লিবিয়া : গাদ্দাফি আমলে শীর্ষ ধনী, এখন ব্যর্থ রাষ্ট্র
১৯৬৭ সালে কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি লিবিয়ার ক্ষমতা দখলের সময় উত্তরাধিকার সূত্রে একটি গরীব দেশই পেয়েছিলেন। আর খুন হওয়ার সময় লিবিয়াকে রেখে যান আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী জাতি হিসেবে।
গাদ্দাফি মারা যাওয়ার সময় আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে মাথাপিছু আয় এবং জীবনমানের দিক দিয়ে লিবিয়া ছিল এক নম্বরে। এ দেশটিতে ইউরোপের অন্যতম উন্নত দেশ নেদারল্যান্ডসের চেয়েও কম মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করত।
২০১১ সালে ন্যাটোর হস্তক্ষেপের পর লিবিয়া এখন একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র। বিপর্যস্ত অবস্থায় পরিণত হয়েছে তার অর্থনীতি। সেখানে সত্যিকারের কোনো সরকার ব্যবস্থা নেই। যে যার মতো করে অধিকৃত জায়গা শাসন করছেন। আর তেল উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দেশ রুপ নিয়েছে কসাইখানায়।
লিবিয়াতে আগে থেকেই মিলিশিয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা ছিল। স্থানীয়, আঞ্চলিক, উপজাতিগত, ইসলামপন্থী ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সামাল দিয়ে গাদ্দাফি ভালোভাবেই দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু ন্যাটো হস্তক্ষেপের পর লিবিয়ায় দুটি যুদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে যাদের নিজস্ব প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্ট এবং সামরিক বাহিনী রয়েছে। সেখানে দুটি সরকার গঠিত হয়েছে। এদের এক পক্ষ ইসলামী মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সমন্বয়ে রাজধানী ত্রিপোলীসহ কয়েকটি শহর নিয়ে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে সরকার গঠন করেছে। এই সরকারের নির্বাচন হয়েছে গেল গ্রীষ্মে। অন্যদিকে, ইসলামী মিলিশিয়াদের বিরোধী পক্ষ দেশের পূর্বাঞ্চলে সরকার গঠন করেছে। লিবিয়ার বৈধ সরকার হিসেবেই এরাই কাজ করছে।
গাদ্দাফি প্রশাসনের পতনের পর লিবিয়ায় একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের দূতাবাস গুছিয়ে নিয়েছে। দেশের দক্ষিণ অঞ্চল পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্যে। আর উত্তরাঞ্চল হয়েছে মানবপাচারের সিল্করুট।
লিবিয়ার সাথে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে মিশর, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া। এসব কারণে বেড়েছে ধর্ষণ, খুন ও অত্যাচারের পরিমাণ, যা একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের ছবিকে ষ্পষ্ট করেছে।
গঠিত দুটি অকেজো সরকারের উপর বিরক্ত যুক্তরাষ্ট্র এখন তৃতীয় পক্ষকে সহায়তা করছে। এই তৃতীয় পক্ষের নেতৃত্বে আছেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর প্রশিক্ষিত জেনারেল খালিফা হিফতার। তিনি নিজেই নিজেকে লিবিয়ার নতুন একনায়ক ভাবেন।
১৯৮০ সালে গাদ্দাফির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হয় হিফতারের। তারপর থেকেই তিনি বসবাস করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায়। এর পাশেই রয়েছে সিআইএর মূল সদরদপ্তর এবং সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছে তিনি। মার্কিন সহায়তায় ১৯৯৬ সালে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিলেন হিফতার।
১৯৯১ সালে নিউইয়র্ক টাইমস তাদের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ‘জেনারেল হিফতিয়ার এবং অন্তত ৬০০ সৈন্যকে গেরিলাসহ সব ধরনের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সিআইএ। রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসনের সহায়তায় তারা দ্রুতই গাদ্দাফি সরকারকে উৎখাত করতে যাচ্ছে’।
হিফতারের বাহিনী দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজী দখল নিতে আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট আনসার আল-শরীয়াহ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
মজার ব্যাপার হলো, গাদ্দাফির বিপক্ষে ন্যাটোর অভিযানের সময় এই আনসার আল-শরিয়াহ গোষ্ঠীকে অস্ত্র দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আবার এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই দূতাবাসে হামলা চালিয়ে সাতজনকে হত্যার অভিযোগ তুলেছে আমেরিকা। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সাহায্য করা এবং তাদের নিয়ে খেলা করার আরও একটি মার্কিন উদাহরণ এটি।
নৈতিক এবং সামরিক মার্কিন সব ধরনের সাহায্যই এখন পাচ্ছেন হিফতার। কারণ অন্যদের চেয়ে তিনি বেশি সেকুল্যার এবং পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের জন্য বেশি খোলামেলা দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন।
