্কিত। ভাষার দাবি নিয়ে সরকারের মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রশ্নে তাদের মধ্যে দেখা দেয় অনীহা। ওই সময় তাদের কাছে মাতৃভাষার মর্যাদার চেয়ে বড় চিন্তার বিষয় ছিল আসন্ন সাধারণ নির্বাচন, আর এ জন্যই তারা সরকারকে ঘাটাতে চাননি।
শেষ পর্যন্ত বহু পাল্টাপাল্টি তর্ক-বিতর্কের পর ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য সভায় ভোট গ্রহণ করা হয়। উপস্থিত ১৫ জনের মধ্যে চারজন ভোট দেন ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের পক্ষে বিপক্ষে ১১ জন। এ ধরনের সিদ্ধান্তের পর আবদুল মতিন আবারো জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন এবং সভার সভাপতি বিচক্ষণ রাজনীতিক আবুল হাশিমকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, আজকের সভার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় কোনো বিবৃতি দেয়া ঠিক হবে না বরং এটাকে দু’টি মতামত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। এখানেই আবদুল মতিনের সাফল্য নিহিত যে, তিনি জাতীয় পর্যায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সভায় সাধারণ ছাত্রদের মতামতকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের সাফল্যের পথ খুলে দেয়। পর দিন একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সমবেত সাধারণ ছাত্রদের ওপরে মতামত দু’টির ভাগ্য নির্ধারণের ভার দেয়ার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে শেষ রাতের দিকে সভার সমাপ্তি হয়।
আবদুল মতিন এবং তার সহযোগীরা পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রচুর সাধারণ ছাত্রকে সমাবেশে সংগঠিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। সারা শহরে টান টান উত্তেজনা। আগের সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ক্যাম্পাসে জড়ো হওয়া বিশাল ছাত্র সমাবেশের সম্মুখে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত অর্থাৎ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার এবং আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে তাদের বক্তব্য ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। মতামত দু’টি শোনার পর উপস্থিত ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে রায় দেন এবং যেকোনো মূল্যে তা কার্যকর করার পক্ষে স্লোগান দিতে থাকে।
আবদুল মতিন পুরো ব্যাপারটিকে টেনে সাধারণ ছাত্রদের সামনে নিয়ে এসে তাদেরকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হওয়ায় ২১ ফেব্রুয়ারি আবদুল মতিনসহ আন্দোলনের অন্যান্য নেতার সিদ্ধান্তে ১০ জন করে ছাত্রদের কয়েকটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলা গেট থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। এ সময় পুলিশ ছাত্রদের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং গুলি চালায়। সেদিন বেশ কয়েকজন শহীদ হন, তাদের মধ্যে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন, আবদুল জব্বার অন্যতম। অসংখ্য মানুষ আহত হন এবং অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়।
সরকারের সব নিষেধাজ্ঞা ও ভয়ভীতি উপক্ষো করে আবদুল মতিন এবং সহযোগীরা পুলিশের গুলিতে নিহতদের স্মরণে এক গায়েবানা জানাজার আয়োজন করেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের তীব্র বিরোধিতা ও আপত্তি সত্ত্বেও গায়েবানা জানাজার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আবদুল মতিনের স্বাক্ষরিত এক প্রচারপত্র বিলি করা হয়।
২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি ঘোষণার ফলে সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা কাজে যোগ না দিয়ে সেখান থেকে হাজারে হাজারে মিছিল করে সকাল ১০টার মধ্যে আগের দিনের গুলির ঘটনাস্থল মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে জানাজায় সামিল হন। শহরে ১৪৪ ধারা বলবৎ ছিল কিন্তু কেউ তা মানছিল না। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এই জানাজায় সামিল হয়েছিল। একদিন আগে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের ঐতিহাসিক জমায়েতে কেবল ছিল ছাত্র আর ২২ ফেব্রুয়ারির মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে নিহতদের গায়েবানা জানাজায় বেশির ভাগ ছিলেন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরা। এই যথাযথ ও সময়োচিত কর্মসূচির কারণে একদিন আগের ছাত্রদের বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন সমগ্র জনগণের বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনে পরিণত হওয়ার পথ পেয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি সম্ভব হয়েছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্তের কারণে আর ২২ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছিল গায়েবানা জানাজার সিদ্ধান্তের কারণে। আর এ দুটো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির, যার নেতা ছিলেন আবদুল মতিন।
জানাজা শেষে পুুলিশি হামলার প্রতিবাদে ছাত্র জনতার বিশাল মিছিল বের হয়। মিছিলটি কার্জন হল পার হয়ে হাইকোর্টের মোড়ে পৌঁছলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু তারপরও জনতার প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে এবং দুপুর ১২টার দিকে পুরান ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়ে যায়। এবং প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত জনতার এই বিক্ষোভ চলে। সেই পর্যায়ে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে এবং বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও কেউ যেমন তা মানছিল না, ভয়েও ভীত ছিল না। ধর্মঘট, বিক্ষোভ, মিছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘটেছিল। মূলত পরিস্থিতিটি এক গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ-ইপিআর-সেনাবাহিনী যৌথভাবে নির্বিচারে গুলি চালায়। ২২ ফেব্রুয়ারি শফিউর রহমান, আব্দুস সালাম, আবদুল আওয়াল (রিকশাচালক) এবং অহিউল্লাহ (কিশোর) শহীদ হন। আহত হন অসংখ্য। ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার একই সাথে ১০ জনের নামে হুলিয়া জারি করে। এদের মধ্যে আবদুল মতিন ছিলেন অন্যতম। বাকিরা হলেন মওলানা ভাসানী, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, খালেক নেওয়াজ খান, সৈয়দ নূরুল আলম, আজিজ আহম্মদ ও আবদুল আউয়াল।
হুলিয়া ঘোষিত হলেও আবদুল মতিন একটুও দমেননি। আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্রদের বৈঠকের মাধ্যমে সারা দেশে আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ইশতেহার প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি কারফিউ থাকা সত্ত্বেও সারা রাত ধরে মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। শহীদ মিনারটির নকশা অঙ্কন করেন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সাঈদ হায়দার। মেডিক্যাল কলেজে তখন একটা নির্মাণকাজ চলছিল। ছাত্রদের অনুরোধে ভাষা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল দু’জন কন্ট্রাকটর ইট, সিমেন্ট, রড ও শ্রমিক দিতে সম্মত হন। ১০-১২ জন রাজমিস্ত্রি ছাত্রদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় রাতের মধ্যে শহীদ মিনার তৈরি করে ফেলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি যথারীতি শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয়। আবুল কালাম শামসুদ্দীন শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। দৈনিক আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ২২ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ থেকে ইস্তফা দেন। এই স্মৃতিসৌধের নিচে একটি চাদর পেতে দেয়া হয়েছিলÑ সেটাতে মানুষ টাকাপয়সা দিয়েছিল, এমনকি মহিলারা তাদের গায়ের গয়না খুুলে দিয়েছিল। শহীদ মিনার নির্মাণসহ পুরো প্রক্রিয়ায় আবদুল মতিন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, নিজে ইট-বালু বহন করাসহ সাধারণের কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকেরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং ওই দিনই প্রথম শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়। এর কিছু দিনের মধ্যে আবদুল মতিনসহ কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হন।
কিন্তু গ্রেফতার নির্যাতন কোনো আন্দোলনকে পরাভূত করতে পারে না। যেমন পারেনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে। ভাষা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিণতির দিকে এগোতে থাকেÑ বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।