ভারত ও পাকিস্তান কি চিরকাল পরস্পরের শত্রু হয়েই থাকবে?
কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের এলাকায় প্রচন্ড গোলাগুলিতে মেতে উঠেছে। নতুন কোনো ঘটনা নয়। দু’দেশের মধ্যে এমন ঘটনা আগেও বরাবর ঘটে এসেছে। কিন্তু গোলাগুলিতে এর আগে বহ বছরে এতো বেশি সংখ্যক বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেনি।
ভারতীয় সমীক্ষকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পাক সেনাপ্রধান রাহিল শরীফ ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ক্ষমতায় অধিষ্ঠান বরদাস্ত করতে প্রস্তুত নন বলেই পাক-ভারত সীমান্তে গোলাগুলির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে অশান্ত পরিস্থিতির জন্ম নিতে তৎপর হয়েছেন। তাদের মতে, সাবেক পাক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বিচার প্রক্রিয়ায় ও তাকে কয়েদ করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন যে ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিয়েছে পাক সেনা কর্তৃপক্ষ সহজ স্বাভাবিকভাবে তা মেনে নেয়নি। ইমরান খান পাকিস্তান জুড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। নওয়াজ শরীফকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে- তার আন্দোলনের এটিই হচ্ছে একমাত্র দাবি। সীমান্তে পাক সেনাবাহিনীর গোলাগুলি কা- ও ইমরান খানের আন্দোলন অভিন্ন উদ্দেশ্যে উভয় তৎপরতা পরিচালিত হচ্ছে-মনে করেন ভারতীয় সমীক্ষকেরা। ভারত একতরফা গোলাবর্ষণ করে সীমান্তে শান্তিভঙ্গ করছে- অভিযোগ করেছে পাকিস্তান। প্ররোচনা ছাড়াই পাক ভূখন্ডে ভারতের গোলাগুলি তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সামরিক পর্যবেক্ষক দলের কাছে প্রতিবাদও জানিয়েছে পাকিস্তান। সীমান্ত রেখা বরাবর যুদ্ধবিরতি তদারকির ও জাতিসংঘকে পাকিস্তান আহ্বান জানিয়েছে এবং বলেছে সীমান্ত বরাবর ভারত বালির বস্তা এনে জড়ো করেছে।
ভারতকে এই কাজ করতে দেখা গেছে অতীতে যুদ্ধকালে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। ধরে নেয়া যায় পারমাণবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা সম্বন্ধে উভয় দেশই ওয়াকিবহাল। কিন্তু তা সত্ত্বেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে দু’দেশের মধ্যে গোলাগুলির তীব্রতা ক্রমে বেড়ে চলেছে এবং একই সঙ্গে বেড়ে চলেছে দু’দেশের মধ্যে পরস্পর বিরোধী সীমাহীন আক্রমণাত্মক উক্তি প্রত্যুক্তি।
ভারত ও পাকিস্তানে প্রশাসনিক কর্তৃত্বের পরিবর্তন ঘটেছে এ পর্যন্ত বহুবার। কিন্তু বড় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেছে দু’দেশের পুরাতন ও নতুন সমস্ত ক্ষমতাসীনই পাক-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের মনোভাবের অপরিবর্তনীতা আগাগোড়া অক্ষুণ্ন রেখে চলেছেন। দু’দেশের মধ্যকার সমস্যা সমাধানে অগ্রগতি উদ্যোগ এ পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিণাম দাঁড়িয়েছে থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়। দু’দেশের মধ্যকার পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভাষাতেও এ পর্যন্ত কোনো ইতর বিশেষ দেখা যায়নি।
