রানির অতিথি বাংলাদেশের মামুন
উজ্জ্বল দাশ: এক বাংলাদেশির সহায়তায় কীভাবে নতুন মাত্রা পেল ব্রিটিশ ঐতিহ্য? কীভাবে তিনি পেলেন ব্রিটেনের রানির সাক্ষাৎ? পড়ুন বাংলাদেশের মামুন চৌধুরীর সাফল্যের গল্প।
রানির বাড়ি বাকিংহাম প্যালেস, রোজ যেখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। আর রাজসিক কোনো উপলক্ষ থাকলে তো নিমেষেই এলাকা লোকারণ্য! লন্ডন বেড়াতে আসা নতুন কেউ সাধারণত রাজপ্রাসাদ না দেখে ফেরেন না। দূর থেকে প্রাসাদ দেখা, ছবি তোলা—এই তো। সাধ থাকলেই কি আর ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে একদণ্ড কথা বলা যায়! এই বিরল সুযোগই পেয়েছেন আমাদের মামুন চৌধুরী। তবে কেবল দেখা করার সুযোগ নয়। রানির কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন সম্মাননাও। ব্যবসায়িক সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটেনের মর্যাদাপূর্ণ কুইন’স অ্যাওয়ার্ড জিতেছে মামুনের পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান লন্ডন ট্র্যাডিশন। বিবিসি থেকে গার্ডিয়ান—বিলেতের সব নামকরা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে মামুনের সাফল্যের গল্প।
কিন্তু মামুন কীভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে গেলেন এই উচ্চতায়? সেদিন লন্ডনে তাঁর কারখানায় বসে মামুন শোনাচ্ছিলেন সাফল্যের পেছনের সেই গল্পই।
যেভাবে লন্ডনে
সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের গ্রাম ময়নাবাদে তাঁর জন্ম। ১৯৮৫ সালে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদি আরবে পাড়ি জমান মামুন। কিছুদিন না যেতেই মামুন মনস্থির করলেন, দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে অন্যের জন্য খাটার চেয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য কিছু করা উচিত। শুরুও করেছিলেন সেভাবেই। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হলো উপসাগরীয় যুদ্ধ; লন্ডভন্ড হলো মামুনের যাবতীয় পরিকল্পনা। এমন দুর্দিনেও তিনি হাল ছাড়েননি। কয়েক মাস অপেক্ষা করে তিনি জেদ্দায় চলে আসেন। পরিচিতজনদের পরামর্শে আমেরিকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছুদিনের জন্য যুক্তরাজ্যে এলেন মামুন, কিন্তু যাওয়া আর হলো না। মামুন বলছিলেন সে সময়ের গল্প।
‘তখন সদ্য বিয়ে করেছি। নতুন সংসার। জীবিকার তাগিদে কাজ নিলাম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। কিন্তু এত টানাপোড়েনের মধ্যেও সম্ভাবনা খোঁজার চেষ্টা করতাম সব সময়। শুরুতে ভাবলাম বাংলাদেশের তৈরি পোশাক লন্ডনের মার্কেটে চালু করা যায় কি না। বহু জায়গায় চেষ্টাচরিত্র চলল। কিন্তু ফলাফল শূন্য।’
বিদেশে এক বাংলাদেশির ‘ব্রিটিশত্ব’ অভিযানতারপর? ১৯৯৪ সালে মামুন শুরু করলেন ‘লন্ডন ক্লথিং লিমিটেড’ নামে নিজের ব্যবসা। বাইরের দেশগুলো থেকে পোশাক কারখানার মালামাল নিয়ে এসে ইংল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করতেন। বছর কয়েক চেষ্টা চলল, কিন্তু সাফল্য অধরা থেকে গেল সেবারও।
মামুন বলছিলেন, ‘২০০২ সালে দীর্ঘদিনের বন্ধু রব হিউসনকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করি লন্ডন ট্র্যাডিশনের কাজ। হাতে গোনা কয়েকটি প্রোডাক্ট নিয়েই মার্কেটে এসেছিলাম আমরা। একসময় ইউকের পাশাপাশি ফ্রান্সের বাজারেও প্রোডাক্ট পাঠানো শুরু করি। ২০০৪ সালে তরুণদের কথা মাথায় রেখে ওভার সাইজ ডাফল কোটের (ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী পোশাক) রিডিজাইন করার কথা ভাবতে থাকি।’
শুরুতে বেশ কিছু নতুন ডিজাইন জাপানে বাজারজাত করেন। কিছুদিনের মধ্যেই ভালো সাড়া পেতে শুরু করলেন। যুক্তরাজ্যের বাইরেই মূলত লন্ডন ট্র্যাডিশনের বাজার। যুক্তরাজ্যের বাইরে জাপান, চীন, জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশে ব্যাপক জনপ্রিয় লন্ডন ট্র্যাডিশনের অভিজাত পোশাক।
রানির অতিথি
গত ১৪ জুলাই বাকিংহাম প্যালেসে কুইন’স অ্যাওয়ার্ড নেওয়ার সময় মামুন চৌধুরী মিনিট চারেক রানির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। রানি জেনে বিস্মিত হয়েছেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের ৯০ ভাগ পোশাক বহির্বিশ্বে রপ্তানি হচ্ছে।
তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে মামুন চৌধুরীর সংসার। সহধর্মিণী জাহানারা চৌধুরীর অসীম ধৈর্য আর অকৃত্রিম সহযোগিতা কথা মামুন চৌধুরীর কথায় উঠে আসছিল বারবার।
পেরুতে নিযুক্ত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী বলেন, ‘ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের সাফল্যগাথায় নতুন পালক যুক্ত করলেন মামুন চৌধুরী।’
মামুন বলছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস ছিল, অভিজাত দুনিয়ায় লন্ডন ট্র্যাডিশন একদিন একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড হবে। হয়েছেও তাই।’
তবে শুধু ব্যবসায়িক সাফল্য নয়, মামুন এগিয়ে যেতে চান সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়েও। এ জন্যই তৈরি করেছেন লন্ডন ট্র্যাডিশন ফাউন্ডেশন। আর দেশের মানুষের প্রতি তাঁর টান বোঝা যাবে কারখানার জ্যেষ্ঠ কর্মী রজব আলীর কথা থেকেই।
রজব বলছিলেন, ‘৫০ বছর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করি, গার্মেন্টস ব্যবসায় মামুন ভাইয়ের মতো সাফল্য এখানে কেউ দেখাতে পারেননি। এখানে গার্মেন্টসে শ্রমিকের মজুরি নিয়ে টালবাহানা চলে না। আমাদের সকলের ঘামে আর শ্রমেই জয় করেছি কুইন’স অ্যাওয়ার্ড। বিবিসি টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিয়েছি। আমার গর্বের শেষ নেই।’