ইরানি নারী রেইহানার মৃত্যুদণ্ড প্রকৃত ঘটনা
সিরাজুল ইসলাম
আজ ক’দিন ইরানের রেইহানা জাব্বারি নামে এক মহিলার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে সারা বিশ্বে ব্যাপক প্রচার চলছে; এর বাইরে নেই বাংলাদেশও। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঝড় উঠেছে ওই নারীর পক্ষে যারা সত্য অনুসন্ধান করতে চান তারা সত্যের সন্ধান পাবেন, আর যারা চান না তাদের জন্য নিশ্চয়ই কুতর্কের খোরাক হবে।
প্রথমেই বলে নিই বাংলাদেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা হলো, বিদেশী খবর যাচাই-বাছাই করার সুযোগ নেই। সে কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যম, বিশেষ করে এএফপি, রয়টার্স, এপি, ভোয়া বা বিবিসি যা দেয় তাই চোখ বন্ধ করে গিলতে হয়। আর মিডিয়ার শীর্ষপর্যায়ে যারা বসে আছেন তারাও সাধারণত এগুলো নিয়ে এত মাথা ঘামান না অথবা ঘামালেও শেষ পর্যন্ত পশ্চিমাদের প নিয়ে থাকেন। আর নারী বা কথিত মানবাধিকার ইস্যু হলে তো কথাই নেই। অবশ্য এর কারণও অনেক। নানা সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করেন তারা। এ ছাড়া ইসলাম বা ইরানবিদ্বেষী লোকের অভাব নেই। এ ধরনের খবর পেলেই তারা বলেন, বিবিসি বা ভোয়া বা অমুক বার্তা সংস্থা দিয়েছে তো! তাহলে কি এসব সংবাদমাধ্যম কখনো খবর বা সত্য বিকৃত করে না! মিডিয়াকর্মী হিসেবে খুব কাছ থেকেই জানি তাদের তথ্যবিকৃতির ধরন।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে, রেইহানাকে ‘অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছে’। আরো বলা হচ্ছে, ‘ধর্ষণ থেকে আত্মরা করতে গিয়ে তিনি ওই লোকটিকে খুন করেছেন অর্থাৎ নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে, ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুনের ঘটনাটি ঘটাতে হয়েছে। তার পরও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে!’ তার মানে হচ্ছে, নারীর এই প্রতিরোধকে স্বীকার করা হলো না, নারীর অধিকারকে স্বীকার করা হলো না। কেউ কেউ বলছেন, এই বিচারের মাধ্যমে ধর্ষণকে উৎসাহ দেয়া হলো।
বাস্তবে রেইহানা ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুন করেননি। ঘটনাটি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইরানের বিচার বিভাগ এতটা নারীবিদ্বেষী নয় যে, অন্যায়ভাবে একজন নারীকে ফাঁসি দেবে। হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল। ওই মহিলা নিজের দোষও স্বীকার করেছেন আদালতে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণেও ব্যর্থ হয়েছেন।
ঘটনাটি হলো, দু’জনের অবৈধ সম্পর্কের জেরে একপর্যায়ে তাদের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং এই খুনের ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রে পুরুষ লোকটি যে ভালো মানুষ ছিলেন, তা বলারও সুযোগ নেই। বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে রেইহানা লোকটিকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। এর দুই দিন আগে রেইহানা নতুন ছুরি কিনেছিলেন এবং তার এক বান্ধবীকে এসএমএস করেছিলেন যে, ‘খুনের ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে।’ এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার; তা হলো এই মহিলার সাথে ইরানের আদালতের এমন কোনো বিরোধ ঘটেনি যে, তাকে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে হবে। অথবা এই মহিলা ইরানের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন না, যে কারণে তার ফাঁসি কার্যকর করতে হলো। বরং যদি এমন হতো যে, খুন হয়নি বরং অবৈধ সম্পর্ক বা ধর্ষণের ঘটনার বিচার হচ্ছে, তাহলে ওই পুরুষ লোকটাও মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়তেন। এ ক্ষেত্রেও ইরানের আইন অনুসরণ করা হতো। দেখা হতো না, কে পুরুষ আর কে নারী; যেমনটি দেখা হয়নি রেইহানার ক্ষেত্রে।
