বাংলাদেশে যেভাবে ব্যাংক ডাকাতি হয়
তাহমিমা আনাম: বাংলাদেশে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যাংক ডাকাতির হিড়িক পড়েছে। এসব ডাকাত বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটে নিচ্ছে। তবে তাদের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে আরেক শ্রেণির লোকজন। তারা এ কাজ করছে, ব্যাংকেরই প্রশ্রয়ে, প্রকাশ্য দিবালোকে। তাদেরকেই প্রতিরোধ করার দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে। শুক্রবার প্রভাবশালী নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতামত পাতায় এ কথাই বলা হয়েছে। তাহমিমা আনাম ‘ বাংলাদেশে যেভাবে ব্যাংক ডাকাতি হয়’ শিরোনামে লেখাটি প্রকাশ করেছেন।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশে হুজুগে অনেক কিছু চলে। ১৯৯০-এর দশকে স্যাটেলাইট টেলিভিশন, ২০০০-এর দশকে শপিং মল ও হাই-রাইজ ভবন। এখন হচ্ছে হলিউড স্টাইলে ব্যাংক ডাকাতি। গত জানুয়ারিতে কিশোরগঞ্জে সোহেল ও তার সঙ্গী ইদ্রিস মুন্সী সুড়ঙ্ক খুঁড়ে একটি ব্যাংক থেকে ১৬৯ মিলিয়ন টাকা হাতিয়ে নেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এই ঘটনাকে ‘দ্য ব্যাংক জব’-এর মতো হলিউড মুভির সাথে তুলনা করতে থাকে।
ইদ্রিস মুন্সী একটি ধারা সূচনা করেছেন বলেই পরবর্তী ঘটনাবলীতে দেখা যায়। মার্চে বগুড়ায় সোনালী ব্যাংকের আদমদিঘি শাখা থেকে ৩০ লাখ টাকা চুরি করেন। এখানেও সুড়ঙ্গ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয়। সুড়ঙ্গটি এখানে খোঁড়া হয়েছিল একটি ফার্নিচারের দোকানের নিচ থেকে। আর গত মাসে দুর্বৃত্তরা জয়পুরহাটে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা থেকে দুই কোটি টাকা চুরি করে। দুর্বৃত্তরা এই অপকর্মটি করার জন্য ব্যাংকটির পাশেই একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল।
তবে ইদ্রিস মুন্সীরা হলিউড স্টাইলে ডাকাতি করলেও আসল ব্যাংক ডাকাত কিন্তু তারা নয়। তাদের চেয়ে অনেক বড় চোর রয়েছে এবং তাদের সহজেই চেনা যায়। ব্যাংকগুলোই তাদের সুবিধা করে দিয়েছে। তারা হলেন ঋণ খেলাফি। এসব লোক এবং ব্যবসায়ী ব্যাংকগুলো থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, তবে ফেরত দেয়ার কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যেভাবে গঠিত হয়েছে, তার মধ্যেই এই সমস্যার বীজ লুকিয়ে আছে। বাংলাদেশে দুই ধরনের ব্যাংক রয়েছে : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে পরিচালিত বেসরকারি ব্যাংক, এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, দুই থেকে তিন শতাংশ ঋণ গ্রহণকারী খেলাপি হতে পারে। বাংলাদেশে তা ১২ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখেছে, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে ঋণ অনাদায়ীর হার প্রায় ২৯ শতাংশ।
পরিস্থিতি অবনতিই হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট-এ বলা হয়েছে, দুর্বল অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, অকিঞ্চিত করপোরেট নিয়ন্ত্রণ এবং ঋণ প্রদানের মানদণ্ড অনুসরণ না করার ফলে ঋণ অনুমোদনে অনিয়মের সৃষ্টি হয়। এতে করে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ৫০ কোটি ডলারেরও বেশি ঋণকে অনাদায়ী হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করতে হয়। গত ছয় বছরে চারটি প্রধান রাষ্ট্রীয় ব্যাংককে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে ২.৪৫ বিলিয়ন ডলারে করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে কিন্তু আগেই শ্রেণিভুক্ত করে রাখা ২ বিলিয়ন ডলার ধরা হয়নি।
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে বিপুল পরিমাণ মুলধন সরিয়ে নেয়া হচ্ছে, আর ব্যাংকগুলোকে এর ফলে সুদের হার উচ্চ রেখে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদ হার ৯ থেকে ১৬ শতাংশ। আমানতকারীরা পায় ৬ থেকে ১২ শতাংশ হারে।
ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যানের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার। তাকে শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপির তালিকায় রাখা হয়েছে। ব্যাংক কিছু কুঋণ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেটা বলা যায় ব্যর্থ হয়েছে। মামলাজটের কারণে আইনগতভাবেও অগ্রগতি হচ্ছে সামান্য। বর্তমানে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে আট লাখ মামলা রয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এই ভঙ্গুর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের একমাত্র পন্থা হতে পারে সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে পুরোপুরি একক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে এগুলোকে প্রদান করা। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হলে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রত্যক্ষভাবে দায়বদ্ধ থাকলে দুর্নীতিমূলক ব্যবস্থার সৃষ্টি হতে বাধ্য।
সুড়ঙ্গ খুঁেড় ডাকাতি বন্ধ করতে ব্যাংকগুলোকে আরো সুরক্ষিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে যারা প্রকাশ্যে দিবালোকে ব্যাংকগুলোতে হানা দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, তাদের প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।