ফিলিস্তিনকে ব্রিটেনের স্বীকৃতি নিয়ে সংশয়
শুরু থেকেই ব্রিটেন জড়িয়ে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের অতি পুরনো ইসরাইল-ফিলিস্তিনী বিরোধ সংঘর্ষে। সত্য বলতে কি, ব্রিটেন বিরোধ শরিক না থাকলে সংঘাতের কোনো অবকাশ মধ্যপ্রাচ্যে জন্ম নিত না। সেই ব্রিটেনের হাউস অব কমন্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে ভোট দিল গত ১৩ অক্টোবর। ব্রিটেনের এই পরিবর্তিত ভূমিকার তাৎপর্য খুঁজতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিরোধের ধারাবাহিক পটভূমিটিকে আরেকবার পর্যালোচনার বিষয় বানিয়েছেন এক মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।
তিনি জানান, তার বাবা ১৯৩৬ সালে জন্ম দেন ইতিহাস প্রসিদ্ধ ফিলিস্তিনে এমন এক সময়ে, যখন বিশ্বজুড়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের জয়জয়কার। বায়েত দারাস নামের যে গ্রামটিতে তিনি জন্ম নেন ও বেড়ে ওঠেন, আজ সেটি ইসরাইলের অঙ্গীভূত। এলাকায় ইসরাইলী বসতি গড়ার শুরুর দিকেই ধ্বংস করা হয় গ্রামটিকে এবং সেস্থলেই গড়ে ওঠে ‘তাবিয়া’ নামের একটি ইহুদিকলোনি। পাশেই গড়ে তোলা হয় দুর্ভেদ্য দেয়ালঘেরা একটি বৃটিশ পুলিশ স্থাপনা। বিধ্বস্ত বায়েত দারাসে গড়ে ওঠা ইহুদি বসতির (তাবিয়া) সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছিল ঐ পুলিশী দুর্গের দায়িত্ব। ১৯৪৭-৪৮’র দিকে বৃটিশ সৈন্যরা ফিলিস্তিন থেকে সরে যেতে শুরু করে। বাইরে থেকে এস প্রতিস্থাপিত ইহুদিদের জন্য সেখানে তৈরি হয় নতুন রাষ্ট্র ইসরাইল। নিপীড়ন-নির্যাতন বাস্তুত্যাগ, সামরিক দখলদারি ও বেশুমার মৃত্যু, তখন থেকে ৬৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনীদের ললাট লিপিতে পরিণত রয়েছে।
গাজায় অতিসাম্প্রতিক ইসরাইলী আগ্রাসন স্মরণীয়। ২২শ’ ফিলিস্তিনী প্রাণ হারালেন, এর অধিকাংশ বেসামরিক লোক। জখম হন কতজন গোনাগুনতি নেই। কিন্তু ইসরাইলের ‘আকা’দের বিস্ময় ক্রমে বাড়ছে, এত ক্ষয়ক্ষতির মুখেও ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধস্পৃহা ও তৎপরতা হ্রাস না পেয়ে উত্তরোত্তর বেড়েই যাচ্ছে দেখে। ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষক-গোষ্ঠীর সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এমন একটি বিশ্বপরিম-লে ফিলিস্তিনের সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা গেল বৃটিশ পার্লামেন্টকে। প্রতীকী মেনে নিয়েও বৃটিশ পদক্ষেপকে তাৎপর্যপূর্ণ বলতে চান অনেকের মতো আমাদের এ বিশেষজ্ঞও। তিনি উল্লেখ করেন, ইসরাইলের যাবতীয় যুদ্ধাস্ত্রের প্রধান জোগানদার হচ্ছে বৃটেন। মধ্যপ্রাচ্যে বিরোধ মীমাংসা সম্পর্কিত এতকাল ধরে ব্যবহৃত তার ভাষা বৃটেন আজো পর্যন্ত বর্জন করেনি। সংলাপভিত্তিক সমস্যা সমাধানের কথা তার স্বীকৃতি-প্রস্তাবে বৃটেন শামিল রেখেছে।
অর্থাৎ আগ্রাসী ও আক্রান্ত বৃটেনের চোখে এখনো সমান মর্যাদার অধিকারী। দ্বিরাষ্ট্রিক মীমাংসার কথা বলেছে বৃটেন। অথচ সব ফিলিস্তিন ভূভাগজুড়ে ইহুদিবসতি যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেভাবে গড়ে তোলা হয়েছে এবং যে বসতিগুলো থেকে ইসরাইলী প্রত্যাহারে বৃটেনসহ ইসরাইলের অন্য মুরুব্বিদের পক্ষ থেকে কোনো অঙ্গীকারের ইঙ্গিত টুকুও নেই। তেমন অবস্থায় ফিলিস্তিনীদের একচ্ছত্র এ একক কোনো রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা কতটুকু?
