ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের: গতবছর বড় একটি রাজনৈতিক ধাক্কা সামলে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনীতির সূচকগুলো আবার উপরে উঠতে শুরু করেছে। অব্যাহত আছে পূর্বের উন্নয়নের ধারাও। বাড়ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। কমে আসছে মূল্যস্ফীতি। বাড়ছে আমদানি, যা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতি বৃদ্ধির প্রমাণ। নেতিবাচক ধারায় থাকা প্রবাসী অর্থও (রেমিটেন্স) মুখ উপরে তুলেছে। এই খাতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো। বাড়ছে রাজস্ব আয়। জিডিপির অনুপাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারও উত্তরোত্তর বাড়ছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে গতি পাওয়ায় বাড়ছে সরকারি বিনিয়োগ, যা গতি দিয়েছে থিতিয়ে পড়া অর্থনীতিতে। বেসরকারি খাতের ঋণেও গতি পাচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় চলতি অর্থবছরে এই খাতে ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দিন দিন বাড়ছে জিডিপি-জিএনআই’র আকার। ছয় বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দেশে-বিদেশে সরকারের দায়ও কমে আসছে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে, যা বিদেশমুখিতা কমার নির্দেশক। নানা উত্থান-পতনের মধ্যেও দীর্ঘদিন ধরে টাকার বিনিময় হার একই রয়েছে। কঠোর মনিটরিংয়ের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মানব উন্নয়নে বাংলাদেশ এবার উঠে এসেছে মধ্যম সারিতে। দারিদ্র্যও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত এক যুগে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে এক কোটি ৬০ লাখের মতো। সব সূচকই বলছে, কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকলেও উন্নয়নের ঠিক পথেই আছে দেশ- এমন মত বিশ্লেষকদের।
বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির গতিপ্রবাহ সন্তোষজনক। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কোনো মতেই খারাপ নয়। তবে বর্তমান সীমাবদ্ধতার মধ্যেই ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। রেমিটেন্সে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে যা অর্থনীতির জন্য সুখবর। দেশে ভোক্তা আস্থাও বাড়ছে যা শক্তিশালী অর্থনীতির পরিচয় বহন করছে। বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগ বাড়বে বলে জানান তিনি। বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার প্রতিবছরে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ হারে কমছে। গড় আয়ু বাড়ছে, জন্মহার কমছে। এবছর দারিদ্র্র্যের হার কমে ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ অর্থবছরেও এই হার ছিল সাড়ে ৩১ শতাংশ। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচক ২০১৪ তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বহুমুখী দারিদ্র্য সূচক দশমিক ২৯ থেকে নেমে দশমিক ২৩ এ দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসের বিষয়ে এটাকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। দেশে আয় বৈষম্যও কমেছে বলে স্বীকৃতি দিয়েছে সংস্থাটি। বেকারত্বের হারও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হারের পাশাপাশি দারিদ্র্যের সংখ্যা কমছে কি না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে শুধু দারিদ্র্যের হারই নয়, সংখ্যাও কমছে। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। তবে যা অনুমান করা হয় তা যদি বাস্তবায়ন করা হতো তাহলে এই হার ও সংখ্যা আরও কমে আসার কথা।
হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন মানব উন্নয়নে মাধ্যম সারিতে উন্নীত হয়েছে। ২০১২ অর্থবছরেও বাংলাদেশ ছিল মানব উন্নয়নে অনুন্নত দেশের তালিকায়। এই সূচকে চলতি বছরে বাংলাদেশের শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের এই পয়েন্ট দশমিক ৫৫ শতাংশ। গতবছর ছিল দশমিক ৫৩ শতাংশ। বাংলাদেশের এই অর্জন মোট জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ুতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
দেশের গড় আয়ুর হিসাবে দেখা গেছে, ২০১০ অর্থবছরে গড় আয়ু ছিল ৬৯ বছর ৪ মাস। আর ২০১৩ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২ বছর। জিএনআই (মোট জাতীয় আয়) মাথাপিছু আয় ২০১০ অর্থবছরে যেখানে ছিল ২ হাজার ৩৩৭ ডলার, ২০১৩ তে এসে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭১৩ ডলার। ৩ বছরের ব্যবধানে আয় বেড়েছে ১৬ শতাংশ।
স্বাস্থ্য খাতের এমডিজি (সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা) অর্জনে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। স্বাস্থ্য জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাতের কর্মসূচি বাস্তবায়নের অগ্রগতি সন্তোষজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ২০১১-১৬ মেয়াদে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে এই খাতে। একই সঙ্গে চলতি প্রকল্পের মেয়াদ ২ বছর থাকেতেই শিশু, নবজাতক ও মাতৃমৃত্যুহার এবং প্রজনন হার আশানুরূপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
গত অর্থবছরে দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আগের বছর হয়েছিল ৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, এবার ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। তবে সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ক্ষমতা রয়েছে অর্থনীতির।
মূল্যস্ফীতিও দিন দিন কমে যাচ্ছে যা জনজীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে। ২০১২ অর্থবছরে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ৯ শতাংশ, সেখানে চলতি বছরে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচেই থাকবে। অর্থবছরের প্রথাম দুই মাস জুলাই-আগস্টে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ শতাংশ। প্রবাসী অর্থে (রেমিটেন্স) গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমেছিল দেড় শতাংশের বেশি। সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই প্রায় ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটা অব্যাহত থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাতে রাজস্ব আয়ও বেড়ে চলেছে। গত অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় ছিল সাড়ে ১০ শতাংশের নিচে। এবার ১১ শতাংশের ওপর রাজস্ব আয় হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। অবশ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, এই হার আরও বেশি হবে।
সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার গত ৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১২ অর্থবছরেও যেখানে জিডিপির অনুপাতে এডিপির আকার ছিল ৩.৪ শতাংশ; সেখানে চলতি অর্থবছরে এই আকার হবে ৪.৭ শতাংশ।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে এই হার ১৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। গত অর্থবছরে এই হার ছিল ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। আগের বছর ছিল ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।
ছয় বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৯ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় (জিএনআই) ছিল ৬৫৬ ডলার। এবছর এই আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৬৯ ডলারে।
৫ বছরের ব্যবধানে জিডিপির আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৯ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল (চলতি মূল্যে) ৬ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে এই আকার সাড়ে ১৩ লাখ কোটি টাকার বড়।