ন্যাটোর চোখে গাদ্দাফির হয়তো বড় অপরাধ ছিল- তিনি বিদেশি বিনিয়োগের চেয়ে দেশীয় স্বার্থটা বেশি দেখতেন এবং একটি সত্যিকারের শক্তিশালী ইউনাইটেড আফ্রিকার স্বপ্ন দেখতেন। আর সেজন্যেই হয়তো ২০১১ সালে লিবিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩০ বিলিয়ন ডলার অর্থ জব্দ করেছিলেন বারাক ওবামা। এই অপ্রদর্শিত অর্থ গাদ্দাফি জমা রেখেছিলেন আফ্রিকান ‘আইএমএফ’ ও আফ্রিকান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য।
গাদ্দাফির রাখা জমা অর্থ নিয়ে পশ্চিমা আপত্তিতে পরিস্কারভাবেই লিবিয়ান জনগণের কোনো লাভে আসেনি ( সে সময় পুরো মহাদেশে লিবিয়ানরাই স্ট্যান্ডার্ড জীবন-যাপন করত )।
গাদ্দাফির পতনের পর পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লিবিয়ার সমস্ত তেল সম্পদের করায়ত্ত্ব করেছে পশ্চিমারা।
৪০ বছরের বেশি সময় গাদ্দাফি অর্থনৈতিক গণতন্ত্রকে বিকশিত করে সমাজের উন্নতির জন্য জাতীয় সম্পদ তেলকে প্রত্যেক নাগরিকের কল্যাণে ব্যবহার করেছেন।
গাদ্দাফির শাসনামলে তার নাগরিকরা শুধু বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবাই পাননি, পেয়েছেন বিনামূল্যে শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও বিনা সুদে ঋণ।
ন্যাটোকে ধন্যবাদ, তাদের হস্তক্ষেপের পর লিবিয়ার স্বাস্থ্য বিভাগ পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে। উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়েছে এবং রাজধানী ত্রিপোলিসহ সারাদেশে সব ধরনের অপরাধ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ন্যাটো হস্তক্ষেপের পর লিবিয়ার জনগণের যে অংশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা হলো নারী। শিক্ষা, চাকরি, বিবাহ বিচ্ছেদ, সম্পত্তির মালিকানা এবং উপার্জন সবকিছুতেই আরব বিশ্বের অন্যান্য যেকোনো দেশের নারীদের চেয়ে বেশি অধিকার ভোগ করতো গাদ্দাফি আমলে লিবিয়ার নারীরা। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ভূয়সী প্রশংসা করেছিল গাদ্দাফির।
১৯৬৯ সালে গাদ্দাফি যখন ক্ষমতা দখল করেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর সংখ্যা ছিল খুব কম। আর এখন লিবিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অর্ধেকই নারী। ১৯৭০ সালে নারী-পুরুষের জন্য সমান মজুরির আইন পাশ করেছিলেন গাদ্দাফি। কিন্তু নতুন ‘গণতান্ত্রিক’ শাসকরা নারী অধিকারকে দিন দিন দমিয়ে ফেলছে।
তিন বছর আগেই এক ঘোষণায় ন্যাটো বলেছিল, তাদের ইতিহাসে লিবিয়া অভিযানই সবচেয়ে সফল। কিন্তু সত্য হলো, পশ্চিমা হস্তক্ষেপ কোথাও কোনো উন্নতি করতে পারেনি, সেটা লিবিয়া, ইরাক এবং সিরিয়া যেখানেই হোক।
আমাদের এটা অন্তত মনে রাখতে হবে যে, পশ্চিমা হস্তক্ষেপের আগে এই তিনটি দেশই (লিবিয়া, ইরাক ও সিরিয়া) মধ্যপাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে সেকুল্যার দেশ ছিল। আর লিবিয়া তো পুরো আফ্রিকার মধ্যে জীবনমান এবং নারী অধিকারের শীর্ষে ছিল।
মধ্যপাচ্যে একদশকের সামরিক অভিযান মার্কিন নাগরিকদের ট্রিলিয়ন ডলার দেনা বানিয়েছে। তবে ব্যয়বহুল এবং রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে মার্কিনিদের একটা অংশ লাভবান হয়েছে। সে অংশটা মার্কিন সামরিক শিল্প। নতুন সামরিক ঘাঁটি মানেই মার্কিন অভিজাত সামরিক বাহিনীর জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।
এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, ইরাকে বোমা মারার জন্য মার্কিনিরা ঘাঁটি গেড়েছে কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহারাইন, ওমান এবং সৌদি আরবে।
একইভাবে আফগানিস্তানে বোমা মারতে পাকিস্তান, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিজিস্তানে ঘাঁটি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর সর্বশেষ লিবিয়ায় বোমা মারতে মার্কিনিরা ঘাঁটি বানায় সিসিলি, কেনিয়া, দক্ষিণ সুদান, বারকিনাফাসো এবং নাইজারে।
ভূ-কৌশলগত কারণে লিবিয়া দরকার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এখানে বসেই পশ্চিমারা আফ্রিকা, মধ্যপাচ্য ও ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক অংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন সহজেই। সবসময় এই তিনটি অঞ্চল অন্য দুনিয়ার মধ্যে ক্ষমতা প্রকল্পের একটি লক্ষ্যনীয় এবং কার্যকর উপায় হিসেবে কাজ করেছে।
ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিজাত শ্রেণী ও তেল কোম্পানীর জন্য সাফল্য তৈরি করতে পারে কিন্তু সাধারণ লিবিয়ার জন্য নয়। এই সামরিক অভিযান প্রকৃতপক্ষে ২১ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যর্থতা হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে।
লেখক: গাড়িকাই চেংগু, হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্স ফেলো
ভাষান্তর: মোহাম্মদ রেজা, আরটিএনএন