বার্লিন প্রাচীর পতনের ২৫ বর্ষপূর্তি উদযাপন
জার্মানি ঐতিহাসিক বার্লিন প্রাচীর পতনের ২৫ বর্ষপূর্তি উদযাপন শুরু করেছে। ১৮৮৯ সালের ৯ নবেম্বর ইউরোপের শীতল যুদ্ধের আনন্দজনক অবসান উপলক্ষে রোববার এক বিশাল অনুষ্ঠানের আগে পূর্ব জার্মানির নিপীড়নমূলক শাসন থেকে পালাতে গিয়ে নিহতদের স্মরণে তিন দিনব্যাপী এক অনুষ্ঠান চলছে। পূর্ব জার্মানিতে বেড়ে ওঠা বর্তমান জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল এ অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন।
‘স্বাধীনতার জন্য সাহসিকতা’ শীর্ষক উৎসব এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মাধ্যমে ২৮ বছর পর পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট কর্তৃপক্ষকে সীমান্ত খুলে দিতে বাধ্য করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই ঘটনার এক বছরের মধ্যে ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর দুই জার্মানি পুনঃএকীভূত হয়। একটা ঐতিহাসিক দিন, জার্মানদের নিজস্ব দিন এবং সেই সঙ্গে আরো অনেক কিছু, বিশেষ করে সাবেক পূর্ব জার্মানির মানুষদের কাছে৷ কিন্তু ফেডারাল জার্মান প্রজাতন্ত্র এবং সেই সঙ্গে ইউরোপের পক্ষে দিনটার তাৎপর্য কম নয়।
১৯৮৯ সালের ৯ নবেম্বর। দিনটা ছিল এক আশ্চর্য দিন। সন্ধ্যায় সেই আমলা-মার্কা ঘোষণা, ‘এখন থেকে সবার যাতায়াতের স্বাধীনতা থাকবে’। সেখান থেকে শুরু করে সে’রাতে বার্লিন প্রাচীরের পতন অবধি মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জার্মান তথা ইউরোপীয়দের জীবন পাল্টে যায়। কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানি গণআন্দোলন আর পলায়নপর নাগরিকদের চাপে ভেঙে পড়ে। বার্লিন প্রাচীরের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জিডিআরের অন্ত ঘটেÑ যদিও পুনরেত্রীকরণ ঘটে তার এক বছর পরে। জিডিআরের অস্তিত্বেরই আর কোনো কারণ থাকে নাÑ এক ওয়ারশ’ জোটের সদস্যতা ছাড়া। তা সত্ত্বেও গর্বাচভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, এবং সেই সঙ্গে পূর্ব বার্লিনের ক্ষমতাসীন শাসকরা বলপ্রয়োগ করা থেকে বিরত থেকেছেন। বেইজিংয়ের স্বর্গীয় শান্তির চত্বরে যেমনটা হয়েছে, তেমন কোনো ‘চৈনিক সমাধান’ পূর্ব জার্মানির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়নি। ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানি, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরি কিংবা ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার মতো ১৯৮৯ সালে পূর্ব জার্মানির স্বাধীনতা আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করা হয়নি। বার্লিন প্রাচীরের পতন পুবের জার্মানদের শান্তিপূর্ণ বিপ্লবকে পূর্ণাঙ্গ করে।
৯ নবেম্বর ছিল এক সুখের, আবেগের দিন। এ’দিনে সব বিস্মৃত, অবহেলিত অনুভূতি আবার ফুটে ওঠে: দু’তরফেই পুনর্মিলনের আকাক্সক্ষা; পুবের মানুষদের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। জার্মানরা, বিশেষ করে বার্লিনের মানুষজন যেন ঘোরে ছিলেন। এমন এক আনন্দের অনুভূতি, যা আমাদের অনেককে কাঁদিয়ে ছেড়েছিল। সেই অনুভূতিই আমাদের বুঝিয়ে দেয়, ৪০ বছরের বিভাজনও দুই জার্মানির আত্মীয়তাবোধকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে উইলি ব্রান্ডের সেই চিরন্তন, অপরূপ কথাগুলি: ‘যা একসঙ্গে হবার কথা, তা-ই এখন একসঙ্গে হচ্ছে’। জার্মান কথাটা হলো ‘ওয়াকসেন’, মানে গজিয়ে ওঠা, লতাপাতার মতো, প্রকৃতির মতো। সেই উদ্ভিন্ন জার্মান ঐক্যে; কিন্তু জার্মানির প্রতিবেশীদের কোনো বিপদ ঘটেনিঅ ১৯৮৯’র শান্তিপূর্ণ বিপ্লব জার্মানিকে ইউরোপের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করে। পুবের জার্মানদের বিদ্রোহ ছিল কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে, যে ‘তত্ত্বাবধায়ক রাষ্ট্র’ সব কিছুকে নিয়মের জালে জড়িয়ে রাখে, বেঁধে রাখে। পুবের জার্মানরা বিদ্রোহ করেছিলেন এক উন্মুক্ত দেশের দাবিতে, যে দেশে মানুষজনকে আটকে রাখা হয় না। যে কারণে যাত্রার স্বাধীনতা ছিল তাদের একটি কেন্দ্রীয় দাবি। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমানোর দাবিটা অতো জোরালো ছিল না। যে কারণে ইতিহাসের একটি রসিকতা হলো এই যে, পুনরেকত্রিত জার্মানির রাজনৈতিক ডিএনএ’তে একটি ‘শক্তিশালী কল্যাণরাষ্ট্রের’ স্বপ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
৯ নবেম্বরের পর জার্মানি আরো বেশি প্রোটেস্টান্ট, আরো বেশি পূর্বমুখী, আদর্শবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আরো বেশি মধ্যমপন্থী এবং কম বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। বলতে কি, জার্মানি যেন আরো বামঘেঁষা হয়ে উঠেছে। এই জার্মানির প্রতিনিধিত্ব এবং শাসনের দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক পূর্ব জার্মানির দুই নাগরিক: ইওয়াখিম গাউক এবং আঙ্গেলা ম্যার্কেল। জার্মানির অভ্যন্তরীণ ঐক্যও অনেক দূর এগিয়েছে, যদিও অনেকের কাছে তা এখনও দৃষ্টিগোচর নয়। সেই ঐক্যের সূচনা ঘটে ৯ নবেম্বর ১৯৮৯’র সুখস্মৃতিতে।