সামাজিক সূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ
সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) বেশ কিছু সূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি পাকিস্তানও বাংলাদেশের পেছনে আছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, জন্মহার, উন্নত পয়োনিষ্কাশন সুবিধাসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে এই দুটি দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি বেশ ভালো। সামগ্রিকভাবে এসব সামাজিক খাতের সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আর প্রথম স্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা।
‘সার্কউন্নয়নলক্ষ্যসমূহ: বাংলাদেশ প্রতিবেদন ২০১৩’ গতকাল রোববার প্রকাশ করে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। এই প্রতিবেদনে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতির চিত্রটি উঠে আসে। প্রতিবেদনটি ২০১১ সালের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তৈরি। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে পরিকল্পনা কমিশনে আলোচনা সভার আয়োজন হয়।
২০০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্কের ১৩তম শীর্ষ সম্মেলনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন লক্ষ্য ঠিক করা হয়। মূলত দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ—এই চারটি ক্ষেত্রে ২২টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়; যা সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্য নামে পরিচিত।
বাংলাদেশেরঅর্জন: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে বিগত দুই দশকে ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে। ১৯৯১-৯২ অর্থছরে এ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। ২০১০ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, দারিদ্র্যের হার নেমে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে। এ সময়ে চরম দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে নেমে হয়েছে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০১১তে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু বেড়েছে ১০ বছর। ২০১১ সালে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু হয় ৬৯ বছর। বর্তমানে সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি, যা ৭৫ বছর। আর ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের গড় আয়ু ৬৫ বছর।
শিশু বা নবজাতক মৃত্যুর হার হ্রাসে বাংলাদেশ বিগত দুই দশকে ব্যাপক অগ্রগতি দেখিয়েছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার নবজাতকের মধ্যে ৯৭ জনই মারা যেত। এখন তা কমে ৩৭ জনে নেমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সফল শ্রীলঙ্কা। আলোচ্য সময়ে শ্রীলঙ্কা নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১১ জনে নামিয়ে এনেছে। তবে ভারতে নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৪৭। পাকিস্তানে এ হার ৫৯। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রেও শ্রীলঙ্কার পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৪৬ জন শিশু মারা যায়; যা ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় অনেক কম।
মাতৃমৃত্যুর হার কমানোয় বাংলাদেশ বিগত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। দুই দশক আগে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি এক লাখে ৮০০ জন বাংলাদেশি নারী মৃত্যুবরণ করতেন। ২০১১ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২০০ জনে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম মাতৃমৃত্যুর হার শ্রীলঙ্কায়, প্রতি লাখে মাত্র ৩৫ জন। ভারতে এ সংখ্যা ২০০। তবে মাতৃমৃত্যু হ্রাসে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে গতি তুলনামূলক ভালো।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও বাংলাদেশ ভালো করছে। সবচেয়ে ভালো করছে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কায় একজন নারীর গড়ে ২ দশমিক ৩টি সন্তান রয়েছে। বাংলাদেশে এই গড় ২ দশমিক ৫ শতাংশ, ভারতে ২ দশমিক ৬, পাকিস্তানে ৩ দশমিক ৪।
উন্নত ও আধুনিক স্যানিটিশন-ব্যবস্থায়ও সবচেয়ে এগিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা। দেশটির ৯২ শতাংশই আধুনিক পয়োনিষ্কাশন সুবিধা পায়। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ৫৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী এ সুবিধা পায়। ভারতের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর কাছে এ সুবিধা পৌঁছেছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশসহ অন্য খাতে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারত, পাকিস্তান, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে নেপাল। ২০১১ সালের হিসাবে, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি এক হাজার ৫৬৯ ডলার, যা বিগত দুই দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। অন্যদিকে মাথাপিছু জিডিপি ভুটানে পাঁচ হাজার ১৬২ ডলার, শ্রীলঙ্কায় চার হাজার ৯৪২ ডলার, ভারতে তিন হাজার ২০৩ ডলার, পাকিস্তানে দুই হাজার ৪২৪ ডলার ও নেপালে এক হাজার ১০৬ ডলার। এ হিসাবটি ডলারের পিপিপি মানে বা পিপিপি ডলারে নির্ণয় করা হয়েছে। তবে পুরো প্রতিবেদনে মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানকে বিবেচনায় আনা হয়নি।
শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির তাগিদ: প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানের বক্তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বিনিয়োগের তাগিদ দেন। সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভালো থাকবে বলে তাঁরা মনে করেন।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এতে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ১:৫৩, যা মোটেই কাম্য নয়।
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মনে করেন, গত ছয় বছর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিকভাবে এগোচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়নের সময় এটা গুরুত্ব দিয়ে থাকি, যাতে করে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি জ্ঞাননির্ভর সমাজব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে।’
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘সরকার দেশের উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম এবং উপকূলীয় অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রমে উত্তরোত্তর বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে। আমাদের দেখতে হবে প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে সঠিক মাত্রায় বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে কি না।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে গিয়ে অন্য দেশের প্রতি সামরিক খাতে ব্যয় কমানোর আহ্বান জানান। অথচ বাংলাদেশে সামরিক খাতে প্রতিবছর ব্যয় বাড়ছে, কিন্তু শিক্ষা খাতে বাড়ছে না। তিনি শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দেন।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামসহ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।