রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও নামাযে জানাযা হয়নি ভাষা মতিনের

রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও নামাযে জানাযা হলো না ভাষা মতিনের। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আবদুল মতিনকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন সর্বস্তরের মানুষ। এরপর লাশ তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন স্ত্রী গুলবদন নেসা মনিকা। উল্লেখ্য, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পুরোধা আব্দুল মতিন গত বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববদ্যালয়ে ৮৮ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
হাজারো মানুষ সারিবদ্ধভাবে একে একে ফুল হাতে ভাষা আন্দোলনের এই অগ্রসেনানীর কফিনে বিনম্র শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। দুপুর ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত ধর্ম-বর্ণ-পেশা-রাজনৈতিক দর্শন নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ শেষ বিদায় জানান ভাষা মতিনকে। রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে থেকে হাজারো মানুষ শহীদ মিনারে আসেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। শ্রদ্ধা নিবেদন ছাড়া নামাযে জানাযার মতো ধর্মীয় রীতি তার ক্ষেত্রে কেন মানা হয়নি সে ব্যাপারে পরিবারের পক্ষ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। ভাষা মতিন নাস্তিক ছিলেন কি-না সে বিষয়টিও কারো কাছে স্পষ্ট নয়।
সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আবদুল মতিনের ইচ্ছা অনুযায়ী তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মতিন-পতœী গুলবদন নেসা মনিকা দুপুর পৌনে দুইটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মো. শফিকুল আলম চৌধুরীর কাছে তার লাশ হস্তান্তর করেন। এসময় ঢামেক এনাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামীম আরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর দুপুর সোয়া দুইটায় লাশটি এনাটমি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঢামেক সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল মতিনের পরিবারের সম্মতিতে তার লাশ প্রিজার্ভ (সংরক্ষণ) করা হবে। গতকাল থেকেই এই সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে এবং সাত থেকে আট দিন লাগবে এ কাজ শেষ হতে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দুই মাস সময় লাগবে। পরে তা মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহৃত হবে।
এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হিমঘর থেকে বেলা ১১টা ৫০মিনিটে তার লাশ নেয়া হয় ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা মেডিকেল কলেজের ঐতিহাসিক আমতলায়। সেখান থেকে ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনের লাশ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়।
ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনের কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সকাল থেকেই শহীদ মিনারে জড়ো হন হাজারো মানুষ। তার লাশ শহীদ মিনারে পৌঁছলে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সর্বস্তরের হাজারো মানুষ সেখানে জাতির এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। ফুল হাতে বিনম্র শ্রদ্ধায় ভাষা আন্দোলনের এই ভাষানায়ককে তারা শেষ বিদায় জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য নুহ-উল আলম লেলিন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর,  মির্জা আব্বাস, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ও আ স ম হান্নান শাহ, কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সম্মিলিত আইনজীবী পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের পক্ষ থেকে কেএম সফিউল্লাহ, সমকাল পরিবারের পক্ষ থেকে একে আজাদ ও গোলাম সারওয়ার, বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ন্যাপ ঐক্যের আহ্বায়ক পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়া, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ, জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) শফিউল আলম প্রধান, গণতন্ত্রী পার্টির নুরুর রহমান সেলিম, গণফোরামের মোস্তফা মহসিন মন্টু,  বৈশাখী টিভির পক্ষ থেকে মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, তুষার খান, নাদের চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, এনটিভির মোস্তফা কামাল সৈয়দ, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকি, বিশিষ্ট কলামিস্ট  সৈয়দ আবুল মকসুদ, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না,  বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু, ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুর প্রমুখ।
ফুল দিয়ে আরো  শ্রদ্ধা জানিয়েছে কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি,  বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, দেশটিভি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েশন, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, হাক্কানী মিশন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক), হামদর্দ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক পার্টি, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ পিপলস লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ভাষা মতিনের শেষ রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের পক্ষ থেকে কাস্তে-হাতুড়ি খচিত লাল পতাকা দিয়ে তার কফিন ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর গান গেয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতে লাল সালাম জানিয়ে শেষ বিদায় জানানো হয় এই রাজনৈতিক নেতাকে।
ভাষা মতিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেয়ায় ক্ষোভ কেবল বিএনপিই প্রকাশ করেছে করেছে এমন নয়, তার সহযোদ্ধারাও ছিলেন দারুণভাবে ক্ষুব্ধ। আবদুল মতিনকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ভাষা সৈনিক রওশান আরা বাচ্চু তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যিনি এই সুন্দর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দিলে আমরা অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত হব। তার (আবদুল মতিন) মৃত্যুতে আমরা এক কৃতী সন্তান হারিয়েছি। যাকে আমরা কোনো দিনই সঠিক মর্যাদা দিতে পারিনি। অথচ তার নেতৃত্বেই আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ (১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি) করেছিলাম। ভাষার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুুত ছিলাম।
সংস্কৃতিকর্মী লিনা আক্তার বলেন, চাচার (ভাষা মতিন) সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিলো। একবার ২১শে ফেব্রুয়ারিতে চাচার সঙ্গে শহীদ মিনারে দেখা হয়। তখন চাচা বলেছিলেন, মা আমার কোটি কোটি টাকা নাই বলে অনেকেই অনেক কথা বলে। তখন আমি শহীদ মিনারের সামনে চলে আসি। আমার বড় অর্জন তো এই শহীদ মিনারই।
এদিকে, ভাষা মতিনের ইন্তিকালে বিভিন্নমহলের শোক অব্যাহত রয়েছে। গতকাল শত নাগরিক জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল ও নতুনধারা বাংলাদেশ আলাদা শোক বাণী দিয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button