ঢাকায় কেন এত আফ্রিকান

Africanরাশেদ মেহেদী: ঢাকার রাস্তায় আফ্রিকান নাগরিকরা এখন বেশ চেনা মুখ। রাস্তায়, যানবাহনে, মার্কেটে সন্তানসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে আফ্রিকান নাগরিকদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরা এবং খিলক্ষেত এলাকায় অসংখ্য আফ্রিকান নাগরিক বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। কিন্তু কেন তারা এ দেশে, কী কাজে এসেছেন, কী কাজ করছেন- এমন প্রশ্ন সাধারণের মনে।
পুলিশের বিশেষ শাখার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার বিদেশি নাগরিক বর্তমানে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বাস করছেন, যাদের বেশিরভাগই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আফ্রিকান নাগরিকদের বেশিরভাগই বাংলাদেশে এসেছেন ভ্রমণ ভিসায়। পরে ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও নানা ফাঁকফোকর গলিয়ে থেকে যাচ্ছেন। অনেকে এসেছেন বিভিন্ন ক্লাবে ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ভুয়া তথ্য দিয়ে। বাস্তবে খেলোয়াড় হিসেবে নয়, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মিশন নিয়ে নাইজেরিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, ঘানা, সুদান, উগান্ডা, তানজানিয়া, ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া প্রভৃতি দেশের নাগরিকরা এ দেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন। চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, এমনকি খুনের মতো গুরুতর অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে।
মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ২৮ জন আফ্রিকান নাগরিক গ্রেফতার হয়েছেন গত দুই বছরে। সর্বশেষ অবৈধভাবে বসবাসকারী আলজেরীয় নাগরিক আবু ওবায়েদ কাদেরের হাতে স্কুলছাত্র জুবায়ের খুনের মর্মান্তিক ঘটনায় ক্ষুব্ধ জনগণ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ভিসা পাওয়ার শর্ত হিসেবে পর্যটক, খেলোয়াড়, কোনো সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ কিংবা স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার কর্মী হিসেবে তথ্য দেওয়া হয়। এসব তথ্য যাচাই করা অনেক সময়ই দুরূহ হয়ে পড়ে। আফ্রিকার দেশগুলো থেকে বাংলাদেশি ভিসা ইস্যুর পরিমাণ গত চার-পাঁচ বছরে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৩ সালেই প্রায় চার হাজার ভিসা ইস্যু করা হয় আফ্রিকার তিনটি দেশ থেকে। দূতাবাসের একশ্রেণীর কর্মকর্তা অবৈধ সুবিধা নিয়ে ভিসা ইস্যু করছেন, এমন অভিযোগও রয়েছে। তবে বাংলাদেশে প্রবেশের পর ভিসার মেয়াদের অতিরিক্ত সময় অবস্থান করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের।
পুলিশ অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার কথা বললেও বাস্তবে তেমন কোনো অভিযান হচ্ছে না। অবশ্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সমকালকে বলেন, পুলিশ এ ব্যাপারে তৎপর রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে বসবাস কিংবা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য গ্রেফতার হয়েছে। এ বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে, প্রয়োজনে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলেও তিনি জানান।
আফ্রিকান নাগরিকরা যেভাবে দেশে থেকে যাচ্ছেন: সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আফ্রিকান নাগরিকরা এ দেশে পর্যটক এবং খেলোয়াড় হওয়ার তথ্য দিয়ে ভিসা পাচ্ছেন বেশি। আফ্রিকানরা এও জানে, বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে এসব তথ্য খুব বেশি যাচাই-বাছাই করা হয় না কিংবা কর্মকর্তাদের খুশি করে সহজে ভিসা পাওয়া সম্ভব। ভিসার মেয়াদ পার হলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে এ দেশে থাকতে খুব বেগ পেতে হয় না। এ কারণে যত আফ্রিকান নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, তার প্রায় ৬০ শতাংশই থেকে যান। কিছু কৌশলে ভারতে চলে যান। বাকিরা এ দেশে চোরাচালান, জাল টাকা তৈরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। কিছু আছেন, যারা এ দেশে গার্মেন্ট শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানায় গোপনে কাজ জুটিয়ে নেন। আশুলিয়া এলাকায় বেশ কিছু কারখানায় আফ্রিকান নাগরিকরা এভাবে কাজ করছেন। দেখা যায় উত্তরা এবং খিলক্ষেত এলাকায় আফ্রিকান নাগরিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। খিলক্ষেতের লেকসিটি এলাকায় শতাধিক আফ্রিকান নাগরিক বাসা ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাস করছেন।
