ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ভোটে চাপে পড়বে ইসরাইল
ফিলিস্তিনীদের পক্ষে সমর্থন করে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভোট দিলো চলতি সপ্তাহে। ঘটনায় বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম তেমন উৎসাহ দেখায়নি। কিছু সংবাদপত্র উল্লেখ করতে ভোলেনি যে, বহু সদস্য সংসদে হাজিরই হননি। পাশাপাশি বহু সংবাদপত্রকে ঘটনার বিস্তৃত বর্ণনা পেশ করতেও দেখা যায়।
ঘটনার একদিন আগে ৩৬৩ জন ইহুদি নাগরিক প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টকে আহ্বান জানান। তারা চান ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রকে যেন স্বীকৃতি দেয়। এই ইহুদি নাগরিকদের মধ্যে ছিলেন একজন নোবেল বিজয়ী, একজন সর্বোচ্চ ইসরাইলী বেসরমারিক খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তি, দু’জন সাবেক কেবিনেট মন্ত্রী, চারজন সাবেক নেসেট সদস্য, বহু কূটনীতিক ও একজন জেনারেল।
ইসরাইলী সরকারের জন্য নিঃসন্দেহে এটি ছিল খুব খারাপ খবর। কিন্তু ইসরাইলীদের জন্য এর চেয়েও অপ্রত্যাশিত আঘাতটি আসে মিসরের পক্ষ থেকে। মধ্যপন্থী আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনী প্রশ্নে ইসরাইলকে সমর্থন জানাবে ইসরাইলী নেতৃত্বের এই প্রত্যাশার ঘোর বিরোধিতা প্রকাশ পায় মিসরীয় প্রেসিডেন্টের বিবৃতিতে। খুব তীক্ষ শব্দে নেতানিয়াহুর নিন্দা করেন আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসি।
সিসি বলেন, ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিসম্পর্ক স্থাপন না করা পর্যন্ত কোনো আরব দেশ ইসরাইলের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না। নেতানিয়াহু এতদিন জোর প্রচার চালিয়ে বিশ্বাস জন্মাতে চেয়েছিলেন যে, কিছু আরব দেশ ইসরাইলকে উন্মুক্ত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ও দিয়ে যাবে।
দক্ষিণ আমেরিকায় ইসরাইলের বিপক্ষে শক্তিশালী জনমত গড়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত হচ্ছে বহু দেশ। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ইসরাইলী সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে রীতিমতো দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিতে শুরু করেছে।
ইসরাইল প্রশ্নে চিন্তার পরিবর্তন বিশ্বের কূটনীতিক মহলে তের দিন আগে থেকেই ঘটতে শুরু করেছে। ইসরাইলী পররাষ্ট্র দফতরের নৈতিক সততা প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করেছে বহুদিন আগে থেকেই। বিশ্বের কূটনীতিকম-লী যে ইসরাইলের এভিগডর লীবারম্যান পরিগণিত হচ্ছেন একজন অর্ধ-ফ্যাসিবাদী হিসেবে। বিশ্বের কূটনীতিকরা মুখে কিছু বলছেন না বটে। কিন্তু লীবারম্যানের ক্রুর সহিংসতা খুব ঘনিষ্ঠ চোখে তারা দেখে যাচ্ছেন এবং রীতিমতো উৎকণ্ঠিত রয়েছেন। কোনো সঙ্গত কারণ ছাড়াই গাজায় ইসরাইলী যুদ্ধের বর্বরতা-নৃশংসতায় তারা বাকরুদ্ধ না হয়ে পারছেন না। দেড় মাস ধরে গাজায় নৃশংস হামলা চালিয়ে গেলো ইসরাইল। বিশ্ববাসীকে চেয়ে চেয়ে দেখতে হলো হাজার হাজার