সাত বছর আগের ঘটনা এটি; এমনটি নয় যে, তাড়াহুড়া করে একজন নারীকে ফাঁসি দিয়ে আদালত বিরাট কিছু করে ফেলছেন। যেভাবে মিডিয়ায় খবরটি এসেছে, এটা নিতান্তই মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা গণমাধ্যম ও কথিত মানবাধিকারকর্মীদের প্রচারণা। আমি তো ইরানে থাকি, এখানকার নারীরা যে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করেন, তা বেশ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হচ্ছে। ইরানের সমাজে নারীর যে কেমন মূল্যায়ন তা অনেকের জানা নেই এবং জানলেও হয়তো প্রকাশ করবেন না; বরং বলার চেষ্টা করবেন, ইসলামি সরকার এতটা বর্বর এবং এ কারণে একজন নারীকে ফাঁসি দিলো ইত্যাদি। কল্পনা করা যাকÑ যদি ঘটনাটা পুরুষের বেলায় ঘটত তাহলে কি পুরুষ লোকটা বেঁচে যেতেন ফাঁসির হাত থেকে? নিশ্চয়ই নয়। ইরানের আইনের মূল ভিত্তি হচ্ছে ইসলামি বিধান। যে অন্যায় ঘটেছে তার জন্য নারী-পুরুষ মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হচ্ছে আইন ও তার প্রয়োগ। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বহু খুনের ঘটনার বিচার হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে দোষীদের। সেখানে নারী-পুরুষ কখনো বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠেনি, বিচার হয়েছে অপরাধের।
২০০৭ সালে সংঘটিত হয় আলোচ্য হত্যাকাণ্ডটি। ঘটনাটি সাত বছর ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে তারপর ইরানের আদালত রায় দিয়েছেন। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে পরে আবার বিচার হয়েছে এবং তারা রায় বহাল রাখেন। তার পরও এক মাস দেরি করা হয়েছে যে, ভিক্টিম পরিবার যদি মাফ করে দেয় তাহলে ফাঁসিটি কার্যকর করা হবে না; কিন্তু ওই পরিবার মাফ করেনি। ইরানের বিচারব্যবস্থায় খুনের ঘটনায় কারো মৃত্যুদণ্ড হলে ভিক্টিম পরিবার ছাড়া কারো পে সে রায় পাল্টানোর সুযোগ নেই। এমনকি প্রেসিডেন্ট বা সর্বোচ্চ নেতাও তা পারেন না। এটা ইসলামের বিধান; তা কারো ভালো লাগুক আর না লাগুক। মনে রাখতে হবে, ইরান সম্পূর্ণ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। ইসলামি আইন হচ্ছে এখানকার বিচারব্যবস্থার মূল ভিত্তি। কারো কথায় বিচার বিভাগ প্রভাবিত হয় না; কারো কথায় আদালতের রায় পাল্টায়ও না। ইরান আমেরিকাকে পাত্তা দেয় না বলেই তারা বিষয়গুলো নিয়ে বেশি পানি ঘোলা করে। মানবাধিকারকে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়; কিন্তু আমেরিকার মানবাধিকার পরিস্থিতি কী? গতকালও একটা নিউজ বের হয়েছে, ২০১২ সালে আমেরিকায় ৪৯ বছর বয়সী মিল্টন হল নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে আট পুলিশ ঘিরে ধরে ৪৫টি গুলি করে হত্যা করেছে, যেন ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। সোমবার তার ভিডিও ফুটেজ বের হয়েছে। যে দেশের প্রেসিডেন্ট নিজে কৃষ্ণাঙ্গ, সেই দেশের অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে অন্য সময় কী হবে আর বাস্তব অবস্থা কতটা শোচনীয়! গুয়ানতানামো কারাগারের কথা কেন তুলে ধরি না। সেখানে বছরের পর বছর বিনাবিচারে শত শত মুসলমানকে আটকে রাখা হয়েছে সন্ত্রাসবাদের অজুহাতে। তারা অনশন করেন বলে নাকের ভেতর দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে; কিন্তু এসব নিয়ে বেশির ভাগ মিডিয়া খবর দেয় না। এগুলো তো আর পশ্চিমা মিডিয়া সচরাচর প্রচার করে না। যা হোক, কথিত নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জাব্বারির মৃত্যুদণ্ডের ঘটনাটি দেখলে সত্য এড়িয়ে যাওয়া হবে। ইরানে নারীবাদ বা পুরুষবাদ বলে কিছু নেই। পরিশেষে বলব বিশেষ করে সংবাদকর্মীদের জানা থাকার কথা, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো কেমন করে খবর বিকৃত করে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করে। আর মানবাধিকার যেন তাদের পৈতৃক সম্পত্তি; এটি তারা ছাড়া রক্ষা করার আর কেউ নেই। ইরাক-আফগানিস্তানে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে এরা; কিন্তু ভাবখানা এমন যে, তা কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় পড়ে না। মানবাধিকার ইস্যুকে তারা স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। কারণ, এটা না করলে যে তাদের সব অন্যায় ধরা পড়ে যাবে, বুঝে ফেলবে বিশ্ববাসী। আমরা তাদের এমন প্রতারণার শিকার বৈকি।