স্থানীয়রা জানান, এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একাধিক শিশুসহ আফ্রিকান পরিবারও এ এলাকায় বেশি। আফ্রিকান নাগরিকদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি ভাড়া পাওয়া যায় বলে ফ্ল্যাট মালিকরা তাদের ভাড়া দিতেও আগ্রহী। তবে বিদেশি নাগরিকদের ভাড়া দেওয়ার জন্য যেসব নিয়ম-কানুন আছে, তা মানা হচ্ছে না। কাউকে বাসা ভাড়া দেওয়ার আগে তার পাসপোর্টে ভিসার মেয়াদ এবং ভিসা সঠিক কি-না, তা যাচাই করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একই সঙ্গে অবশ্যই যে বিদেশি নাগরিককে বাসা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, তার পাসপোর্ট নম্বর, নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য স্থানীয় থানায় জমা দেওয়ারও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব নাগরিকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা এবং সময়ে সময়ে তথ্য যাচাই করাও বিধি অনুযায়ী পুলিশের দায়িত্ব। খোদ পুলিশের তথ্যেই প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার বিদেশি নাগরিকের অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানের হিসাব থেকে প্রশ্ন ওঠে, স্থানীয় থানাগুলো বিদেশি নাগরিকদের নিয়মিত তথ্য যাচাই করছে কি-না।
খিলক্ষেত ও উত্তরা এলাকার বাইরে বেশ কিছুসংখ্যক আফ্রিকান নাগরিক বাস করছেন বনানী এলাকায়। কিছুদিন আগেও বনানী মাঠে সকালে দল বেঁধে আফ্রিকান নাগরিকদের নিয়মিত ফুটবল খেলতে দেখা যেত। তবে বর্তমানে হঠাৎ করেই বনানী এলাকায় তাদের বিচরণ কমে গেছে বলে স্থানীয়রা জানান।
নানা অপরাধে জড়িত তারা: আফ্রিকানরা মূলত চোরাচালান ও জাল নোট তৈরির সঙ্গে জড়িত। চলতি বছরের জানুয়ারি ও মার্চ মাসে পাঁচ আফ্রিকান নাগরিক বিপুলসংখ্যক জাল মার্কিন ডলারসহ ধরা পড়েন। গত বছর হেরোইন, জাল ডলারসহ আরও চারজনের ধরা পড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। গত দু’বছরে সব মিলিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ২৮ জন গ্রেফতার হন। তবে ভিসার মেয়াদের অতিরিক্ত সময় থাকার জন্য গ্রেফতারের কোনো তথ্য নেই। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন অপরাধে বাংলাদেশের জেলে আট শতাধিক বিদেশি নাগরিক অবস্থান করছেন। এর বাইরে কিছু আছেন, যারা গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে লাপাত্তা। এদের সংখ্যা প্রায় ৪০০।
পুলিশের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘনঘন স্থান পরিবর্তনের কারণে বেআইনিভাবে অবস্থানরত আফ্রিকান নাগরিকদের ধরা যাচ্ছে না। সর্বশেষ ৪ অক্টোবর উত্তরায় আলজেরীয় নাগরিক আবু ওবায়েদ কাদেরের হাতে নির্মমভাবে খুন হয় স্কুলছাত্র জুবায়ের আহমেদ। পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর কাদের জানায়, সমকামে ব্যর্থ হয়েই সে খুন করেছে জুবায়েরকে। তার কাছে বৈধ পাসপোর্টও পায়নি পুলিশ। পুলিশ সূত্র জানায়, প্রায় ১০ বছর ধরে পাসপোর্ট ছাড়াই আলজেরীয় নাগরিক কাদের তথাকথিত ফুটবল কোচের পরিচয়ে বসবাস করছেন ঢাকায়। গত দুই বছরে প্রায় তিন হাজার আফ্রিকান নাগরিকের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন নাকচ করে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। গত দু’বছরে কমপক্ষে ২৫ জনকে বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, আফ্রিকান নাগরিকদের বাইরে এশিয়ার ফিলিপাইনের বেশ কিছুসংখ্যক নাগরিকও এ দেশে অবৈধভাবে বাস করছেন। তাদের প্রায় সবাই অভিজাত এলাকায় প্রভাবশালীদের তত্ত্বাবধানে আছেন। এ কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button