নির্দোষ-অসহায় ফিলিস্তিনীর মৃত্যু। শিশুদের মৃত্যু ও পঙ্গু হওয়ার দৃশ্য তারা দেখলেন। মায়েদের আর্তনাদ তারা শুনলেন। ঘরবাড়ি, হাসপাতাল ও স্কুল গুঁড়িয়ে পড়ার দৃশ্য তাদের দেখতে হলো। কিভাবে দিশেহারা গৃহহীন উদ্বাস্তুর দল আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলেছে- তাও তারা দেখলেন। তারা আরও দেখলেন আয়রন ডোমের কল্যাণে কোনো একটি ইহুদি এপার্টমেন্টেরও কোনো ক্ষতি হয়নি। একজন ইহুদিও মারা যায়নি। ইসরাইলী বর্বরতায় ফিলিস্তিনী জনজীবনে নেমে আসা বীভৎস নারকীয় দুর্দশা- স্টকহোম, সিয়াটল বা সিঙ্গাপুর- সর্বত্রই প্রতিটি শান্তিপিয়াসী মানুষের বিবেককে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। ইসরাইলের পৈশাচিক স্বরূপ বিশ্বের সামনে আধুনিক গণমাধ্যমের কল্যাণে আজ আগের তুলনায় অনেক বেশি সুস্পষ্ট।
দিন বদলেছে। তথ্যপ্রবাহ প্রক্রিয়ায় রূপান্তর ঘটে গেছে- ইসরাইল এখনও মানতে পারছে না। মানতে না পারার পেছনে কিছু পরাশক্তির প্রশ্রয়ও রয়েছে নিঃসন্দেহে। নিজেদের প্রচারণা-কৌশলকে আজও নিশ্চিদ্র ভেবে বসে আছে ইসরাইল। তারা বলতে চাচ্ছে, গাজায় কিন্ডারগার্টেন, স্কুল, হসপিটাল ও মসজিদগুলোয় তাদের কামান, যুদ্ধবিমান, ড্রোন ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে তারা হামলা চালিয়েছে এই জন্য যে, ঐসব স্থান থেকে ইসরাইলে রকেট নিক্ষেপের মাধ্যমে হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলীদের সতত সন্ত্রস্ত্র করে রেখেছিল। অথচ যুদ্ধ পরবর্তীতে গাজা সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন স্পষ্ট শব্দে জানিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি- গাজায় ইসরাইলী আগ্রাসন কোনো মানদন্ডেই সমর্থনযোগ্য ছিল না।
হামাস বা ফিলিস্তিন বিরোধী ইসরাইলী যুদ্ধের বিশ্বজনমত ক্রমশ: বিপক্ষে চলে যেতে শুরু করলেও দেশের অভ্যন্তরীণ ইহুদি জনগণ আজও ইসরাইলী যুদ্ধংদেহী ভূমিকার সমর্থন করে যাচ্ছে দেখে আত্মসন্তুষ্টিতে আচ্ছন্ন দেখা যাচ্ছে ইসরাইল সরকারকে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রস্তাব এই ভ্রান্তি বিলাসে মগ্ন ইসরাইলের সরকারের সম্বিত ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে। বাধ্যতামূলক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রস্তাবটি না হলেও প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে বিশ্বজনমতের প্রতিফলন ঘটেছে অস্বীকার করা যাবে না। প্রস্তাবের অনুসরণে ইসরাইলে অস্ত্র বিক্রয় ব্রিটিশ সরকার এরপর যদি বন্ধ করে দেয়, তাহলে তা তাজ্জবের কোনো ঘটনা হবে না। নিরাপত্তা পরিষদ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরাইলকে সর্বক্ষেত্রে সমর্থন দান প্রশ্নে এরপর যদি কোনো পরিবর্তিত অবস্থান গ্রহণ করে, তাহলে তাও অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা হবে না বলা যায়। প্রসঙ্গত টমাস জেফারসনের উক্তিটি উদ্ধৃত হওয়া বাঞ্ছনীয়। দেশের জনগণ যে পথে এগোতে চায়, সরকারকেও ঐ পথই ধরতে হয়। নীতিবোধ তাড়িত জনমত কোনো সরকার উপেক্ষা করে যেতে পারে না। -আরব নিউজ