বৃটিশরা ফিলিস্তিনে পা রাখে ১৯১৭ সালে তুরস্ককে পরাস্ত করার পর। ফিলিস্তিন ছিল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ। ১৯১৭ সালে জেরুসালেম এবং ১৯১৮ সালে অবশিষ্ট ফিলিস্তিন বৃটিশ দখলে চলে যাওয়ার পর থেকেই ফিলিস্তিনীরা পরিণত হয় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নকে। কতসংখ্যক ফিলিস্তিনীকে সেসময় থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত হত্যা করা হয়, জখম ও পঙ্গু করা হয়, নির্যাতিত করা হয়, বন্দি করা হয় ও নির্বাসনে পাঠানো হয়- সেই মর্মন্তুদ ইতিহাস আজো অজানা। ফিলিস্তিনীদের তাদের পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেস্থলে ইসরাইল রাষ্ট্র স্থাপনের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বৃটিশরা রচনা করে ১৯ শতকের শুরুর দিকেই।
১৯১৭ সালের বালসোর ডিক্লেয়ারেশনয়ের স্পর্ধিত শব্দাবলী একটু লক্ষ্য করুন। ঠিক হোক বেঠিক হোক, ভালো বা মন্দ যাই হোক, যুগযুগ পোষিত আমাদের ঐতিহ্য ও আস্থা অনুসরণে একটি ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ফিলিস্তিন ভূভাগে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে আমরা তার পরাশক্তি মনস্থ করেছি এবং আমরা এ-ও স্থির করেছি ফিলিস্তিনের ৭০ লাখ আরব বাসিন্দার অধিকার বা পছন্দ অপছন্দকে এ প্রশ্নে আমরা তোয়াক্কায় নেব না।
অবশ্য স্বীকার্য যে, ইসরাইলের নিরস্ত্রর যুদ্ধ-দৌহতা ও অবশিষ্ট ফিলিস্তিন ভূখ-ে ইসরাইলের পৌনপুনিক দখল সম্প্রসারণ তৎপরতায় অতিষ্ঠ বৃটিশ জনগণ এবং তাদের পাশাপাশি বহু বৃটিশ রাজনীতিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার তাদের উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যে সমস্যার নিষ্পত্তির ভিত্তিমূল খুঁজতে সচেষ্ট হয়েছেন। কিন্তু অতিবিলম্বিত এই বৃটিশ উদ্যোগের পরিণাম প্রশ্নে পর্যবেক্ষকদের মনে যে সন্দেহের উদ্রেগ ঘটেছে, তার প্রশমন হতে পারবে কি? হলে তা কীভাবে হবে? ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে গড়ে ওঠা বিপুলসংখ্যক ইহুদিবসতি প্রত্যাহারে অন্যান্য পরাশক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ইসরাইলকে বাধ্য করার জন্য বৃটেনও এগিয়ে আসতে উৎসাহী হবে কী? তা না হলে ইহুদিবসতিগুলোকে অজুহাত বানিয়ে ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে ইসরাইল যখন-তখন যুদ্ধে অগ্রসর হবে না- এ নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব থাকবে কার হাতে?
ইসরাইলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ৬৬ বছর ধরে বৃটিশ অর্থে অস্ত্রে ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিপূর্ণ হতে থেকেছে ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা বৃটেনের একান্তই যদি কাম্য হয়, তাহলে ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া বৃটেনের বন্ধ করতে হবে। ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে শত বছর ধরে যে নির্বিবেক ও নিষ্ঠুর অন্যায় বৃটিশ সংঘটন করে এসেছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র স্বীকার করে নেয়ার মধ্য দিয়েই তার অপনোদন ঘটে যেতে পারে না। বৃটেনের খোদ ইসরাইল সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিতে আপাদমস্তক সংশোদন সাধিত হতে হবে। বৃটেনকে প্রমাণ স্থাপন করে দেখাতে হবে, বালফোর সূচিন ঐতিহ্য পরিহার করে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে গঠিত দেখতে সে প্রকৃতই আগ্রহী ও আন্তরিক। আরব নিউজ।