তাসখন্দে সমঝোতা বৈঠকে বসেন দু’দেশের নেতারা। নেতাদের করমর্দন দেখা গেছে সিমলায় ও আগ্রায়। বাসে চড়ে বাজপেয়ী লাহোরে গেছেন। কিন্তু সমস্ত কূটনৈতিক সমঝোতা উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত শূন্যে মিলিয়ে গেছে। দু’দেশের পারস্পরিক সম্পর্কে ছয়দশক পরেও যে উপাদানগুলো আজো স্থিতিশীল থেকে গেছে তা হচ্ছে- মাঝে-মধ্যে খন্ডযুদ্ধ, অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ এবং তিক্ততা। স্মরণকালের মধ্যে ভয়ঙ্করতম দুর্যোগ বিপর্যয়ের সম্প্রতি সম্মুখীন হলেন কাশ্মীরের বাসিন্দারা। পুরো বিপর্যস্ত হয়ে গেছে কাশ্মীরের অবকাঠামো ও কাশ্মীরবাসীর জীবনযাত্রা। সেখানে আজো পানিতে তলিয়ে রয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। কিন্তু কাশ্মীরীদের দুঃখ যন্ত্রণার কথা একটিবারের জন্যও উল্লেখ পাচ্ছে না পাকিস্তানের ও ভারতের মধ্যকার পারস্পরিক হানাহানি ও পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগারের ঘটনাগুলোর মধ্যে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বিদায় ও ভারতের ক্ষমতায় নরেন্দ্র মোদির আবির্ভাবে ভারত-পাক হিতৈষীদের অনেকে ধারণা করেছিলেন, মোদি ও শরীফের হাস্যমুখ করমর্দনে ভারত-পাক সম্পর্কে একটি নতুন শুভযাত্রা শুরু হবে। কিন্তু তা হয়নি। শুরু হয়ে গেছে আবারো সেই পুরনো কাদা ছোড়াছুড়ি।
নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও নীতিভ্রষ্টতায় আজ ভুগছে প্রায় পুরো দক্ষিণ এশিয়া। মারণাস্ত্রের পেছনে কোটি কোটি ডলার আজ খরচ হচ্ছে দেশগুলোয়। অথচ জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনের অভাবে ভুগছে দেশগুলোর আপামর জনসাধারণ। অক্সফোর্ড পভার্টি এন্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট তার জরিপে জানাচ্ছে আফ্রিকার ২৬টি দরিদ্রতম দেশের চেয়েও বেশি মাত্রায় দারিদ্র্য যন্ত্রণায় ভুগছে ভারতের আটটি রাজ্যের কোটি কোটি বাসিন্দা। মঙ্গলে ঘটা করে উপগ্রহ পাঠানো হচ্ছে। কোটিপতির সংখ্যা দেশে বেড়ে চলেছে ক্রমাগতভাবে। অথচ ভারতের প্রায় ৪৩ কোটি মানুষ হচ্ছে দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্রতম লোকজন। এতো তীব্র দারিদ্র্য সাহারা সংলগ্ন আফ্রিকাতেও দেখা যায় না।
অন্যদিকে পাকিস্তানও ভুগছে নিরন্তর দারিদ্র্যে, দুর্নীতিতে, লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতিতে, অবকাঠামোগত দুর্দশায় ও বিদ্যুৎ ঘাটতিতে। সন্ত্রাসবাদ তো রয়েছেই। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে যৎসামান্য পার্থক্য দেখা যায় ভারত ও পাকিস্তিানের মধ্যে।
পারস্পরিক অনাস্থা ও শত্রুতা দু’দেশের নেতৃত্বের মানসিকতায় এতোই গভীরে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, বিপুল সংখ্যক জনগণের দুঃখজর্জরিত জীবনযাত্রায় স্বস্তি স্বাচ্ছন্দ্য পৌঁছানোর চিন্তা উপেক্ষা করে দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে তারা নিরন্তন বিঘ্নিত করে চলেছেন- পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার গর্বে স্ফীত হয়ে।
শান্তির শত পথ উন্মুক্ত রয়েছে। কিন্তু দু’দেশের অদূরদর্শী নেতৃত্ব ওপথে এগোতে চাচ্ছেন না ক্ষমতার লালসায় ও মদমত্ততায়।