ইবোলা এখন বাংলাদেশে !
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইবোলা ভাইরাস শনাক্তকরণের লক্ষ্যে যাত্রীদের শারীরিক পরীক্ষার জন্য সরকারিভাবে মেডিকেল সেন্টার স্থাপন করা হয়।
ওই সেন্টার কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে মরণব্যাধি ইবোলা ভাইরাস কবলিত লাইবেরিয়া, সিয়েরালিয়নসহ মধ্য আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ থেকে সম্প্রতি সময়ে দেড় শতাধিক বাংলাদেশী দেশে ফিরে আসলেও তাদের ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন না হওয়ায় দেশজুড়ে ইবোলা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে এনিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে। প্রকাশিত সংবাদ দেখে ইবোলাকবলিত লাইবেরিয়া থেকে গত ৯ অক্টোবর দেশে ফেরত আসা বরিশালের গৌরনদী ও মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার চারজন যাত্রীর রক্ত পরীক্ষা করার জন্য বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগ এখন হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাদের ডাক্তারী পরীক্ষা সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় প্রশাসন। এ কারণে অনেকটাই ভোগান্তিতে পড়েছেন আগতরা। তারা অযথা হয়রানির জন্য বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনকে দায়ী করছেন।
অপরদিকে পরীক্ষা ছাড়াই ইবোলাকবলিত দেশ থেকে আসা এতোগুলো লোক বিমান বন্দর থেকে কিভাবে বেরিয়ে এসেছে তা নিয়েও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
লাইবেরিয়া থেকে ফেরত আসা বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাঙ্গীলা গ্রামের কাসেম সরদারের পুত্র রুহুল আমিন সরদার (৩৫) জানান, তিনি গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুরোধে রবিবার দুপুরে গৌরনদী হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করিয়েছেন। এছাড়া তার শ্যালক মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার আটিপাড়া (ভাংগা ব্রিজ) গ্রামের ইলিয়াস হাওলাদারের স্ত্রী সেতু বেগম (২৫), শ্যালকের পুত্র তাছরিন ওরফে সনেট (৮), কন্যা ঐশিকে (২) রক্ত পরীক্ষার জন্য ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ডাকা হয়েছে। বিমান বন্দরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তাদের রক্ত পরীক্ষা করা হবে।
তিনি আরো জানান, তারা ৪ জনসহ কালকিনি সদরের মাহবুব সরদার (৩০) ও খুলনার ভুলু (৪২) ইবোলা ভাইরাসের ভয়ে গত ৯ অক্টোবর সকালে স্বদেশে ফিরে এসেছেন।
গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ মোসলেম উদ্দিন সিকদার জানান, রুহুল আমিনের রক্ত সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করে রক্তে ইবোলা ভাইরাসের কোন জীবানু পাওয়া যায়নি।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগের ডিউটি অফিসার এস.আই শাখাওয়াত হোসেন মোবাইল ফোনে সাংবাদিকদের জানান, পত্রিকার সংবাদ দেখে লাইবেরিয়া থেকে আগতদের ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। তারা আসার পর বিমান বন্দরে তাদের শারিরিক পরীক্ষা সম্পন্ন করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
লাইবেরিয়া থেকে আগত রুহুল আমিন আরো জানান, ইবোলা ভাইরাসের ভয়ে তারা দীর্ঘদিন থেকে দেশে আসার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু লাইবেরিয়ার সাথে অন্য দেশের বিমান যোগাযোগ বন্ধ থাকায় তারা দেশে আসতে পারেননি। বহু কষ্টে গত ৪ অক্টোবর তারা ৪ জন লাইবেরিয়া থেকে বিমানে মরক্কো যান। সেখান থেকে আলজেরিয়া হয়ে দোহায় গিয়ে কাতার কিউ-৬৩৪ নম্বর বিমানে গত বৃহস্পতিবার সকাল ৫টা ৩০ মিনিটে তারা ঢাকায় পৌঁছেছেন। তবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ইবোলা ভাইরাস সনাক্ত করণের জন্য আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের শারিরিক পরীক্ষার জন্য সরকারি ভাবে মেডিকেল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেখানে তাদের কারো ডাক্তারী পরীক্ষা হয়নি।
সূত্রমতে, লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিয়নে বাংলাদেশের এনজিও ব্র্যাক ২০০৬ সাল থেকে কৃষি, স্বাস্থ্য ও ঋণদান কর্মসূচী শুরু করেছিলো। গত দু’মাস পূর্বে ওইসব দেশে ইবোলা ভাইরাসে অসংখ্য লোক মারা যায়। এতে প্রানভয়ে লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিয়নে ব্র্যাকে কর্মরত বাংলাদেশের ৬৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেশে ফিরে আসেন।
লাইবেরিয়া থেকে আসা ও ব্র্যাকের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (পশু সম্পদ) মোঃ রাজিবুল কাদের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিয়নে ইবোলা ভাইরাস ভয়াবহ আকার ধারন করায় সেখানকার সরকার জরুরী অবস্থা জারী করেন। এতে আমরা বিপাকে পড়ে যাই। পরবর্তীতে আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্য ব্র্যাক উদ্যোগ গ্রহন করে। অতঃপর গত ১৮ আগস্ট ঘানা হয়ে বিশেষভাবে ভাড়া করা তার্কি এয়ারে আমিসহ ২২ জন ও ২১ আগস্ট তার্কির অপর একটি বিমানে ৬ জন ব্র্যাকের-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাইবেরিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসি। একই সময় সিয়েরালিয়ন থেকে সেখানে কর্মরত ব্র্যাকের আরো ৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাংলাদেশে চলে এসেছেন। তবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে তাদের কারোই ডাক্তারী পরীক্ষা সম্পন্ন হয়নি বলেও তিনি উলেস্নখ করেন।
একইভাবে গত ২৮ আগস্ট কাতার এয়ারে বাংলাদেশে এসেছেন লাইবেরিয়ায় কর্মরত থাকা শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার ভোজেস্বর গ্রামের আক্তারুজ্জামান (৪০)। একই বিমানে লাইবেরিয়া থেকে তার সাথে এসেছেন আরো ৩২ জন বাংলাদেশী। ঢাকা বিমান বন্দরে তাদের কারোরই ডাক্তারী পরীক্ষা হয়নি।
জানা গেছে, লাইবেরিয়ার বিভিন্নস্থানে প্রায় দু’শতাধিক বাংলাদেশী কর্মরত রয়েছেন। এরমধ্যে গৌরনদী ও কালকিনি এলাকার রয়েছেন ১২ জন। গত দু’মাস পূর্বে আফ্রিকার লাইবেরিয়া, সিয়েরালিয়নসহ বেশ কয়েকটি দেশে ইবোলা ভাইরাস দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এর দেয়া তথ্য মতে, ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ যাবত ৪ হাজার ৩৩ জন লোক মারা গেছেন।
এরমধ্যে লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিয়নে মারাগেছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ। লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিয়নে রোগটি মহামারি আকার ধারন করায় দেশ দুইটির সরকার গত আগস্ট মাসের প্রথমার্ধে শতর্ক অবস্থা জারী করে। ওইসব দেশের সাথে সারা বিশ্বের বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে বিপাকে পরেন বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিকেরা। তাদের কাজকর্ম বন্ধ থাকায় খাদ্যের অভাবে তারা বাসায় বন্দি জীবন-যাপন করছেন। প্রাণের ভয়ে তারা বাহিরেও বের হতে পারছেন না, দেশেও ফিরতে পারছেন না। এ কারণে তাদের স্বজনেরা রয়েছেন মহাদুশ্চিন্তায়।